সূর্য পশ্চিমে হেলেছে অনেকখানি। ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। জোহান দাঁড়িয়ে আছে ছাদহীন বাড়ির মাঝের খোলা প্রান্তরে। সিটি বাজানোর শব্দ শুনে পেছনে ঘুরে তাকাল জোহান। অন্ধকারের ভেতর একটুকরো আলোছায়ায় দেখল সেহরিশকে। জোহান তটস্থ হয়ে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে। দু-হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে সোজা হেঁটে এল সেহরিশ। সেহরিশ ঠোঁটে স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় বলল, 'অনেক গুলো বছর পর আবারও দেখা কিন্তু কখনো ভাবিনি এভাবে দেখা হবে।'
'তুই কি করে জানিস আমি এখানে আছি।'
'আমার সম্পর্কে সব জেনে বসে আছিস। তারপরও এরূপ বোকা বোকা প্রশ্ন করছ।'
জোহান জবাব দিল না। সেহরিশ বলল, 'এত বছরে আমার সামনে কোনো শত্রুই বেশিদিন টিকতে পারে নি। কিন্তু তোর কথা ভিন্ন, আমি সত্যি অবাক হয়েছি৷ এজন্য নয় যে তোকে চিনতে আমার দেরি হয়েছে। এটা ভেবে যে তুই একটা অপদার্থ! আর এখন কাপুরষ। নিজের শত্রুর সাথে মুখোমুখি মোকাবিলা করার সৎসাহস টুকু তোর নেই। জেদের বসে শত্রু তো বানিয়ে ফেলিস আবার সে শত্রুকে মারার জন্য অন্যদের পায়ে পড়িস। তারপর হাজারও কূটকৌশল ছলবল করিস। তার চেয়ে বড় কথা শত্রুর আগেপিছে সবাই কে মেরে তাকে দূর্বল বানিয়ে তারপর হত্যা করার পরিকল্পনা এঁকেছিস। এখানে একটা বিষয় তো ক্লিয়ার! দূর্বল তুই নিজেই। নিজের দূর্বলতা আড়াল করার জন্য ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের প্রাণ নিতেও দুবার ভাবিস না।'
জোহান শান্ত ভঙ্গিতে সেহরিশের কথাগুলো শুনছিল। এবার সে বলল, 'শত্রুকে দূর্বল করে মারার যে মজা, সেটা সরাসরি মেরে পাওয়া যায় না। তোকে মারার জন্য আজ পর্যন্ত অনেক কিছু করেছি কিন্তু কোনোটাই সফল হয়নি। কতো হুমকি দিয়েছি একটুও ভয় পাসনি। অতীতের অনেক কথাই মনে পড়ছে। দেরিতে হলেও এখন বুঝতে পারছি, মাস্টার কে হারানোর জন্য নিজেকে মাস্টার হতে হয়। সে সময় তো আর জানতাম না তুই আন্ডারওয়ার্ল্ডের কিং! তবুও একটা কথা এখানে তোর একা আসা উচিত হয়নি। তোর কি মনে হচ্ছে আমি একা আছি এখানে?'
জোহান ভ্রু কুঞ্চিত করল। আড়াল থেকে অনেক পুরুষ লোক বেরিয়ে এল। সেহরিশ ঠোঁট জোড়া বাঁকা করে মৃদু হাসল। সেহরিশ প্রসন্ন হেসে বলল, ' বাঘ একাই হাঁটে। দলবেঁধে চলে তো কুকুর।'
সেহরিশের কথাটুকু শুনে চোয়াল শক্ত হলো জোহানের। সে ওর লোকেদের ডেকে বলল সেহরিশকে মারার জন্য। ওরাও দলবেঁধে আক্রমণ করল। সেহরিশ তাদের আহত করে মাটিতে ফেলতে লাগল।
নির্জন রাস্তায় ধরে গাড়ি চলছে। সাদাফ মাঝেমাঝেই তাকাচ্ছে রোদেলার দিকে। আবার চিন্তা হচ্ছে সেহরিশের সঙ্গে। ওদিকে কেমন পরিস্থিতিতে আছে সে জানে না। কল করেছে, ফোন বন্ধ। রাস্তার ধারের একটা গাছের ডালে বসা একটি পাখি ডেকে উঠল দীর্ঘ আর উচ্চ আওয়াজে। গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সাদাফ। পাখির আওয়াজটাই যেনো তাদের স্বাগত জানালো, এই পরিত্যক্ত শহরে। মহল থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাড়ি নষ্ট হলো।
রোদেলা জিজ্ঞেস করল,
'কি হলো?'
'বুঝতে পারছি না। সম্ভবত ইঞ্জিনে কোনো সমস্যা হয়েছে।'
'এখন? আমরা কিভাবে ওনার কাছে যাব? এদিকে তো কোনো গাড়িও নেই।'
'মহল বেশিদূরে না এই পথেই সোজা গিয়ে বাঁয়ে তারপর ডান দিকে বিশাল মহল।'
রোদেলা সময় বিলম্ব করল না। গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত দৌঁড় দিল। সাদাফ হতভম্ব। ওদিকের অবস্থা তার জানা নাই। আদৌও কি সেহরিশ এখানে আছে? আর যদি থেকেই থাকে ভেতরে যাওয়া কতটা সেইফ? সাদাফ সিট বেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নামল। এরপর রাস্তা ধরে দৌঁড়ে যেতে লাগল।
জোহানের লোকেরা আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। ব্যথার আর্তনাদ করছে তারা। সেহরিশের সঙ্গে লড়াই হলো জোহানেরও। দুজনের শরীরের অনেক জায়গা কেটে গেছে। জোহান মাটিতে বসে আছে। সেহরিশের দিকে ভয়মিশ্রিত চোখে তাকিয়ে। সেহরিশের হাতে একটা পিস্তল। পিস্তলটা জোহানের মস্তিষ্ক বরাবর নিশানা করছে সেহরিশ।
তরল কণ্ঠে বলল সেহরিশ,
'অবশেষে সেই দিন চলেই এল। তোর মৃত্যুর দিন। কিন্তু তোকে এত সাধারণ মৃত্যু দিতে আমার মন চাচ্ছে না। ওর পাপ অনেক, সেই পাপের সামনে এই ছোট্ট শাস্তি কখনোই গ্রহণ যোগ্য না।'
সেহরিশ জোহানের বুক থেকে একটু নিচে গুলি করল। জোহান চিৎকার করে উঠল। সে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল রোদেলা। সেহরিশ হতবিহ্বল চোখে তাকায় রোদেলার দিকে। সে এখানে এল কিভাবে? প্রশ্নটা সেহরিশের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জোহান মাটিতে পড়ে আছে। তার রক্ত বন্যা বইয়ে দিচ্ছে।
রোদেলা থরথর করে কাঁপছে। নিজ চোখে প্রথমবার কাউকে মরতে দেখল সে। সাদাফের কথাগুলো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে নি রোদেলা। কিন্তু এখন? কি করে অবিশ্বাস করবে সে। সেহরিশ নিশ্চল হেঁটে এল রোদেলার সামনে। খানিকটা ঝুঁকে রোদেলার হাত ধরল সে। তারপর স্তিমিত গলায় বলল, 'রোদ, তুমি এখানে কি করছ? বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়া উচিত ছিল তোমার।'
রোদেলা সেহরিশের হাতখানা ছাড়িয়ে দিল ততক্ষণে। বড্ড এলোমেলো লাগছে নিজেকে। রোদেলা কান্না জড়ানো গলায় বলল, 'আজ পর্যন্ত যত মানুষ মারা গেছে তার জন্য দায়ী আপনি। বাবা-মা, ভাইয়া-ভাবী, মারিয়া, আরুশি , সাদ আর সোহা সবার মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী। আপনি একজন অপরাধী। একজন খু. খুনি।' রোদেলার কণ্ঠ দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না কান্নার কারণে। সেহরিশ এক পা এগোল। রোদেলার হাতখানা ধরতে গিয়ে হাত থেকে পিস্তল পড়ে গেল তার। সেহরিশ রোদেলার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, 'রোদ, রোদ শান্ত হও প্লিজ। পাগলের মতো কোরো না। চলো আমার সঙ্গে..'
রোদেলা জোর করে সেহরিশের হাতটা এক ঝাঁকায় সরিয়ে দিল। তারপর শক্ত গলায় বলল, 'আপনি এতো দিন ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে ছিলেন আজ আপনার সে মুখোশ খুলে পড়ে গেছে। আমি আপনার সঙ্গে কোথাও যাবো না। আপনি সবার খুনি।'
রোদেলার মুখে এসব কথা শুনে মনটা ভারী উতলা হয়ে উঠল সেহরিশের। এত বছরের বৈবাহিক সম্পর্ক তাদের অথচ ক্ষণিকের জন্যও রূঢ় আচরণ করে নি রোদেলা। সেহরিশের মনটা ছটফট করতে লাগল। সে-তো কারো ক্ষতি করে নি। শুধু অন্যায় করা লোকেদের নিজ হাতে শাস্তি দিয়েছে। তবে কেনো তার এতো শত্রু? তার ক্ষতি করার জন্য ওতপেতে থাকে? কেনো? এসব প্রশ্নের উত্তর সে কখনো পায়নি সেহরিশ।
সেহরিশ বলল,
'আমি কখনই চাইনি তুমি আমার সম্পর্কে এই দুটো বিষয় জানো। অস্ত্র চোরাচালান আর মানুষ হত্যা এই দুই ঘটনা জানলে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমি সবসময় এই নিয়ে ভয়ে থাকতাম। রোদ, তুমি বিশ্বাস করো আমি অন্যায় ছাড়া কারোরই ক্ষতি করিনি। কখনো না।'
রোদেলা মৌনতা ভেঙে বলল,
'আপনি যা করছেন সেসব অন্যায় পাপ। আমি আপনার সঙ্গে আর এক মূহুর্তও থাকতে পারব না।'
সেহরিশ বলল,
'আমাকে ছেড়ে যেও না। এই পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নাই। তোমাকে ছাড়া আমি নিজেকে একমুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না।' সেহরিশ নরম গলায় বলল, 'আমি সব ছেড়ে দেবো। তোমার কথা মতো চলব। তুমি যা বলবে সব শুনবো। তুমি শুধু আমার কাছে থাকো। আমি তোমার জন্য আমার সমস্ত পাপ কাজ সব ছেড়ে দেবো।'
সেহরিশ সোজা হয়ে দাঁড়াল। জোরে জোরে শ্বাস টেনে আবারও বলল, 'রোদ, চলো আমরা দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে এসব পাপকাজ থাকবে না। থাকবে শুধু সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি। তুমি আমি আর আমাদের ছোট্ট সংসার।'
সেহরিশের আহ্বান কোনোকালেই অবহেলা করতে পারে নি রোদেলা। সেহরিশের সে ছাড়া যেমন কেউ নেই। ঠিক তার-ও তো কেউ নেই। রোদেলা একবার অতীতের কথা চিন্তা করল। এরপর সেহরিশের দিকে তাকাল তারপর দৃষ্টি নামিয়ে নিল সেহরিশের ফেলানো হাতের দিকে । একরাশ জড়তা কাটিয়ে সেহরিশের হাতে হাত রাখার জন্য হাত তুললো রোদেলা। বুকের ভেতরটা তখনো ধড়ফড় করছে। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে সেহরিশের হাতে নিজ হাতটা রেখেই দিল। সেহরিশ হাসল।
রোদেলা হঠাৎ মাটিতে লুটপাট লুটিয়ে পড়ল। তার মাথা থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেহরিশ। সমগ্র শরীর ঝিমঝিম করছে তার। মাটিতে পড়ে আছে রোদেলা। সেহরিশের চোখে মুখে বিস্ময়, বিষাদ। হঠাৎ সেহরিশের চেনা পরিচিত পৃথিবী পাল্টে যেতে লাগল। সেহরিশ মাটিতে বসল। সে হাত বাড়িয়ে রোদেলার হাতখানা ধরল। তারপর মৃদু গলায় বলল, 'রোদ. রোদ!'
রোদেলা কথা বলল না। তার চোখ বন্ধ।
জোহান কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। এই সেহরিশকেই সে এতকাল ধরে দেখতে চাচ্ছিল। অসহায়, দূর্বল। জোহান অট্টহাসি দিয়ে উঠল। তারপর বলল, 'সময় আমার ফুরায় নাই সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী। সময় তো তোর ফুরিয়েছে, দেখ তোর মৃত্যুদ্যুত সামনে দাঁড়িয়ে আছে।'
সেহরিশ তাকাল না। তার কর্ণধারে পৌঁছাতে পারেনি জোহানের একটি কথাও। সেহরিশ তখনো রোদেলার মৃত্যুর ঘোরে। সেহরিশ তার আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিতে লাগল রোদেলার গাল, কপাল, ঠোঁট, চোখ।
জোহান হাতের পিস্তলটা সেহরিশের নিশানা করে ধরল। সে-সময় একটা বড় পাথর জোহানের হাতে এসে লাগল। পিস্তলটা ছিটকে গিয়ে পড়ল কোথাও। জোহান পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল সাদাফ। একটুও সময় বিলম্ব না করে সে অন্য রাস্তার দিকে আহত শরীর নিয়ে দৌঁড়ে গেল। সাদাফ তার পিছু নিল।
এই এতো বড় মহলে পথ হারিয়ে ফেলেছিল সাদাফ। রোদেলার মতো সে-ও গুলির আওয়াজ শুনেই এই জায়গায় আসতে পারলো। সাদাফ মহলের পিছন দিকে এসে পড়ে। জোহান ততক্ষণে ওর গাড়িতে উঠে চলে গেল। সাদাফ রাগে ক্ষোভে পাথুরে সজোড়ে লাণ্থি দিয়ে তারপর ফিরে এল।
সেহরিশ রোদেলাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলার মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তখনো। সাদাফ পেছন দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, 'ও পালিয়েছে ধরতে পারিনি।' এটুকু বলে থামল সাদাফ। সামনে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল।
সাদাফ বলল,
'রোদেলার কি হয়েছে সেহরিশ? কথা বলছিস না কেন? ওর কাপড় থেকে রক্ত ঝরছে কেন?'
সেহরিশ কোনো জবাব খুঁজে পেল না দেওয়ার মতো। তাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সাদাফ সেহরিশের সামনে গেল। কাঁধে হাত রেখে আবারও ডাকলো। সেহরিশ তাকাল সাদাফের দিকে। আলতোভাবে ঠোঁট নেড়ে স্পষ্ট ও নরম গলায় বলল, 'আমার এখন কোনো অনূভুতি কাজ করছে না। আমি সবকিছু ধ্বংস করে দিবো। সবাই কে মেরে ফেলব।'
সাদাফ কিছু বলার সুযোগ পেল না। ততক্ষণে সেহরিশ অজ্ঞান হয়ে গেছে। রোদেলার সাথে মাটিতে পড়ে যায় সে।
••••••••••••••••••
উল্টো দিক থেকে বাতাস বইছে। ঠাণ্ডা বাতাসে গাছের পাতা মৃদু দুলছে। রাস্তার পাশের গাছে ছোট্ট পাখিটির ভেতর এক অদ্ভুত বিহ্বলতা। গাছের ডালে বসে আছে সে। উড়ছে এক ডাল থেকে আরেক ডালে। কোন কিছুই তাকে শান্তি দিতে পারছে না যেনো। সূর্যের আলোতে কোন তীক্ষ্ণতা নেই। পৃথিবীর সবকিছুই মনে হয় চলছে ধীরগতিতে। উমাইয়া বিধস্ত অবস্থায় বসে আছে। ক্ষণিকের জন্য নিজেকে দাঁড় করালো সাদাফের মুখোমুখি। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, 'আপনি যা করছেন সেটা অন্যায়।' বলে থামল উমাইয়া। একটু দম নিয়ে আবার বলল, 'রোদেলা এখনো বড় ভাইয়ার স্ত্রী। ওর দাফনের সব কাজ বড় ভাইয়ার করা উচিত। উনি এখনো বেহুঁশ। আর আপনি এই সুযোগে রোদেলাকে কবর দিতে নিয়ে যাচ্ছেন। জনাজা ও শেষ করেছেন।'
সাদাফ বলল,
'উমা, সেহরিশ কে আমি যতটা কাছ থেকে দেখেছি তুমি দেখো নি। তুমি ওকে তেমন ভাবে জানোও না। আমি জানি, নিজ চোখে দেখেছি, সেহরিশের জন্য তার পুরো পৃথিবী এক দিকে আর অন্য দিকে রোদেলা। সেহরিশ রোদেলা বলতে পাগল। ওর যদি একবার হুঁশশ ফিরে তখন সে কী রোদেলার দাফন হতে দিবে? কখনোই না। বরং বদ্দ উন্মাদ হয়ে যাবে। তখন তাকে সামলাবো নাকি এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করব?' সাদাফ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। এরপর উমাইয়ার মাথায় হাত রেখে বলল, 'আমাকে সবটা নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে দাও, উমা। জানি, সেহরিশের জ্ঞান ফিরলে ও রাগ করবে আমার ওপর। হয়তো চেঁচামেচি করে আমার গায়েও হাত তুলবে। তবুও আমি এটা করতে চাই।'
উমাইয়া জিজ্ঞেস করল,
'রোদেলার কবর কোথায় হবে?'
সাদাফ বলল,
'সেহরিশের পছন্দের জায়গায়। ও আগে বলতো যখন সে মা-রা যাবে তখন জেনো তাকে ওখানেই কবর দেওয়া হয়। মানুষের কোলাহল থেকে দূরে নির্জন জায়গায়।'
সেহরিশের জ্ঞান ফিরল ঠিক সন্ধ্যায়। একহাতে মাথাটা চেপে প্রচন্ড ব্যথা করছে মাথা। খাট থেকে পা নামিয়ে ঝুলিয়ে বসল। অস্ফুটস্বরে বলল, 'রোদ এক গ্লাস পানি দাও।'
বলে চোখ তুলে তাকাল সেহরিশ । তার বলা কথাগুলো চার দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে তার কাছেই ফিরে এল। একটু পর গত রাতের ঘটনা গুলো মাথা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। সেহরিশ খালি পায়ে রুম থেকে দৌঁড়ে বের হলো। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে দেখল উমাইয়া বসে আছে সোফায়। সেহরিশ তার দিকে এগিয়ে গেল।
সেহরিশ বলল,
'উমাইয়া, তোমরা এখানে। আ.. আমার রোদ কোথায়?'
উমাইয়া মাথা নিচু করে ফেলল। কিছু বলল না। সেহরিশ একটু কঠিন স্বরে বলল, 'কথা বলছ না কেনো? সাদাফ কোই?'
সাদাফ বাড়িতে নেই। ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলছে বাড়ির গেস্ট হাউজে। উমাইয়া শান্ত ভাবে সেহরিশ কে জানালো রোদেলার কবরের কথা। জেগান ভিলার পেছনে বিশাল বড় অরণ্য। উঁচু উঁচু মাটি দেখতে প্রায় মাটির পাহাড়ের মতো। রোদেলাকে মাটির পাহাড়ের উপরের অংশে কবর দেওয়া হয়েছে। সেহরিশ হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল।
সেহরিশ কে কোনোভাবে স্বাভাবিক লাগছিল উমাইয়ার। সাদাফের কথাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে এখন তার। সেহরিশ যেতে উমাইয়া সাদাফের কাছে ছুটে গেল।
ঘন জঙ্গল, ঝোপঝাড় লতাপাতা সব পেছনে ফেলে উপরে উঠতে লাগল সেহরিশ। বেশ কয়েকটা কাঁটাযুক্ত গাছ লেগেছে হাত ও পিঠের দিকে। পা পিছলে কয়েকবার পড়ে গিয়ে আবারও উঠে দৌঁড়াতে লাগল সেহরিশ। অবশেষে বিশাল বড় গাছটার কাছাকাছি এসে থামল সেহরিশের পা। গাছের সাথে লাইটের ব্যবস্থা করা আছে। সে আলোয় চতুর্দিক আলোকিত।
সেহরিশ ধপ করে কবরের পাশে বসে পড়ল। দু-চোখ ফুটন্ত লাভার মতো লাল হয়ে গেছে তার। এই নির্জন নিশিতে অশুভ আত্মারা ভর করেছে যেনো তাকে। সেহরিশ খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে সর্ব শক্তিতে চিৎকার করে উঠল। পরোক্ষণেই দু-হাতে রোদেলার কবরের মাটি খাবলাতে লাগল। দু-চোখের কোল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে যাচ্ছে।
সেহরিশ বলল,
'রোদ. রোদ. রোদেলা! তুমি এখানে কেন শুয়ে আছো? এটা তো আমার জায়গা। এই রোদেলা... রোদেলা তুমি এতো নিষ্ঠুর কেনো? তুমি তো আমায় কথা দিয়েছিলে কখনো আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। তুমি কেন তোমার কথা রাখলে না? কেন? কেন? আমাকে ছেড়ে এখানে শুয়ে আছো? আমার কষ্ট হচ্ছে রোদেলা। বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। রোদেলা...'
সাদাফ ও আর-ও কয়েকজন পাহাড়ে উঠার পথ দিয়ে উঠে আসছে। সেহরিশের মাটি খাবলানো দেখে অনেকেই কাছে আসার দুঃসাহস করতে পারছে না। সাদাফ দৌঁড়ে গেল। দু'হাতে সেহরিশ কে জড়িয়ে ধরল সে।
সেহরিশের দু-চোখে রাজ্যের ক্লান্তি। সে অসহায় চোখে তাকায় সাদাফের দিকে। বিড়বিড় করে বলল, 'আমার রোদেলা এখানে শুয়ে আছে। আমার কষ্ট হচ্ছে, আমার এই কষ্ট আমি কাকে দেখাবো? আমার বুকের ভেতরে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আমার রোদেলা।'
সেহরিশ আচমকা সাদাফের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। এরপর আবারও মাটি খাবলাতে লাগল। উন্মাদের মতো বলতে লাগল, 'আমার রোদেলার কষ্ট হচ্ছে। ও মাটির নিচে দম নিবে কিভাবে? তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তোমরা আমাকে সাহায্য করো। আমার রোদেলাকে তোলো। ওর কষ্ট হচ্ছে। আমার রোদ অন্ধকারে ভয় পায়। ওকে তোলো।'
সেহরিশের আর্তচিৎকার ওই আকাশেও যেনো আজ অনুভব করতে পারছে। হঠাৎ বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়েছে। সেহরিশের সঙ্গে কাঁদছে আকাশও। সেহরিশের চোখদুটো বন্ধ হয়ে এল। সেহরিশ তখন বিড়বিড় করে বলল, 'আমার রোদেলা ওকে তোলো। আমার রোদের কষ্ট হচ্ছে।'
সেহরিশের বন্ধ চোখের কার্নিশ থেকে অশ্রুজল গড়িয়ে বৃষ্টির সাথে মিশে গেল।
••••••••••••••••
সপ্তাহ খানেক গা ঢাকা দিয়ে আরাম করেই কাটিয়েছে জোহান। হঠাৎ এক রাতে ঘুম ভাঙতে সে দেখল তার ঘরে দশ বারো জন পুরুষ লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কাউকেই সে চিনে না। প্রথমত ভাবলো সে বোধহয় স্বপ্ন দেখছে। কারণ তার এই গুপ্ত জায়গার কথা একটা পাখি ও জানে না। জোহান সোজা হয়ে উঠে বসল। ঠিক সে সময় সাদাফের গম্ভীর মুখটা দেখতে পেল জোহান। আঁতকে উঠল সে। উচ্চ গলায় নিজের লোকদের ডাকতে উদ্যত হলো সে। হুট করে কান বরাবর সজোরে চড় বসিয়ে দিল সাদাফ। জোহান কানে হাত দিয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে কানের পর্দা ফেটে গেছে। ঝিনঝিন করছে।
সাদাফ, জোহানের শার্টর কলার ধরে বলল,
'তোর পোষা কুকুররা ভয়ে পালিয়েছে। আর বাকিরা মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গেছে।'
জোহান কে তারই বাড়ির ছাদে নিয়ে গেল সাদাফ। ছাদের মাঝখানে পায়ের উপর পা তুলে বসে অপেক্ষা করছে সেহরিশ। জোহান কে ধাক্কা দিয়ে সেহরিশের পায়ের কাছে ফেলল সাদাফ। সেহরিশ তাকাল গম্ভীর ভঙ্গিতে দেখল কিছুক্ষণ জোহান কে। এরপর শক্ত ও গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, 'তোকে বলেছিলাম, আমি তোকে কঠিনের থেকেও কঠিন শাস্তি দিবো। আমার পরিবার, আমার আদরের ভাই তূর্ণ এবং আমার জন্য যাদের প্রাণ নিয়েছিস সবার প্রতিশোধ এখন আমি তুলবো। তোর যা ইচ্ছা হয়েছে তাই করছিস। এখন আমি করব। তোর সঙ্গে আর তুই দেখবি। প্রতিটি মূহুর্তে মৃত্যুর জন্য ছটফট করবি। মৃত্যুর জন্য ভিক্ষা চাইবি। এটাই তোর শাস্তি।'
সেহরিশ চলে গেল। একবারও পেছনে তাকাল না সে।
জোহানকে লোহার চেয়ারে বসানো হলো। মেটাল বেল্টের মাধ্যমে হাত-পা ও মাথা আটকে দিয়ে হাই ভোল্টেজ ইলেক্ট্রিক শক দিতে লাগল ত্রিশ মিনিট পর পর। জোহানের হাত পা এর নখ উপড়ে ফেলা হলো খুব নিষ্ঠুরভাবে। জোহানের এক একটা চিৎকারে মাটি ও আকাশ জেনো কেঁপে কেঁপে উঠছে। একটানা সাতদিন এইভাবে থেমে থেমে শাস্তি দেওয়া হলো তাকে। শরীরে অবশিষ্ট শক্তিটুকুও তার নেই। দুদিন ধরে খেতেও পারছে না সে। সাদাফের পা ধরে ক্ষমা চাইল। মৃত্যু ভিক্ষা চাইছে সে।
সাদাফ মি. জারবেন এর উদ্দেশ্য শক্ত গলায় বলল,
'মারা না যাওয়া পর্যন্ত শক দিবে।'
জারবেন মাথা নাড়লো। বলল,
'স্যার, এমনিতেও মরেই যাবে মনে হচ্ছে।'
সাদাফ অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে শ্বাস ফেলল।
••••••••••••••
রোদেলার প্রিয় রঙ হলুদ। সেহরিশ রোদেলার প্রিয় রঙের সাথে মিলিয়ে একটা শার্ট পরেছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকক্ষণ নিজেকে দেখল। এরপর চুল ঠিক করল৷ বিছানার উপর রাখা ফুলের তোড়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল সেহরিশ। এরপর তোড়াটা হাতে নিয়ে জেগান ভিলার বাহিরে এল সে। খুব স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে উঠে যেতে লাগল মাটির পাহাড়ের সরু পথটা ধরে। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে। চুলগুলো মৃদু উড়ছে। একহাতে অবাধ্য চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে এগিয়ে এল সেহরিশ। রোদেলার কবরের উপর ফুলের তোড়াটা রেখে আকাশের দিকে মুখ করে ঘুরে বসল সেহরিশ।
আকাশের বুকে বিশাল চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলো চারিদিক আলোকিত করে রাখছে। সেহরিশ আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি নামিয়ে আনলো। পেছন দিকে ঘুরে কবরের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল। তারপর হঠাৎ একহাত কানে রেখে বলল, 'আজ দেরি করে আসলাম বলে তুমি আমার উপর রাগ করেছ? আচ্ছা এই দেখো কান ধরেছি। আর কখনো দেরি করব না। সব সময় তোমার কাছেই থাকব।'
সেহরিশের চোখ দুটো আবছা হয়ে গেল। দু-চোখে টলমল করছে জল। সেহরিশ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, 'তোমাকে ছাড়া আমি ভালো থাকি কি করে বলো? ওই অট্টালিকায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। রোদ। এই শুনতে পাচ্ছো? আমি তুমি হীনা ভালো নেই।' ভারী নিঃশ্বাস ফেলল সেহরিশ।
'এই ভিন দেশে ছোটো থেকে একা বড় হয়েছি। ছোটো থেকে চাইতাম অনেক বড় হবো। এতো বড় হবো যাতে মানুষ নাম শুনেই ভয় পায়। কিন্তু তখনো বুঝিনি আমার এই বড় হওয়ার ইচ্ছা আমার থেকে তোমাকে কেঁড়ে নিবে। আমি কখনো ভাবিনি তোমাকে এভাবে হারিয়ে ফেলব।' পরপর কয়েকবার ঘনঘন শ্বাস ফেলল সেহরিশ। বুকটা ভারী হয়ে আসছে তার।
'মানুষ যাকে বেশি ভালোবাসে তাকেই হারায়।'
সেহরিশ নিঃশব্দে কাঁদছে। সহসা কারো কণ্ঠস্বর শুনে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল গোল হয়ে বসে আছে রোদেলা। তার শরীর থেকে সাদা আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সেহরিশ অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইল। রোদেলা মৃদু হাসল। তারপর বলল, 'আমি আপনাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি।'
সেহরিশ বলল, 'পরিস্থিতি মানুষকে সেসব করায় যা সে কখনো করেনি।'
রোদেলা বেশ খানিকক্ষণ সেহরিশের দিকে তাকিয়ে রইল। রোদেলা তার হাতটা কোলের উপরে রেখে থপথপ করল। সেহরিশ উল্টো হাতে গাল মুছে নিয়ে রোদেলার কোলে মাথা রাখল। রোদেলা আলতো স্পর্শে সেহরিশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মোটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে সাদাফ। সে রোজ ওখানে দাঁড়িয়ে সেহরিশকে দেখে। ওর পাগলামিটা দেখে। সাদাফ অনেক বার তাকে বুঝিয়েছে রোদেলা আর নেই। তার অস্তিত্ব নেই। কিন্তু সেহরিশ মানতে নারাজ। সেহরিশ যখন রোদেলার কবরের কাছে আসে তখন সে রোদেলাকে দেখতে পায়। রোদেলা তার সঙ্গে কথা কত কথা বলে, মুচকি হাসে। এটা সত্য নাকি তার ইমাজিনেশন সেহরিশ তা জানে না। কিংবা সে জানতেও চায় না। রাতের একটা সময় সে রোদেলার সঙ্গে কাটাচ্ছে এটাই তার কাছে বহু মূল্যবান।
সেহরিশ রোদেলার কোমড় জড়িয়ে ধরল। তারপর নরম গলায় বলল,
'রোদ!'
'হুম!'
'তুমি আমার প্রাণ! তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়, অসম্পূর্ণ, বড্ড নিরুপায়। আমার ঘরটা এখন শূন্য জানো, সেখানে তুমি নেই। তোমার হাঁটার শব্দ নেই। তোমার হাসির আওয়াজের প্রতিধ্বনি নেই। আমার জন্য এখন আর কেউ অপেক্ষা করে বসে থাকে না। খাবার টেবিলেও না। তুমি কোথাও নেই। শুধু রয়েছ আমার বুকে।'
'রোদ।'
'হুম।'
সেহরিশ উঠে বসল। সে নিষ্পাপ চোখে রোদেলার দিকে তাকাল। তারপর রোদেলাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ঠোঁট দিয়ে নরম ও মৃদু কণ্ঠে বলল,
'যুগের পর যুগ চলে যাবে, কিন্তু তোমাকে হারানোর আক্ষেপ আমার কখনো ফুরাবে না!'
'আমি তোমাকে কখনো মুখে বলতে পারিনি, রোদ, আমি তোমাকে ভালোবাসি।' বলে থামল সেহরিশ। জোরে শ্বাস টেনে আবারও বলল, 'বিজ্ঞানী মহাবিশ্বের শেষ না পাওয়া পর্যন্ত আমি তোমাকে ভালোবাসি। মৃত্যুর পরেও তোমায় ভালোবাসবো।'
.
.
.
সমাপ্ত........................................................................