রঞ্জনের সঙ্গে এক বিরাট আকাম ঘটে গেছে। যেইসেই আকাম নয়, বৃষ্টির দিনে কাঁদা মাটিতে আছাড় খাওয়ার মতো বেহিসাবি আকাম। সে আজ নাপিতের কাছে চুল কাটতে গিয়েছিল। সালমা সুলতানা কয়েকদিন ধরে এই চুল নিয়ে অনেক জ্বালাতন করছেন। তার মতে, রঞ্জনের এই ঘাড় সমান চুলের জন্য তাকে যাযাবরের মতো লাগে। ভিক্ষুক বলে অপমানও করেছেন কতশত বার! রঞ্জন কখনো গায়ে মাখেনি। কিন্তু কাল রাতের অপমানটা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলেই সকাল সকাল চুলে কাটছাট করতে আবুলের দোকানে হাজির হয়েছিল সে। আবুল কানে কম শোনে। একটু অবুজও। ছোটবেলায় সংসার সংসার খেলতে গিয়ে কোন মেয়ে তার কানে কটনবার্ড ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কানের পর্দা ফেটে এলাহি কান্ড! তারপর থেকে আবুল ডান কানে কম শোনে। মাঝে মাঝে শোনেই না।
সেই কানা আবুলকে রঞ্জন স্পষ্ট গলায় বলেছিল, ‘সুন্দর করে আর্মি কাট দিবি। লম্বা লম্বা চুলে তেঁতাভেঁতা হয়ে গেছি। ক্লিন করে দে মাথাটা।’
‘আইচ্ছা।’
আবুল মাথা কাত করে সম্মতি দেয়। কাঁচি হাতে নেয়। সে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত তাদের বিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র ছিল। সে হিসেবে মোটামোটি ইংরেজি আবুল বুঝে। কানের সমস্যার কারণে আগে পিছে না শুনলেও রঞ্জনের 'মাথা ক্লিন করে দে' কথাটায় সে বুঝলো, তাকে মাথা টাক করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কাঁচি দিয়ে তাই চুলের আগা গোড়া এক এক করে কাঁটতে লাগলো সে। রঞ্জন তখন নড়বড়ে চেয়ারটায় হেলেদুলে প্রায় শুয়ে পরেছে। চোখ বোজা, ঘুমে কাতর। আবুলের এই আবুলগিরি সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। চুলে টান পরায় তার আরাম লাগছে। বেয়াদব ঘুম আরও জেঁকে বসেছে। তারপর... তারপর যখন রঞ্জনের ঘুম ভাঙ্গলো? ততক্ষণে সব শেষ। সব আরাম-টারাম উধাও। সামনের ময়লা আয়নায় বেচারা হতবাক হয়ে দেখল, তার সখের চুলগুলো আর নেই। লাইটের আলোয় ফর্সা চান্দি ঝিলিক মারছে। একটু নড়লে চড়লেই মাথার লাইটও নড়েচড়ে ওঠে।
আবুল রঞ্জনের কটমট চাহনি বুঝলো না। মনের বেদনায় বিচলিত হলো না। পাশ থেকে সরিষার তেল নিয়ে সরল মনে শুধাল, ‘চান্দি তো শুকনা শুকনা লাগতিছে ভাইজান। তেল মালিশ কইরা দেই?’
রাগে দুক্ষে রঞ্জনের কান্না পেয়ে গেল। কাল বাদে পরশু তারা চট্টগ্রাম চলে যাবে। সেখানে তার একখানা প্রেমিকা আছে। প্রেমিকার সাথে বহু সাধের প্রেমও আছে। তাদের বাড়ির প্রতিবেশীর মেয়ে রমনা, টয়া, পাখি, কেয়া রঞ্জনকে পছন্দ করে। প্রেমপত্রের সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। সেই মেয়েগুলোর সামনে রঞ্জন এই টাক মাথা নিয়ে যাবে কিভাবে? তার সম্মান বলে কিছু থাকবে? তাকে দেখে ওরা হাসবে না? মেয়েগুলো হাসবে কিনা জানা নেই, তবে বাড়ির উঠোনে পা রাখা মাত্রই রঞ্জনকে দেখে ধরণী কাঁপিয়ে হাসলো কৃষ্ণ। মুখ শুকনো, ফর্সা শরীরের সাথে মিলিয়ে তেলতেলে ফর্সা মাথার রঞ্জনকে দেখে কৃষ্ণ কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলো না। পেটে হাত চেপে হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পরলো। কাঁদা মাটিতে গড়াগড়ি খেল। কিন্তু তার হাসি থামল না। রঞ্জনের তখন এত্ত রাগ হলো! হনহনিয়ে কোত্থেকে কাঁচি আর ব্লেড নিয়ে আসলো সে। হাসতে হাসতে প্রায় মরে যাওয়া কৃষ্ণকে চেপে ধরে মুহুর্তেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে কেঁটে ফেলল কৃষ্ণর সমস্ত চুল। আওয়াজ তুলে খিকখিক করে হেসে বলল, ‘আরও হাস! এখন হাসছিস না কেন? সখ মিটে গেছে? আর হাসবি?’
সেসময় ফুটবল হাতে দৌড়ে এলো প্রান্ত। ভাইদের এমন আজগুবি লেবাস দেখে চোয়াল ঝুলে গেল তার। হাত থেকে বল পরে গেল। কণ্ঠে বিস্ময় ঢেলে অসহ্য রকম চেঁচাল, ‘এ কি হাল তোমাদের ভাইয়া? চুল কই? মাথার চান্দি এমন চকচক করছে কেন?’
রঞ্জন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তুই এখান থেকে যা।’
‘যাবো না। তোমরা নেড়া হয়েছে কেন?’
‘তোর কি?’
‘তোমাদের দেখে আমার গা গুলাচ্ছে। কোনো মেয়ে তোমাদের আর পাত্তা দেবে না।’
‘না দেক। তুই যা।’
প্রান্ত গেল না। খেয়াল করে দেখল, সূর্যের আলোয় রঞ্জনের তৈলাক্ত মাথা ঝলমলিয়ে উঠছে। তেলতেলে ভাব কাছে ডাকছে যেন। প্রান্তর গা গুলিয়ে উঠল। নাক সিঁটকে বলল, ‘ইছ! ইছ! ইছ!’
রঞ্জন অবশ্য এবার আর কিছু বলল না। তার রেগে যাওয়ার কথা। প্রান্তকে একধাপ বকে কান মলে দেওয়ার কথা। কিন্তু তেমন কিছুই সে করেনি। বরং চিৎকার চেঁচামেচি বিহীন খুব শান্ত মেজাজে ধরে বেঁধে প্রান্তকেও টাক বানিয়ে দিল।
উঠানের এককোণে মিতা, ধুতরা আর মানুষী দাঁড়িয়ে ছিল। তারা চুপচাপ ভাইদের কান্ড দেখছে। হাসি পেলেও হাসছে না। টু শব্দটিও করছে না। এখন কথা বলা মানে বিপদ। ঘোর বিপদ! বলা তো যায় না, কথা বলার অপরাধে যদি তাদের মাথাও নেড়া বানিয়ে দেয়?
••••••••••••••
রঞ্জনের নেড়া মাথা নিয়ে কাহিনী তখনো শেষ হয়নি। ইতরের বংশধর হিসেবে এই ছেলে যে পুরো একমাস তার চুল নিয়ে বেইমানির কথা কাউকে ভুলতে দিবে না, তা সবার জানা। রাতে এ নিয়ে সভাও বসলো। বড়দের কাউকে নিয়ে না। ভাইবোনরা শুধু। প্রান্ত আর কৃষ্ণ একপাশে গোমড়া মুখে বসে আছে। তারা এসব আলতুফালতু আলাপ শুনতে আগ্রহী না। তবুও শুনতে হচ্ছে। না শুনে উপায় আছে? ওদিকে মিতা আর ধুতরার আগ্রহের শেষ নেই। তারা খুব সাচ্ছন্দ্যে রঞ্জনের চুলের হৃদয়বিদারক ঘটনা শুনছে। মাথা দুলাচ্ছে। মাঝে মাঝে গুটিকয়েক প্রশ্নও করতে দেখা যাচ্ছে ওদের।
শীতের রাত। কনকনে শীত না হলেও ঠান্ডার প্রখরতা একটু আধটু পাওয়া যায়। সুদূর কয়েলের গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসছে মানুষীর। সে একটু পরপর মোবাইলের স্ক্রীনে তাকাচ্ছে। সকাল থেকে এ নিয়ে পাঁচটা মেসেজ পাঠিয়েছে সাদিফ। ভিত্তিহীন আগামাথা ছাড়া মেসেজ। মানুষী চোখ বুলিয়েছে শুধু। পড়েনি। কিন্তু এবারেরটা ভয়েস মেসেজ। ভাইবোনদের সামনে শোনা যাবে না। আবার না শুনেও থাকা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ ইতিউতি করে মানুষী বাথরুমের নাম দিয়ে ঘরে চলে এলো। দরজা লাগাল। হাতের চাপে ভয়েস মেসেজটা চালু করা মাত্রই সাদিফের বিরক্ত কণ্ঠ, ‘বিয়েতে যখন রাজিই হবি তাহলে এত ঢং করলি কেন? আমি থাকতে থাকতে রাজি হতে পারলি না? আমি যাওয়ার পরই তোর রাজি হতে হবে কেন? কি জন্য? সারাটা জীবন জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে মেরেছিস। শান্তি দিসনি। এখনো তোর আমাকে জ্বালাতে হবে? তুই এত খারাপ? আমার দু:খ কষ্ট তোর এত ভালো লাগে? আমি এই একলা চট্টগ্রামে একলা একলা নিজের বিয়ের খবর শুনছি। এটা মানা যায়? তুই মানতে পারতি?’
মানুষী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ লোক শোধরাবার নয়। যেই দেখেছে মানুষী একটু নরম হয়েছে, সম্পর্কটা মেনে নিচ্ছে, ওমনি! শুরু হয়ে গেল তার আগের মতো ইতরামি করা। মানুষী আরেকদফা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টাইপ করল, ‘আপনি কি কখনো ভালো হবেন না?’
সাদিফের পালটা প্রশ্ন, ‘হলে? ভালো হলে কি দিবি?’
‘কিছুই দিব না।’
‘না দিলে আমি ভালো হবো কিজন্য? গিভ এন্ড টেক ছাড়া সাদিফ কিছু করে না।’
‘আপনি যে ইতরদের মধ্যে চরম অভদ্র তা জানেন?’
সাদুফ মাছি তাড়ানোর মতো করে লিখল, ‘জেনে কি হবে? এ পর্যন্ত কম কীটপতঙ্গের নামে তো ডাকিস নি! রোজ রোজ ইঁদুর, বিড়াল, ইতর, খাডাশ হিসেবেই দেখিস। সেখানে একটু অভদ্র হলে ক্ষতি কি? কার জাত যাবে?’
মানুষী হাল ছাড়লো, ‘আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হওয়াই আমার ভুল হয়েছে।’
দেখা গেল এ মেসেজের উত্তর সাদিফ আর দিলো না। বরং সঙ্গে সঙ্গেই তার ফোন এলো। মানুষী ইচ্ছে করে প্রথম দুটো কল ধরল না। রিং হতে হতে কল যখন কেটে গিয়ে তৃতীয় বারের মতো আবার বেজে উঠল? মানুষী কল তুলল। সহজ গলায় বলল, ‘বলুন।’
ওপাশ হতে সাদিফের গম্ভীর হওয়ার ভান, ‘তোর সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’
‘হ্যাঁ, বলুন। শুনছি।’
‘তুই আমাদের বিয়েতে সত্যি রাজি হয়েছিস?’
‘আপনার কি মনে হয়?’
সাদিফ দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, ‘আমার মনে হয় তুই রাজি আছিস।’
‘তাহলে আছি।’
‘সত্যি সত্যি?’
‘কি সত্যি সত্যি?’
‘তুই সত্যি রাজি মানুষী? আমি স্বপ্ন দেখছি না বল? তোর অভিমান ভেঙ্গেছে?’
কানে তীব্র হর্ণের শব্দ আসছে। পিপ পিপ! পিপ পিপ! বাতাসের তেজি হাওয়াটুকুও কানে তালা লাগানোর মতো। এ লোক নিশ্চয়ই এখন বাইক চালাচ্ছে? বাইক চালাতে চালাতে ফোনে কথা বলছে? মানুষী প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেল, ‘আপনি কোথায়?’
‘হাইওয়েতে।’
মানুষী কখনো সাদিফকে ধমক দেয়নি। রেগে কথা বলেনি। এবারও পারল না। তবে উঁচু গলায় বকলো খুব, ‘আপনার মাথা ঠিক আছে? হাইওয়েতে কেউ বাইক চালিয়ে ফোনে কথা বলে? আক্কেল গেছে? বাইক থামান এক্ষুণি!’
সাদিফ বোধহয় কথাটা শুনলো। বাইক থামাল। গাড়ির হর্ণের শব্দ শোনা গেলেও এখন আর বাতাসের তেজটুকু পাওয়া যাচ্ছে না।
‘আপনি আমাকে কেন কল করেছেন সাদিফ ভাই? আপনার কি আমাকে বিরক্ত করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই?’
সেকথার উত্তর পাওয়া গেল না। সাদিফের আজ বড় মন খারাপ। তার বিয়ের খবর সে আজ সন্ধ্যার দিকেই পেয়েছে। বাবা কল করে বলেছিলেন। খবরটা শুনে সাদিফ খুশি হতে পারেনি। কোথাও যেন একটা সূক্ষ্ণ... খুব সূক্ষ্ণ একটা ব্যথা তাকে পিড়া দিয়েছে, দিচ্ছে। মানুষী কি সত্যিই রাজি? মন থেকে বিয়েতে মত দিয়েছে? কেউ জোড় করেনি তো? তারচেয়েও বেশি হাঁসফাঁস লাগছিল মেয়েটাকে সামনে না পেয়ে। এইযে, তার ইচ্ছে করছে মানুষীকে চোখের সামনে বসিয়ে রাখতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেয়ে চেয়ে দেখতে, মেয়েটার অভিযোগ শুনতে! কলে কি আর অতশত কথা বলা যায়? মনের স্বতঃস্ফূর্ত ভাব প্রকাশ করা যায়? সাদিফ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। কোমলস্বরে ফের একই প্রশ্ন করল, ‘মাধুবিলতা, তুই সত্যি রাজি?’
এবার আর হেয়ালিপনায় মন সায় দিল না মানুষীর, ‘হ্যাঁ।’
‘তুই আমাকে ভালোবাসিস?’
‘না।’
‘আমিও। আমিও তোকে ভালোবাসি না মানুষী।’
.
.
.
চলবে........................................................................