‘আগে ছিলি যাযাবর, এখন হইছোত চোর!’
কথাটা অপমানের ঠিক কোন স্তরে গিয়ে ঠেকল রঞ্জনের জানা নেই। সে অতসব গোণায় ধরে না। বরং মায়ের ওপর চাপা রাগটা হঠাৎই মাত্রা ছাড়ালো যেন। গলার খাবার আর গেলা হলো না। রোষপূর্ণ দৃষ্টে চেয়ে রঞ্জন সাবধানি গলায় বলল, ‘তুমি কিন্তু আমাকে রাগাচ্ছো, মাহ্!’
ছেলের রাগ, বিদ্বেষ অতি তুচ্ছভাবে অগ্রাহ্য করলেন সালমা সুলতানা। পাত্তাই দিলেন না একদম! মুখে বিরক্তির সূক্ষ্ণ কণারা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। স্বামীর পাতে দুটো পরোটা দিয়ে লুকিয়ে থাকা বিরক্তিকে টেনে হিঁচড়ে তিনি বললেন, ‘তোমার ছেলেকে আমি চুল কাটতে বলেছিলাম। জঙ্গলিদের মতো কিসব বড় বড় চুল রেখেছে। কাটতে বলায় এখন দেখ! রেগেমেগে মাথার সবকটা চুল উধাও করে এসেছে। চেয়ে দেখেছ কেমন ছিলা মুরগির মতো লাগে তোমার ছেলেকে? বলি হারি! রাগ করবি কর। তাই বলে নিজের ক্ষতি করতে হবে কেন? এই বান্দর চেহারা দেখে কেউ মেয়ে দিতে চাইবে? কোনো মেয়ে পাত্তা দিবে ওকে?’
রঞ্জন শক্ত কামড়ে পরোটা চিবালো। কটমট কণ্ঠে বলল, ‘এমন ভাবে বলছো যেন আমার আর চুল গঁজাবে না! চুল কি কোনো অপার্থিব জিনিস নাকি? এখন কি চুলের জন্য আমার সাধনা করতে হবে?’
‘পারলে সেটাও কর। বয়স বাড়ছে। বিয়েশাদীর খবর নেই। এই চুল কি বেশিদিন থাকবে বলে মনে করেছিস? এদিকে তোর ভাই আরেকটা! বিয়ের জন্য রীতিমতো পাগল হয়ে গেছে। বড় জনকে রেখে ছোট জনকে বিয়ে দেওয়া যায়? সমাজ মানে এসব? কিন্তু নাহ্! তিনি বিয়ে করবেনই! আসলে কি বলতো? তোরা পয়দাই হয়েছিস নালায়েক। মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। বাপটা সারাজীবন অকাজ করে গেছে। তোদেরও শিখাচ্ছে সেই অকাজই!’
হাকিম ভূঁইয়া খুকখুক করে কাঁশলেন, বিষম খেলেন। টেবিলের আগাগোড়ায় থাকা প্রত্যেকটা মানুষের মিটিমিটি হাসি নজরে আসতেই গম্ভীর মুখটাকে আরেকটু গাম্ভীর্যতায় মুড়িয়ে নিলেন তিনি। থমথমে গলায় শুধালেন, ‘এই সামান্য ব্যাপারে এত চেঁতেছ কেন?’
‘তো চেঁতব না? তোমার ছেলেকে দেখছ? মুখ এট্টুখানি আর টাক এত্ত বড়! এ নিয়ে আবার তোমার ছেলেকে কিছু বলাও যাবে না। বললে মহাশয় তাদেরও মাথা বেল করে দিবেন। বলি, নিজে বেল হবি হ। মাঝখান দিয়ে কৃষ্ণ আর প্রান্তর সুন্দর চুলগুলো কাটলি কেন? তুই হাসার মতো কাজ করলে ওরা হাসবে না?’ স্বামীর দিকে চেয়ে ফের বললেন, ‘তুমি এখন এর একটা বিচার করো। ছেলে দুটো কালকে থেকে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।’
হাকিম ভূঁইয়া চোখে কম দেখেন। ডাক্তার তাকে বহুবার চশমার পরামর্শ দিলেও তিনি তা গ্রাহ্য করেননি। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে একটা চশমা না নিলেই নয়! তাঁর ঠিক ডান পাশে প্রান্ত, কৃষ্ণ আর রঞ্জন সারিবদ্ধ ভাবে বসে আছে। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে হাকিম ভুঁইয়া কেবল বুঝলেন, এগুলো কোনো টাক মাথা নয়, বরং দুটো গোলাকার চাঁদের মাঝে একটা গোল অমাবস্যা ঘুরপাক খাচ্ছে। তিন তিনটে চকচকে চান্দি কি বিচ্ছিরি ভাবে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে! বুকের বা'পাশটায় চাপ অনুভব করলেন হাকিম ভূঁইয়া। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলেন-ফেললেন। দূর্বল গলায় সালমা সুলতানাকে বললেন, ‘তুমি আমার পাশের চেয়ারে বসো, সালমা। আর দাঁড়িয়ে থেক না। তোমার ক্ষিধে পেয়েছে। খাও।’
সালমা সুলতানা তৎক্ষণাৎ বসে পরলেন। বাস্তবিকই তিনি ক্ষুধার্ত। পেটে এতক্ষণ অসহ্য যন্ত্রণাগুলো আন্দোলন মুখি হয়ে উঠেছিল। সেই কবে ঘুম থেকে উঠেছেন তিনি!
ধীরস্থির ভাবে প্লেটে পরোটা নিলেন সালমা সুলতানা। একপাশে সবজি তরকারি নিলেন। তবে খেলেন না। হাকিম ভূঁইয়াকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কিভাবে বুঝলেন আমার ক্ষুধা লেগেছে?’
‘তুমি রেগে যাচ্ছিলে।’
‘মানে? রেগে যাওয়ার সাথে ক্ষুধার কি সম্পর্ক?’
‘ক্ষুধা লাগলে তুমি চেঁতে যাও। রাগারাগি করো।’ কথাটা বলতে বলতে একটু করে পানি পান করলেন হাকিম ভূঁইয়া। সময় নিয়ে আবার বললেন, ‘খাচ্ছো না কেন সালমা? খাবারটা শেষ করো। খেয়েদেয়ে যদি রাগ থাকে, রাগটা ঝেড়। আমি শুনব। এখন খাও।’
বোধকরি রাগের বদলে এবার খানিকটা লজ্জায় মিইয়ে পরলেন সালমা সুলতানা। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন, বড় জা আর ছোট জা আঁচলে মুখ চেপে হাসছে। তালহা ভূঁইয়া আর মানুষীর বাবা মুখ গম্ভীর করে রেখেছেন। ছোট ছেলেমেয়েগুলোর খিলখিলানো হাসিতে তৎক্ষণাৎ গুমোট পরিবেশটার অদল বদলে গেল। সেই হাসিতে সালমা সুলতানার রাগ হলো না। বিরক্তির রেশ ছুঁলো না। বরং হুট করেই রাগটা গায়েব হয়েছে। ভর করেছে একরাশ কিশোরী দিনের আবেগ, সেই পুরোনো অথচ তরতাজা ভালোবাসার একটুখানি স্মৃতি।
•••••••••••••••
দুটো দিন গরমের তাচ্ছিল্যকর স্পর্শের পর আজ আবারও শীতের হাওয়া দোলা দিতে এসেছে। ঘড়িতে সকাল দশটা বেজে আট মিনিট। কুয়াশায় আচ্ছন্ন বাহিরটা পরোখ করে লেপের নিচে নিজেকে গুটিয়ে নিল মানুষী। মাথার ওপর চলতে থাকা বৈদ্যুতিক পাখা তখন থমকানো, স্থির। নি:শব্দ ঘরে কি যেন বাড়ি খাচ্ছে বারংবার। মানুষীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে আপাতত ঘুমাতে ব্যস্ত। সামনে পরীক্ষা বিধায় এ ক'দিন রাত জেগে পড়তে হচ্ছে। মানুষী আবার রাত জাগা ছাড়া পড়তে পারে না। তার মতে, পড়ালেখার মতো অস্বাভাবিক জিনিস মগজে ঢুকাতে হলে অবশ্যই একটা কোলাহল মুক্ত পরিবেশ চাই। যেখানে কেউ তাকে ডাকবে না, বিরক্ত করবে না। শুধু সে আর তার নিস্তব্ধতা বিরাজ করবে। গভীর রাত মাত্রই সেই চাহিদা পূরণ করার অধিকার রাখে।
ঘুমের ঘোরে কি একটা অস্পষ্ট কিছু দেখলো মানুষী। কল্পনা কিংবা নিছক কিছু নয়। বহু পুরোনো একটা চিরকুট। কালো বর্ণের কাগজে সাদা কালির দাগ। সময়টা আরও দেড়-দুই বছর আগের। সাদিফের হঠাৎ প্রত্যাখানের বিপরীতে মানুষী নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছিল। সাদিফের সামনে যেত না, আগ বাড়িয়ে কথা বলতো না। এড়িয়ে চলার প্রতিযোগিতায় নামা সত্ত্বেও সে খুব চাইতো, লোকটা যেন তাকে ডাকে, তার অভিমান ভাঙ্গায়! অথচ সাদিফ ছিল নির্লিপ্ত। নির্বিকার। কখনো মানুষীর এড়িয়ে চলা খেয়াল করেছে কি-না জানা নেই, তবে সেবার চট্টগ্রাম ফিরবার আগে তার পড়ার টেবিলে খুব ছোট্ট একটা চিরকুট ফেলে গিয়েছিল,
“তোর মতো চূড়ান্ত বেয়াদব মহিলা আমি আর দেখিনি, মানুষী।”
ফোন বাজছে। কলের তীব্র শব্দে ভাসমান চিরকুটের লিখাগুলো আচমকা মানসপট হতে হারিয়ে গেল। চট করে চোখ মেলল মানুষী। ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখল, অপরিচিত নম্বর। এ নিয়ে দু'বার কল করেছে। রয়েসয়ে কলটা রিসিভ করে মানুষী ঘুমুঘুমু কণ্ঠে আওড়াল, ‘হ্যালো, কে বলছেন?’
ওপাশ হতে তৎক্ষণাৎ গাঢ় ধমক, ‘কত বড় বেয়াদব তুই মানুষী! আমার নম্বর ব্লক করেছিস কোন সাহসে? কিজন্য?’
কাল রাতে সাদিফের 'ভালোবাসি না' শোনা মাত্রই কল কেটে নম্বর ব্লক করে দিয়েছিল মানুষী। করবেই না কেন? ইতর লোকটা এখনো তার অভিমান ভাঙ্গায় নি। শান্ত ভাবে বসে দুটো প্রেমের আলাপ করেনি। তার আছে যত গা জ্বালানো কথা।
মানুষী তপ্ত নিশ্বাস ফেলল। কান থেকে মোবাইল তুলে অপরিচিত নম্বরটা দেখে নিলো একবার। এরপর শুধাল, ‘কল কি শুধু এজন্যই দিয়েছেন?’
সাদিফের তড়িৎ উত্তর, ‘না।’
‘কি জন্য কল দিয়েছেন তাড়াতাড়ি বলুন। আমি ঘুমাবো।’
‘তোর না আজকে কোচিং আছে?’
‘আছে।’
‘কয়টায়?’
‘তা জেনে আপনি কি করবেন?’
প্রশ্নে পিঠে পালটা প্রশ্ন শুনে মেজাজ বিগড়ালো সাদিফের। ভারিক্কি গলায় বলল, ‘আছে কাজ। তুই টাইম বল। কয়টায় কোচিং?’
‘বিকালে। চারটার সময়।’
এবার আর সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো না। নিশ্বাসের তীক্ষ্ণ সুর নিশ্চুপ ভাবে শুনছে মানুষী। খাতায় কি যেন কচকচ শব্দে লিখার আওয়াজটাও সুস্পষ্ট ভাবে কানে আসছে। সাদিফ কি কিছু লিখছে?
নিমিষেই সাদিফের বেশরম কণ্ঠ শোনা গেল, ‘তোর কাছে ছয় হাজার টাকা হবে মানুষী? বিকাশে এখন পাঠাতে পারবি?’
নাহ্! কণ্ঠস্বর শুনে মোটেও মনে হচ্ছে না, লোকটা অনুরোধ কিংবা ধার চাইছে। বরং কথার ধরণে স্পষ্ট আদেশ। মানুষী হতবাক হয়ে শুধাল, ‘এত টাকা দিয়ে আপনি কি করবেন?’
‘নিজের জন্য কিছু অর্ডার করেছি। কিন্তু টাকা নেই।’
‘টাকা না থাকলে অর্ডার করবেন কেন? লজ্জা করলো না আপনার আমার কাছ থেকে টাকা চাইতে?’
সাদিফ ভারি অবাক হয়ে বলল তখন, ‘আশ্চর্য! লজ্জা করবে কেন? আমার মতো একজন প্রতিষ্ঠিত ছেলে যে তোর কাছে টাকা চাইছে, এ কথা শুনেই তো তোর খুশিতে গঙ্গাযমুনায় লাফ দেওয়ার কথা। আমি তো আর এত নিষ্ঠুর নই। তোকে ওসব লাফ-টাফ দিতে হবে না। খচরসহ টাকাটা পাঠিয়ে দেয়।’
‘এত টাকা দিয়ে আপনি কি কিনেছেন?’
‘গোপন কিছু। তোকে বলা যাবে না।’ তারপর একটু চুপ থেকে বলল, ‘তোর কাছে টাকা নেই?’
ব্যাপারটা তেমন না। এরচেয়ে বরং বেশিই আছে। বাবা প্রতিমাসে হাত খরচের জন্য তাকে কিছু টাকা দিয়ে থাকেন। আবার কিছু প্রয়োজন হলে নিজ গরজেই সেসব নিয়ে আসেন। সে কারণে হাত খরচের টাকাগুলো আর খরচ করা হয় না। জমে জমে দশ হাজারের মতো হয়েছে।
মানুষী আর তর্ক করতে চাইলো না। দুটো শব্দে উত্তর দিলো, ‘আছে। পাঠাচ্ছি।’
•••••••••••••••
তখন সবে সবে বিকাল হয়েছে। চারিদিকে ঠান্ডার আবেশ, শিহরণ। আঁটসাঁট ভাবে সোয়েটার জড়ানো মানুষী হঠাৎ খেয়াল করলো, টং দোকানির ছেলে আজীম তার পিছু নিয়েছে। ছেলেটার বয়স কম। সবে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। মানুষী দাঁড়াতেই ছেলেটাও দাঁড়িয়ে গেল।
‘কি? পিছু নিয়েছিস কেন আমার?’
প্রকাশ্যে ধরা পরে যাওয়ায় একটু বোধহয় লজ্জাই পেল ছেলেটা। ভ্যাবলাকান্তের মতো হেসে বলল, ‘ভাই আপনার জন্য উপহান পাঠাইছে বুবু।’
মানুষী একপলক বাড়িয়ে রাখা হাতটার দিকে তাকালো। খুব ছোট প্লাস্টিকের একটা প্যাকেট। জিজ্ঞেস করল, ‘সাদিফ ভাই?’
‘হ। বুঝলেন কেমনে?’
মানুষী উত্তর দেয় না। হাত বাড়িয়ে প্যাকেট নেয়, খুলে। একটা লাল রঙের আংটির বক্স। ভেতরে চিকনচাকন একটা আংটিও আছে। দেখে স্বর্ণের মনে হচ্ছে। মানুষীর ভ্রু কুঁচকে গেল। কপালে গুটি কয়েক ভাঁজ ফেলে সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকের প্যাকেটটা উল্টেপাল্টে দেখলো সে। ইতর লোকটা তার জন্য কুরিয়ার করে স্বর্ণের আংটি পাঠিয়েছে। প্যাকেটের গায়ে স্পষ্ট লিখা, কুরিয়ার সহ আংটির দাম ‘পাঁচ হাজার নয়শত পঞ্চাশ টাকা মাত্র।’
মানুষী অবাক হয়ে ভাবলো, সাদিফ তার থেকে পঞ্চাশ টাকা বেশি নিয়েছে!
.
.
.
চলবে........................................................................