"আপনি শিওর আমি গাড়িতে যেতে পারবো?"
"জ্বি, প্রিন্সেস। বসে পড়ুন।"
অনন্যা মৃদু হাসলো, ধীরে ধীরে গাড়ির বাম পাশের সিটে বসে পড়লো। আজ কতদিন পর একসাথে যাচ্ছে দুজনে। কৌশিক স্যারের ও কোনো আপত্তি নেই। লোকটা ধীরে ধীরে কতটা বদলে যাচ্ছে। ভালো লাগছে অনন্যার। কৌশিক এগিয়ে এসে নিঃশব্দে বেল্ট লাগিয়ে দিলো। সেই মূহূর্তে অনন্যা টের পেলো, তার শ্বাস ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠেছে। ভেতরটায় ধুকপুকানি বেড়েছে।
কৌশিক একটু ঝুঁকে অন্যার ওড়নাটা ঠিক করে দিতে লাগলো, স্যারের আঙুলের হালকা ছোঁয়া গলায় পড়তেই একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল অনন্যার মেরুদণ্ড বেয়ে। কৌশিক আচমকা ফিসফিসিয়ে বললো,
"আজ একটু অন্যরকম লাগছে।"
অনন্যা ভ্রু কুঁচকে চোখ তুললো, "অন্যরকম? প্রতিদিন তো এভাবেই যাই আমি।"
"উঁহু!"
কৌশিক অনন্যার চুলগুলো আলতো করে কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বললো,
"আমি খেয়াল করেছি, তোমায় একেক দিন একেক রকম লাগে।"
অনন্যা চোখ বড় বড় করে তাকালো, "হু?"
কৌশিক হেসে ফিসফিসালো,
"হুম। জ্বালা বাড়িয়ে দিয়েছো আমার। এজন্যই প্রতিদিন নতুনভাবে আদর করতে হবে আমায়।"
অনন্যা ফিক করে হেসে ফেললো, কৌশিক স্যারের চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
"যাক ভালো হয়েছে অন্য কারো দিকে তাকানোর ফুরসৎ ও পাবেন না।"
"ইয়াহ! আই থিংক উই শ্যুড কিস!"
কৌশিকের এই ঝড় ঝটপট উত্তরে অনন্যার চোখ খানিকটা কাঁপলো। এই উত্তর তো কখনোই কল্পনা করেনি অনন্যা। কৌশিক সময় ও দিলো না তাকে। আচমকা কাছে এগিয়ে তার শুষ্ক ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠ চেপে ধরলো। উষ্ণতায় ঘিরে গেলো মুহূর্তটা, দুজনের শ্বাস একসাথে গতি হারালো, আবার অস্থির হয়ে উঠলো। হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর কৌশিক ধীরে সরে এলো, ওষ্ঠ সিক্ত হয়ে আছে তার। অনন্যা মাথা নিচু করে শ্বাস নিচ্ছে। মেয়েটার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অশান্তি এখনো দোলা দিচ্ছে, মনে হচ্ছে এখনো কিছু অপূর্ণ রয়ে গেছে। মূহুর্তটা আরো একটু দীর্ঘ হলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যেতো?? কিন্তু লোকটাকে কে বোঝাবে?
অনন্যা একটু সময় নিলো। ততক্ষণে কৌশিক গাড়ির দিকে মনোযোগ দিয়েছে। অনন্যা দ্রুত কাছে এগিয়ে কৌশিকের পোশাকের কলার টেনে ধরলো। কাছে ঝুঁকে এলো কৌশিক।
"কী?"
ফুটলো কৌশিকের কণ্ঠ হতে।
চোখে একরাশ আকুলতা নিয়ে অনন্যা আবেদন করে বসলো,
"আরেকটু!"
দুজনে খুব কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে! কৌশিক কিছুক্ষণ অনন্যার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে আনলো তারপর, মুখটা একটু ঝুঁকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
"আই স্যুয়ার, আমি ছাড়তাম না তোমাকে। বাট দেরি হয়ে যাচ্ছে, প্রিন্সেস।"
অনন্যা তার শ্যামল মুখখানি আরো কিছু সামনে এগিয়ে আনলো।
"দেরি হলে হোক!"
কৌশিক অনন্যার মুখশ্রীতে দৃষ্টি বুলালো, উত্তর দিলো,
"বকা খাবে।"
"খেলে খাবো। আপতত আমি আপনাতে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছি।"
কৌশিক মাথা নামিয়ে নিঃশব্দে হাসলো। তারপর মুখ তুলে অনন্যার গলার কাছে আলতোভাবে হাত রাখলো, গভীর স্বরে বললো,
"Then endure the pain, dear!"
একই ভঙ্গিতে হাত রেখে সে ধীরে ধীরে অনন্যার ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠ মিশিয়ে দিলো। ভালোবাসার এক নিঃশব্দ কাব্য রচিত হলো সেই চুম্বনে। অনন্যা চোখ বন্ধ করে কৌশিকের মাঝে বিলীন হয়ে যেতে লাগলো।
অনেকক্ষণ পর কৌশিক ধীরে ধীরে অনন্যাকে ছেড়ে দিয়ে ফিসফিসালো,
"ডু ইউ নো আমি তোমাকে কখনই বেবি দিতে পারবো না?"
অনন্যার চোখ ধীরে ধীরে খুলে গেলো। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। চোখের পাতাগুলো কেঁপে উঠলো সামান্য। তারপর নিচু গলায় বললো,
"আচ্ছা।"
কৌশিক নেশালো কণ্ঠে উচ্চারণ করলো, "আর ইউ ওকে উইথ দ্যাট?"
অনন্যা এক মুহূর্ত ভাবলো। বাচ্চা বিষয়ক চিন্তা ভাবনা এখনো তার মাথাতেই আসেনি। তাই খানিক লজ্জা পেলো সে। কিন্তু কে জানতো এই লোকটার মাথায় হঠাৎ এমন প্রশ্ন এসে ভীড় করবে। অনন্যা প্রশ্নের ভীড় ফাঁকা করলো। নিঃশব্দে মাথা নাড়ালো, "হুম।"
কৌশিকের দৃষ্টি আরও গভীর, আরও নেশাতুর হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে ঝুঁকে আবারও অনন্যার ওষ্ঠ চেপে ধরলো। বুঝিয়ে দিলো এই মুহূর্তের বাইরে আর কিছুই নেই।
কৌশিকের মন আপাতত অন্য এক জগতে পৌঁছে গেছে। এমন একটি জায়গা, যেখানে ভালোবাসা শ্রদ্ধার রূপ নেয়। সেই চুম্বনে সমস্ত অনুভূতি ঢেলে দিলো কৌশিক, অনন্যাকে বোঝানোর জন্য আর কোনো শব্দের প্রয়োজন রইলো না। অনন্যা শ্বাস আটকে কৌশিকের শার্ট শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো, যেন এই উষ্ণতাটুকু কখনো হারিয়ে না যায়। তার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে কৌশিকের মাঝে মিলিয়ে যেতে লাগলো। ভালোবাসার এই পরশেই তার সমগ্র সত্তা লীন হয়ে যেতে লাগলো।
*********
"আজকাল অনন্যাকে বেশ ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে। কী চলছে জানো কিছু?"
আরণ্যক বাদামের খোসা ছাড়িয়ে মুখে ফেললো। পাশে দাঁড়ানো নোহারার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বললো, "তুমি তো জানো, বলো তো!"
নোহারা বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। বিরক্ত মুখে বললো,
"এটা আমাকে না জিজ্ঞেস করে সরাসরি অনন্যাকে জিজ্ঞেস করো।"
আরণ্যক ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। "ঠিকমতো উত্তর দাও, নোহারা। নাহলে তোমার সেই বিখ্যাত ভিডিওটা ভাইরাল করে দেব!"
নোহারা বিরক্তের সাথে বললো,
"চুপ থাকেন ভাই।এসব আউল ফাউল কথায় আমি আটকাচ্ছি না।"
আরণ্যক বাঁকা হেসে এক হাতে পকেট থেকে ফোন বের করলো। আঙুল চালিয়ে কিছু একটা খুঁজে বের করে নোহারার সামনে ধরলো। নোহারা কপাল কুঁচকে ফোনটা টেনে নিলো। কয়েক সেকেন্ড দেখতেই তার চোখ বড় হয়ে গেলো। ভিডিওতে সে আর নিক সেই হাসপাতালের রুমে। যদিও অতোটা স্পষ্ট ভিডিও নয়। দুজনে বসে কথা বলছিলো এতো টুকুই দৃশ্যমান হয়েছে কিন্তু তারপরও এটা তো কেউ জানে না।
নোহারার কপাল ঘেমে গেলো। তাড়াহুড়ো করে ভিডিওটা ডিলিট করে মুখে বিজয়ী হাসি ঝুলিয়ে বললো, "নেই ভিডিও, নেই কোনো প্রমাণ!"
আরণ্যক ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
"দুঃখিত, নোহারা। ভিডিওটা আমার আরেকটা ফোনেও আছে।"
নোহারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করলো।
"অনন্যা আরেকটা টিউশনি নিয়েছে, তাই ব্যস্ত থাকে। আর জানোই তো, কৌশিক স্যার ওর হাসবেন্ন্ড। তাঁর সাথেই তো সময় কাটাবে!"
"এই স্যারের এতো টাকা-পয়সা থাকতে অনন্যা আবার টিউশনি করতে যায় কেন?"
নোহারা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বললো, "এটা ওদের ব্যাপার। আমি কী করে জানবো?"
আরণ্যক কাঁধ ঝাঁকিয়ে উল্টো ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে বললো, "ঠিক আছে, ঠিক আছে। বাড়ি যা।"
নোহারা মুখ গম্ভীর করে বললো, "ভাইয়া! ভিডিও ডিলিট করে দিও কিন্তু।"
আরণ্যক একপাশে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বললো, "না, করবো না।"
নোহারা চিৎকার করে উঠলো ভাইয়া বলে! আরণ্যক হাত নাড়িয়ে বললো,
"সব সত্যি সত্যি বললে চিন্তা করবে ভিডিও ডিলেট ডান।"
নোহারা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হলো যেন মাথার ভেতর তোলপাড় চলছে। তারপর বিরক্ত মুখে কটা গালি দিয়ে ঘুরে নিজের বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো।
আরণ্যক ধীর পায়ে এগোতে থাকলো। আঁকাবাঁকা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবনার স্রোতে ডুবে গেলো। বাইকটা ভার্সিটির পার্কিংয়ে! থাক পড়ে থাকুক সেখানে। আজ একটু হাঁটতে ইচ্ছে করছে। হাঁটা তো খারাপ কিছু নয়।বরং আজ মনে হচ্ছে, এরকম হাঁটাই দরকার ছিল।ব্যাগটা শক্ত করে ধরে এগোতে লাগলো সে। অনন্যার ব্যাপারটা প্রকাশ্যে আসার পর অনেকেই প্রথমে অনন্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আরণ্যক যখন নিজ হাতে সবটা সামলাতে শুরু করলো, নিশ্চিত করলো যে কেউ যেন অনন্যার কোনো ক্ষতি না করতে পারে, তখনই পুরো পরিস্থিতি বদলে গেল। এখন ভার্সিটিতে তার শত্রুর অভাব নেই। আরণ্যক ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তুললো। এদের জন্য কত কিছু করেছে সে! একসময় বিপদে আপদে ছুটে গিয়েছিল, কারও পাশে দাঁড়াতে গিয়ে নিজের সময়, নিজের বন্ধুত্ব, নিজের সুখ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছে। অথচ একটামাত্র ভুলের জন্য আজ সবাই দূরে সরে গেছে, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এটাই মানুষ।
আরণ্যক হঠাৎই জোরে হেসে উঠলো। বিকালের হালকা বাতাস চুল এলোমেলো করে দিলেও, সে গা করলো না। তার বাড়ি এখান থেকে অনেক দূরে! তবু হাঁটতে ভালো লাগছে। মাঝেমধ্যে এই ভালো লাগাগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া দরকার। অনন্যাকেও ভালো লাগে, সেই ভালো লাগাটাকেও প্রশ্রয় দেয় সে। কিন্তু সে মেয়েটাকে চায় না, কাছে পেতে চায় না, নিজের বলে দাবি করতে চায় না। শুধু চায়, অনন্যা যেন ভালো থাকে। এই বিষয়টা সে প্রতি মূহুর্তে নিশ্চিত করতে চায়। অনন্যা যেখানেই থাকুক, যেমনই থাকুক, শুধু ভালো থাকুক। তার শ্যামল মুখখানিতে সুন্দর হাসিটুকু যেন আজীবন ঝুলে থাকুক।
এই জনমে না হয় আরণ্যক অনন্যার কিছুই না থাকুক। এই পৃথিবীতে না হয় অনন্যার উপর তার এক ফোঁটাও অধিকার না থাকুক। কিন্তু অন্য কোনো মহাবিশ্বে? যেখানে শুধু কল্পনার বসবাস, যেখানে বাস্তবতার নিষ্ঠুর ছোঁয়া নেই, সেখানে অনন্যা শুধু তার থাকুক। এই চাওয়ায় কি ক্ষতি আছে? আরণ্যক হেসে মাথা নেড়ে বললো,
"স্বয়ং বিধাতাই এর উত্তর দিতে পারবে।"
ধীরে ধীরে ধরণীতে সন্ধ্যার ছোঁয়া লেগেছে। আকাশের গাঢ় নীল রঙে মিশে যাচ্ছে কমলা আভা। মহাসড়কের পাশের ফুটপাতে আরণ্যক ধীরপায়ে হাঁটছে। বাতাসে নিরবতা বিরাজ করছে, মানুষের কোলাহল কমে এসেছে, শুধু দূরে গাড়ির হর্নের শব্দ মাঝেমধ্যে কানে আসে।
অনেকটা পথ পেরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎই সে খেয়াল করলো, তার পাশ দিয়ে একটা দামি গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে পাত্তা দিলো না আরণ্যক। কিন্তু একটু পরই বুঝলো, এই উপেক্ষা করাটা ভুল হতে পারে। সে খেয়াল করলো গাড়ির জানালার ওপাশ থেকে একজন মেয়ে বারবার তাকেই ইশারা করছে। আরণ্যক থামলো, ভ্রু কুঁচকে মাথায় সন্দেহের ছায়া নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। মেয়েটিকে দেখে প্রথমেই একটা কথাই মাথায় এলো! " শহরের বড়লোক ঘরের মেয়ে।" উজ্জ্বল ব্রাউনিশ কার্লি চুল, চোখের চারপাশে নিখুঁত আইলাইনার, ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙ, চেহারাজুড়ে সাজের ভার। স্টাইলিশ, আত্মবিশ্বাসী মুখশ্রী, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মেয়েটা বাংলাদেশি নয়। অন্তত দূর থেকেও তা স্পষ্ট বুঝতে পেরে গেছে সে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আরণ্যকের সাথে কীই বা দরকার? কেন মেয়েটা ডাকছে তাকে? সন্দেহের বেড়াজাল গলায় কাঁটার মতো বিঁধলো।
আরণ্যক মেয়েটার ডাকে সায় দিল। মেয়েটি গাড়ি থামালো। জানালার কাঁচ সম্পূর্ণ নামিয়ে ফেললো। আরণ্যক সামনে পৌঁছুতেই বললো,
"গাড়িতে বসো।"
আরণ্যক দ্রুত একটা প্রশ্ন করার জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়লো। মুখটা মাত্র খুললো সে। কিন্তু তার পূর্বেই মেয়েটা বললো,
"যা কথা হবে সব গাড়িতে হবে, মিস্টার। ওপাশের সিটে এসে বসুন।"
আরণ্যক চিন্তিত দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মাথার ভেতর একগাদা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সেসব মাথায় রেখেই ও আস্তে আস্তে গাড়ির বিপরীত দিকের সিটে গিয়ে বসতে উদ্যত হলো। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায় সে সবে সিটে বসার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই মেয়েটা গাড়ির এক্সিলারেটর এমন বেগে চাপলো যে আরণ্যক ঠিকভাবে বসতেও পারলো না।গাড়ির ঝাঁকুনি সামান্য সামলে নেওয়ার আগেই মেয়েটা একহাতে তার সিটবেল্ট টেনে লাগিয়ে দিলো, দক্ষ হাতে সবটা করলো দেখে মনে হলো বহুবার এমনটা করেছে! আবার অন্য হাতে স্টিয়ারিং ধরে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে ড্রাইভ করতে লাগলো। তার এই কর্মকাণ্ড দেখে মনে হলো এ এক সাধারণ কাজ তার জন্য।
আরণ্যক একদম স্তম্ভিত হয়ে গেলো। ইনি মানুষ, নাকি অন্যকিছু? তার মাথায় একটা ধাক্কা লাগলো। তাও আবার মেয়ে! দেখতে তো বয়স পঁচিশের আশেপাশেই মনে হচ্ছে। কিন্তু তেজ এবং অভিজ্ঞ বেশ! এক হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং সামলাচ্ছে, আরেক হাতে তার সিটবেল্ট ঠিক করে দিয়েছে এতো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। এই দৃশ্যটা বাস্তব না নাটকের নিখুঁত কোনো চিত্রনাট্য, বুঝতে পারছে না আরণ্যক। তার শ্বাস ভারী হয়ে এলো। চারপাশের গাড়ির আলো ঝাপসা লাগতে শুরু করলো, কিন্তু মেয়েটা একটুও বিচলিত নয়। গভীর, আত্মবিশ্বাসী চোখে শুধু সামনে তাকিয়ে আছে।
পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেছে, অথচ মেয়েটি এখন পর্যন্ত কোনো শব্দ করেনি। আরণ্যক পাশে তাকানোর সাহস পাচ্ছিল না। তাকালেই হয়তো কিছু ভয়ংকর দেখে ফেলবে মনে হলো। গাড়ির দরজার হাতল শক্ত করে ধরে রাখলো সে।
অবশেষে মেয়েটি ঠান্ডা কণ্ঠে ইংরেজিতে বললো,
"আরণ্যক! অনন্যার এক্স বয়ফ্রেন্ড, তাই তো?"
স্রেফ একটি নাম অনন্যা। কিন্তু নামটা কানে আসতেই আরণ্যকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। বুকের ভেতর শীতল একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো। কোনো ঝড় আসার পূর্বাভাস পেয়ে গেছে বলে মনে হলো তার।
গাড়ির পাশটা শক্ত করে ধরে উত্তর দিলো,
"অনন্যার কি হয়েছে?"
আরণ্যকের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো। মেয়েটার ঠান্ডা, কাঠখোট্টা কণ্ঠে একটা শীতলতা লুকিয়ে ছিল যা আরণ্যকের ভিতরে একটুখানি কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে গেলো।
"কিছু হয়নি। কিন্তু দ্রুতই হতে যাচ্ছে।"
এই কথাটার গভীরতা বুঝতে গিয়েও আরণ্যকের বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়ে গেলো। অনন্যার নামটা শুনেই শরীরটা শিরশির করে উঠেছে, আর এখন মেয়েটার ধীর, নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বলা এই কথা আরও ভয়াবহ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
"মানে?"
মেয়েটা এবার একটু হেসে বললো,
"আমি ভেনোরা!"
গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জনটা হঠাৎ আরও তীব্র মনে হলো। গাড়িটাকেও এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সাক্ষী মনে হলো আরণ্যকের কাছে।
ভেনোরা! নামটা এখনো আরণ্যকের মাথার ভেতর ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে কাউকে চেনে না এই নামে। তবু, মেয়েটার আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি বলছে, সে ঠিকই চেনে না কিন্তু চেনা উচিত। যেহেতু অনন্যা জড়িয়ে আছে এই প্রসঙ্গে, তো চিনতেই হয়।
ভেনোরা গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা পার্কিং লটে এসে থামালো। আরণ্যক চারপাশে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলো। জায়গাটা একদম অচেনা। মনেই হচ্ছে অনেক দূরে এসে পৌঁছেছে তারা।
ভেনোরা গাড়ি থামাতে না থামাতেই বললো,
"অনন্যার হাসবেন্ড ওর ক্ষতি করবে। তাই তুমি ওকে আটকাবে।"
আরণ্যক চমকে উঠলো, প্রথমে বড় করে শ্বাস নিয়ে বাতাসে ছাড়লো। কঠিন স্বরে বললো,
"আগে আপনি কে সেটাই জানতে চাচ্ছি।"
ভেনোরা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুললো। সেটা কি তাচ্ছিল্যের হাসি ছিল? নাকি কেবলই উপভোগের? আরণ্যক বুঝতে পারলো না। মেয়েটির চোখের দৃষ্টি দীপ্তি ছড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে সে সবকিছু জানে।
ভেনোরা বললো,
"আমি আমার প্রিয়জনের ভালো চাই। এটাই আমি। আমার দায়িত্ব, কর্তব্য হলো আমার প্রিয়দের রক্ষা করা। দ্যাটস এনাফ টু নো এবাউট মি!"
ভেনোরা স্টিয়ারিংয়ে আঙুল বুলিয়ে ধীর স্বরে আবারো বললো,
"আর নিজের ভালোবাসাকে রক্ষা করা তোমার একান্ত দায়িত্ব। আমি জানি তুমি তা পারবে।"
আরণ্যক গভীর দৃষ্টিতে ভেনোরার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখে দ্বিধা, মনে অস্থিরতা ভরপুর। মাথায় আপাতত কিছুই ঢুকছে না। আচমকা কেউ এসে এসব বললে মাথায় কিছু না ঢোকাই স্বাভাবিক।
সে মাথা চুলকে বললো,
"কিন্তু…!"
ভেনোরা হাত সজোরে স্টিয়ারিংয়ে রাখলো। হর্ণের আওয়াজ হলো কিছুটা। ভেনোরা বিরক্তের সাথে বললো,
"কিন্তু কিছুই না। কৌশিক বাইরে থেকে যেমনই লাগুক না কেন, ভেতরে সে এক ভয়ঙ্কর মানুষ। একবার তার ফাঁদে কেউ পড়লে বাঁচার উপায় থাকে না। অনন্যাও পারবে না। তুমি যদি কিছু না করো, তাহলে ওকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।"
আরণ্যক গভীর শ্বাস ফেললো। বুকের ভেতর অস্থির ঝড় ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছে।
"তুমি কি সত্যিই ওকে ভালোবাসো?"
ভেনোরার এই প্রশ্ন শুনে আরণ্যকের হৃদয় কাঁপল। গুণে গুণে এক মিনিট চুপ করে থাকলো সে। উত্তরটা সহজ হওয়ার কথা, কিন্তু আসলে নয়। হ্যাঁ বললেই বলা যায় কিন্তু তাতে কি সবটা মিটে যায়? অনন্যাকে তো সে আর নিজের করে চায় না। শুধু চায়, সে যেন ভালো থাকে। কিন্তু আজ সেই ভালো থাকার ওপরই যদি কালো ছায়া নেমে আসে?
আরণ্যক শক্ত কণ্ঠে বললো,
"কিন্তু আমি কে? ওর স্বামী আছে, নিজের জীবন আছে। আমি কেনো ওর ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করবো?"
ভেনোরা হালকা হাসলো। তার মুখমণ্ডল দেখে বোঝা গেল আরণ্যক থেকে এই উত্তর সে আগেই অনুমান করে রেখেছিল। ভেনোরা চোখ সরু করে বললো,
"তুমি যদি না করো, তাহলে আর কেউ করবে না। অনন্যা ধ্বংস হয়ে যাবে, আর তুমি স্রেফ দাঁড়িয়ে দেখবে?"
আরণ্যকের মুঠো শক্ত হলো। আচমকা ভেতরে ভেতরে জ্বলন্ত আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। ভেনোরা মুচকি হাসলো। সে তো শুধু কৌশিককে রক্ষা করতে চায়। সেটা শুধু মাত্র অনন্যাকে কৌশিকের কাছ থেকে দূরে রাখতে পারলেই করা সম্ভব। আর সেটা করার জন্য যা যা করতে হয় করবে ভেনোরা।
******
অনন্যা বাসায় যাওয়ার পথে গাড়িতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। দুটো টিউশনি শেষ করে শরীর ছিল একেবারে ক্লান্ত। ছাত্রের বাসার বাইরে এসে দেখলো কৌশিক স্যার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অনন্যা প্রথমে খেয়াল করেনি, আশেপাশে রিকশা খুঁজছিলো। কিন্তু চোখ দুটো সেই আকাশের মতো তীক্ষ্ণ মণিতে ঠিকই আটকে পড়লো। অনন্যা তাও কতক্ষণ দাঁড়িয়েই রইল। ভাবতেই পারেনি স্যার এখানেও এসে পড়বে। একটু অবাক হয়েই এগিয়ে গেলো সে। কৌশিক হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে ছিল। তার শরীরে সেই নিত্যদিনের ফ্যাশনেবল ভারী পোশাক পরা। অনন্যা কাছে পৌঁছানোর পর কৌশিক তাকে গাড়িতে বসতে সাহায্য করলো। তারপর অনন্যার জন্য একটা কেক হাতে তুলে দিলো। অনন্যা মুচকি হেসে কেকটা খুলে খেতে শুরু করলো। কেক খাওয়ার পর সিটে মাথা হেলিয়ে সে বসেছিল। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো, খেয়ালই করেনি সে। ঘুম থেকে সজাগ হলে চোখ মেলতেই দেখলো, গাড়ি এখনও চলছে। পাশ দিয়ে কৌশিক স্যার শান্তভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। অনন্যা ফোন অন করে সময় দেখে নিলো মধ্যরাত চলছে। এতক্ষণে বাসায় পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো তারা রাস্তায়। কেনো? অনন্যার চোখের কোণে অস্বস্তি জমতে শুরু করলো।
"আমরা কোথায় যাচ্ছি স্যার?"
অনন্যা চোখে আঙুল বুলিয়ে নিচু কণ্ঠে জানতে চাইলো।কৌশিক স্যার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ রাস্তায় চোখ রেখেছে। অনন্যা ঠোঁট উল্টে ফেললো। বাইরে চোখ ফেলতেই চোখ কুঁচকে এলো তার। এ কোন স্থানে যাচ্ছে তারা?
.
.
.
চলবে......................................................................