মন কেমনের দিন - পর্ব ০৯ - ঈশানুর তাসমিয়া মীরা - ধারাবাহিক গল্প


পেঁচার ডাক যে এমন বিচ্ছিরি কিসিমের হয় সাদিফের তা জানা ছিল না। ছাদে আসার পর থেকেই কোথাকার কোন পেঁচা বিরতিহীন ডাকে অস্থির করে তুলছে নিস্তব্ধ আঁধারিয়া আশপাশ। সাদিফের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটছে। দু'তিন বার মেসেজের জন্য টাইপ করেও কাটতে হচ্ছে আবার। মন মতো হচ্ছে না। কপালের দৃঢ় ভাঁজ ফেলে টাইপ করতে করতেই সাদিফ বলল, ‘পেঁচাটারে থামা বাদল। মন-মেজাজ ভাল্লাগতেছে না।’

সিগারেটে সুখটান দিয়ে নজর তীক্ষ্ণ করল বাদল। গাঢ় অন্ধকারে গাছের ডালে ডালে পেঁচার সন্ধান করল। নাহ্! কালো রঙ ছাড়া অন্যকিছু চোখে আসছে না। বাদল বড় হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘পেঁচারে দেখলেই কি আর না দেখলেই কি? আমি কি ওইটারে ধরতে পারমু?’

সাদিফ জবাব দিলো না। ব্যস্ত হয়ে মানুষীকে লম্বা একখানা মেসেজ পাঠালো। অপেক্ষা করলো। অথচ মেয়েটা দেখছে না। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে গেলেও মেসেজের পাশের টিকচিহ্ন দুটো নীল হয়ে উঠছে না। মানুষী কি তাকে এড়িয়ে চলছে? চলতেই পারে। মেয়েটা আজকাল প্রায়ই সাদিফকে দেখেও দেখে না। ক্ষীণ রূঢ়, ক্ষীণ বিষাদ নিয়ে তাকায়। বিরক্ত কণ্ঠে কথা বলে। এত অপ্রিয় হয়ে গেছে সে মানুষীর কাছে?

শীতের রাত। খোলা ছাদে মশার উপদ্রব বেশি। ভনভন ডাক কানে তালা তুলে। গায়ে কি অসহনীয় ভাবে কামড়াচ্ছে! বাদল আর সহ্য করতে পারলো না। পায়ের অগণিত কামড়ের ব্যথা আত্মচিৎকার হয়ে বেড়িয়ে এলো, ‘কিরে বাল! এই রাতের বেলা ছাদে কি তোর? ছাদেই দাঁড়াইতে হইবো ক্যান? ঘরে চল না বাপ! আর পারতেছি না।’

‘যাবো। আর একটু।’

ঠিক এই এক কথা সাদিফ না হলেও এ নিয়ে পাঁচ বার বলেছে। বাদল শুনতে শুনতে ত্যক্ত, বিরক্ত। এখন তো সিগারেটের মতো মধুর ধোঁয়াটাও তার তেঁত লাগছে। পায়ে, পিঠে মশা কামড়ে কিচ্ছু রাখেনি। বাদলের রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ। সবাই গরুর রক্ত বলে ভীষণ খেপায়। মশাদের নাকি গরুর রক্ত পছন্দের একটা সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার আছে। আধখাওয়া সিগারেটটা সাদিফকে দিয়ে বাদল চোখ-মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করল, ‘কি হইছে তোর? এমন লাগাইছোস ক্যান? বিয়ার কথা উঠছে দেইখা ভূত চাপছে মাথায়?’

সাদিফ জবাব নিতে সময় নেয়। বাদলের বাড়িয়ে রাখা সিগারেট-টা ঠোঁটে ছুঁয়ে নিরাশ কণ্ঠে বলে, ‘ও আমারে আর ভালা পায় না, বাদল।’

বাদলের কুঁচকানো ভ্রুদ্বয় আরেকটু কুঁচকে যায়, ‘ক্যাডা? মানুষী?’

‘হু।’

‘এক্কেরে ভালা হইছে। মাইয়াটারে অনেক কষ্ট দিছিস তুই।’

কথাটা যেন আশ্চর্য করে তুললো সাদিফকে। আশ্চর্য হয়েই তাকালো বাদলের দিকে।
‘ও তখন বাচ্চা ছিল, বাদল! বাচ্চা মেয়েছেলের সাথে কে প্রেম করে?’

‘মানুষী এখনো বাচ্চাই আছে । তখনো তোদের বয়সের পার্থক্য চার ছিল। এখনো তা-ই।’

সূক্ষ্ণ খোঁচাটা বুঝতে পেরে কটমট চোখে তাকালো সাদিফ। বলল, ‘ও ক্লাস টেনে পড়তো। সামনে এস.এস.সি দিবে। এ বয়সে জেনেবুঝে আমি কেন প্রেম করতে যাবো? তাছাড়া তখন আমি ওকে ওই নজরে দেখতাম না।’

‘তাই বলে চড়-থাপ্পড় মারবি? ঠিক করে বুঝালেই হতো।’

‘ওকে আমি ছোট থেকে মেরে বড় করেছি বাদল। চড়-থাপ্পড় মারাটা আপনাআপনি চলে আসে। তাছাড়া তোর মনে হয় ওকে বোঝালে ও বুঝতো? ছোট বয়স, আরও উগ্রে যেত। মানুষী কারো কথা শুনেছে কখনো?’

বিষণ্ণ বাতাস। শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। হুট করে পেঁচার ডাকটাও উধাও। শোনা যাচ্ছে না আর। সাদিফ হাতের সিগারেট শেষ করে আরেকটা ধরালো। বাদল ছিনিয়ে নিলো ওটা। রয়েসয়ে বললো, ‘তাও! তোর বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল। তুই যখন দেখলি ও তোর সাথে অভিমান করেছে, অভিমান ভাঙ্গালি না কেন? কিশোরী মেয়েদের অভিমান গভীর সমুদ্রের মতো, সাদিফ। রহস্য উন্মোচন করে বেঁচে ফিরতে পারলে জয়ী। নয়তো নিশ্চিত মৃত্যু।’

সাদিফ সে কথা জানে। আগে না জানলেও মানুষীকে দেখে বুঝেছে, শিখেছে। মেয়েটা প্রচন্ড অভিমানিনী। অভিমানের বেড়াজালে আটকে থাকতে জানে। অন্যকে সেই অভিমানের তীরে খুবলে খেতে জানে। সাদিফ ছোটখাটো নিশ্বাস ফেলল। বুক চিড়ে। মানুষীকে সে কখনো বোন বোন নজরে দেখেছে কি-না জানা নেই। ওসব আগে কখনো ভেবে দেখা হয়নি। তবে ভালোবেসেছে এইতো, দু'বছর হচ্ছে। ভালোবাসা, ভালো লাগার অনুভূতির সৃষ্ট উৎসও সে কখনো খুঁজে দেখেনি। তারিখ, সময়, দিন, ক্ষণ— তাকে কখনো ভাবায়নি। শুধু জানে, মানুষীর তাকে মনের কথা বলার পর সে গুটি কয়েকবার মেয়েটার কথা ভেবেছে। বিশেষ কোনো চিন্তা মাথায় না এলে শুধু ভেবেছে। এরপর একদিন হঠাৎ খেয়াল করেছে, মানুষীর তাকে এড়িয়ে চলা। অবহেলা করা। সূক্ষ্ণ হলেও বিষয়টা নজর কেড়েছে সাদিফের। সেই সূক্ষ্ণতা ধরতে পেরে সাদিফ চমকেছে, অবাক হয়েছে। অথচ অভিমান ভাঙ্গানোর মতো পদক্ষেপ সে কখনো নেয়নি। এখনো হয়তো নিবে না। তার মনে সে ঠিক। কোনো ভুল করেনি। সাদিফ ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড মেধাবী একজন ছাত্র। সবসময় স্কুলের টপ হয়ে এসেছে। বড় হতে হতে অধ্যাবসায়, সু-শৃঙ্খলার বৈশিষ্ট্য থাকলেও বয়সের দোষও সে পেয়েছিল। বিশাল সংখ্যার বন্ধুবান্ধব নিয়ে দিন এত ব্যস্ত কাটতো যে মেয়েদের দিকে ঠিক করে কখনো তাকানো হয়নি। চোখ পরেনি। পরলেও সে বিশেষ পাত্তা দেয়নি। দশম শ্রেণীতে অবশ্য একটা মেয়েকে পছন্দ হয়েছিল। তার এক ব্যাচ জুনিয়র। প্রপোজ করতেই মেয়েটা রিজেক্ট করে দেয়। এইতো, এটুকুই। বিষয়টা সাদিফের কাছে এতটা নরমালাইজড মনে হয়েছিল যে, মানুষীর ক্ষেত্রেও তা নরমাল মনে হবে বলেই তার ধারণা। কিন্তু হয়নি। সাদিফের ধারণার মানুষী হুট করেই পালটে গেছে। সাদিফ চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে এলে এখন আর তার পিছু পিছু ঘুরে না। আবোলতাবোল কথার ঝুড়ি নিয়ে তাকে বিরক্ত করে না।

ভাবনার অকূল পাথারে মোবাইলের দু'সেকেন্ডের রিংটোন ব্যাঘাত ঘটালো। ছাদের জীর্ণ রেলিংয়ে পরে যাবে, পরে যাবে করে রাখা মোবাইলের স্ক্রীনে মানুষীর নামটা ভাসছে। সাদিফ চট করে মোবাইল হাতে নিল। নোটিফিকেশনে ক্লিক করে পড়লো পুরো মেসেজ। পরপর দু'তিনবার। বিস্ময়ের মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো, ‘ওর আমাকে দেখে বমি পায়?’

অস্পষ্ট কথাটা কানে এলেও ঠাহর করতে পারলো না বাদল। কান খাড়া করে জিজ্ঞেস করল, ‘কিয়া? কি বললি?’

রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো সাদিফের, ‘মেসেজ পাঠিয়েছে। আমাকে দেখে মহারাণীর বমি পায়। বুঝতে পারছিস কতটা বেয়াদব হয়েছে ও?’

বাদল হেসে ফেলল, ‘তোর বৈশিষ্ট্য পাইছে। তোর বউ তোর মতো।’

সাদিফ বিরক্ত নজরে তাকালো। বাদল মোটামোটি স্বাস্থ্যের একটা ছেলে। ভরাট মুখ, সরু নাক, ছোট ছোট চোখ। গালে সাদিফের মতো ঘন দাঁড়ি নেই। বয়স বাড়লেও তার দাঁড়ি তেমন উঠে না। বংশগত ভাবে দাঁড়ির গ্রোথ কম। সেই সল্প দাঁড়িতেই আজকালের প্রচলিত একটা কাট দেওয়া। হাসলে ভরাট গালের দু'পাশে স্পষ্ট দুটো গর্ত দেখা যায়। ভদ্র ভাষায়, টোল পরে। যে কেউ হাসিটাকে সুন্দর উপাধি দিলেও সাদিফের তা প্রচন্ড বিশ্রী আর বিদঘুটে লাগলো। ধপধপ পায়ে সে চলে গেল ছাদ ছেড়ে। উদ্দেশ্য, মানুষীর সাথে একচোট ঝগড়া করতে হবে। মেয়েটা পেয়েছে কি? তাকে দেখে বমি পাওয়া? এত সহজ?

অথচ উদ্দেশ্য তার সফল হলো না। ঝগড়ার মনোভাব নিয়ে কথোপকথন শুরু করলেও তা হুট করে মানুষীর বিষণ্ণতায় ঝিমিয়ে গেল। উত্তেজনা হারালো কথায় জিতবার। জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষীর চুলগুলো তখন উড়ছিল। সাদিফ নির্নিমেষ চেয়ে চেয়ে দেখছিল তা। মেয়েটার মলিন চোখ, মুখের অস্থিরতা টের পেয়েও যেন পায়নি। বুঝতে পারেনি মানুষীর আকুলতা। তারপর... তারপর হঠাৎ মেয়েটা বলল, ‘আপনার চেষ্টায় কমতি ছিল, সাদিফ ভাই।’

সাদিফ জানে, কমতি ছিল। আছে। থাকবে। এই কমতি সে কখনো পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু সাদিফ একটু হলেও চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টা দুজনের ইগোকে অবশ্য ছুঁতে পারেনি। ইগোটা বরাবরই এগিয়ে। অথচ কান্না আটকে রাখা নাজুক, কোমলময়ী মানুষীকে দেখে সাদিফ মুহুর্তেই থমকে যায়। ইগোকে পাশে ফেলে 'স্যরি' বলে। 'স্যরি' বলতে গিয়ে গলা শুকোয় তার। অস্থিরতায় চোখ বুজে আসতে চায়। মানুষীর কঠোর মুখাবয়বে একবিন্দু নস্যি অশ্রুর ছুঁতোয় সে হঠাৎ বুঝে ফেলে, মেয়েটা বোধহয় তাকে আর ভালোবাসে না। তাকে বোধহয় আর চায় না। নয়তো আগের মানুষী হয়ে ছুটে আসলো না কেন? তাকে জড়িয়ে ধরলো না কেন? অমানিশার কালো রাত্রির ন্যায় অভিমানের অভিশাপ নিমিষেই গায়ে লেগে গেল সাদিফের। কানে চুপিচুপি কেউ বলল, ‘হায়রে পাগল, মানুষী বুঝি তোরে আর ভালা পাইলো না।’

••••••••••••••••

অভিমানিনীর অভিমানে এই প্রথমবার হৃদয়ে কুৎসিত জীর্ণতার আভাস পেল সাদিফ। কুঁকড়ে উঠল। ঘরের দোর পেরিয়ে বাহিরে বেরুবার ইচ্ছে হলো না তার। নাস্তা খেতে তাই যাওয়াও হলো না। দুপুর হতেই ছুটে বেড়িয়ে গেল নিরুদ্দেশ হতে। ক্লান্ত শরীর টেনে টেনে ফিরলো দুপুরের শেষভাগে। বাদল তখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তার মস্ত বড় ঘুম দোষ আছে। একবার ঘুমালে পৃথিবী উলটে গেলেও ঘুম ভাঙ্গে না। সে ঘুম থেকে উঠবে নিজ ইচ্ছায়। কারো ডাকাডাকিতে বাদলের চোখ খোলার সাধ্যি নেই।
শীত, তবুও পরনের শার্ট থেকে কেমন পানসে গন্ধ ছাড়ছে। সে খোলা মাঠের দূর্বাঘাসে অনেক্ষণ শুয়ে ছিল। একা একা আকাশ দেখছিল বিবস নয়নে। সেখান থেকেই এই অচেনা গন্ধের উৎপত্তি নয়তো? শীতের কনকনে পানিতে সাদিফ আরেকদফা গোসল করলো। ঘন চুলের মাঝে তোয়ালে চালানোর মুহুর্তে ঘরে চনমনে পায়ে হাজির হলো রঞ্জন। কৃষ্ণও আছে সাথে। রঞ্জনের হাতে ভাতের সফেদ প্লেট। কৃষ্ণ কোকাকোলার ১ লিটারি বোতলে ঠান্ডা, গরম খাওয়ার পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রঞ্জন খিটখিটে গলায় বলল, ‘ভাত না খেয়ে কোথায় গিয়েছিলি? তোর বউ হয়ে আমাকে এখন তোকে ভাত বেড়ে দিতে হবে? অপেক্ষা করতে হবে মহাশয় কখন আসবেন?’

রঞ্জন সবার বড় হলেও তার মাঝে বড়দের কোনো ভাব নেই। তাদের পরিবারে হঠাৎ কেউ মিশলে ভাববে, রঞ্জন সবার ছোট। কিন্তু সময়ে সময়ে ছেলেটার ব্যক্তিত্বের দারুণ পরিবর্তন ঘটে। বিপদের সময় হুট করে বড় হয়ে সবার পাশে দাঁড়ানোর অকৃত্রিম ক্ষমতাও ছেলেটার আছে।
সাদিফ একটু হেসে বলল, ‘মাকে পাঠাতি। তোরা এলি কেন?’

কৃষ্ণ উত্তর দিল, ‘বিকেলে যে আমরা বিয়াত যামু, তা ভুইলা গেছ মনু? চাচি রেস্ট নিতেছে। তোমারে খাওনের দায়িত্ব মোদের।’

সাদিফ বলল, ‘কখন যাবি তোরা?’

রঞ্জন ভ্রু কুঁচকায়। প্রশ্ন করে, ‘কখন যাবি তোরা মানে কি? তুই যাবি না?’

‘নাহ্। আমি রাতে চট্টগ্রাম ফিরে যাবো। এখানে আর ভালো লাগছে না।’

রঞ্জন প্রথমেই কিছু বলল না। হাতের প্লেট-টা ড্রেসিংটেবিলের একপাশে রাখলো। সাদিফের কাঁধে ভরসার হাত রেখে বলল, ‘মানুষীও বিয়েতে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে ওর সাথে কথা বল। ভুলবোঝাবুঝি সব সট্ আউট কর, সাদিফ। বাড়িতে তোদের বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে। ব্যাপারটা নিশ্চই তোর কাছে ছেলেখেলা না?’

সাদিফ উত্তর দিতে সময় নিল, ‘ও সত্যি যাবে?’

‘হ্যাঁ। তুই বরং রেস্ট নিয়ে রেডি হ। আধঘণ্টার ভেতর বেড়োবো।’

রঞ্জনের বাজে স্বভাব আছে। সে আস্তে কথা বলতে পারে না। বললে জোড় গলায় বলবে। পারলে চিল্লিয়ে বলবে। তার অতি ধীরে বলা কথাটাও পুরো ঘর কাঁপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সেই রঞ্জনের কাঁপাকাঁপি ধরণের কথা শুনেও বাদলের ঘুম ভাঙ্গেনি। বরং নাক ডাকার বিশ্রী শব্দে রঞ্জনই অতি মাত্রায় বিরক্ত। যাওয়ার পূর্বে কৃষ্ণ নাক কুঁচকে বলল, ‘এই ছেড়া কি এইহানে ঘুমাইতে আইছে, সাদিফ ভাই? এই আওয়াজে ঘুমায় কেমনে?’

••••••••••••••••

রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা পড়েছিল সাদিফ। সোনার তরী। কবিতার সারমর্ম ছিল অনেকটা এমন, আমরা সারাটা জীবন যে সফলতার পিছু ছুটি সেটা হয়তো একদিন ধরা পরে। কিন্তু আমাদের জীবনের সফলতা দুর্বার হলেও জীবন ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যু সেখানে অনিবার্য। সোনার নৌকায় আমাদের কর্মফলগুলো আজীবন উজ্জ্বল তারার ন্যায় জ্বলজ্বল করলেও আমদের সেখানে ঠাই নেই। কথায় আছে, কর্ম মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু সেই কর্ম ছাড়া গোটা মানুষের এই সোনার নৌকায় জায়গার বড় অভাব। সে পরে রয়, একলা, পরিত্যাক্ত নদীর তীরে।

'সোনার তরী' কবিতার দুটো লাইন সাদিফের হঠাৎ মনে পরে গেল,

‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা। 
কুলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।’

গুণগুণ করে লাইনগুলো পড়তে পড়তে আকাশপানে চেয়ে সাদিফ দেখলো, ঠিকঠিক শীতের দুয়ারে বরষার আগাম পদচারণ আনুষ্ঠিকতায় মেতেছে। গগনে মৃদু গর্জন। দূর থেকে ভেসে আসছে অশান্ত পাখিদের কিচিরমিচির। তা যেন একটু একটু করে সাদিফকেও অশান্ত করে তুললো। বিয়ের অনুষ্ঠানে কোথাও মানুষী নেই। মেয়েটা আসেনি। সাদিফের জন্যই কি? এত অভিমান? ঘৃণা? সাদিফের বুকে অচিরে পাথর জমলো। বিয়ের অনুষ্ঠান, পরিবার সবাইকে ফেলে বাড়িতে চলে এলো সে। বাইক থেকে নামতে নামতে বাদলকে বলল, ‘আমি মানুষীর সঙ্গে দেখা করে আসছি। তুই বরাবর পনেরো মিনিটের মাথায় হর্ণ বাজাবি। আমি চলে আসবো।’ যেতে যেতে অবাক বাদলকে ফের বলল, ‘আমরা এখনই চট্টগ্রাম ফিরবো, বাদল। তোর যা যা আছে এক্ষুণি রুম থেকে নিয়ে আয়।’

মানুষী তখন মাত্র মাত্র তার আটপৌরে বদনে লাল সুতীর শাড়ি জড়িয়েছে। সদা উদাস হয়ে থাকা মুখটা আজও মলিন। তবুও গোপনে লুকিয়ে রাখা এক টুকরো সৌন্দর্য চোখ ঝলসে দিলো সাদিফের। পুরুষ মন লহমায় থমকালো, চমকালো, বিমূঢ়তায় পা জোড়া মেঝেতে স্থির হয়ে গেল তার। বা'পাশটায় ব্যথা হচ্ছে। চিনচিনে, সূক্ষ্ণ ব্যথা। মানুষী তখনো সাদিফকে খেয়াল করেনি। খোপা করা চুল খুলে দেওয়ার পূর্বে আকাশের গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠে মেয়েটা। তারচেয়েও বেশি চমকায় সাদিফকে দেখে। চোখে কি অল্পসল্প ভয় উঁকি দিলো? বিস্ময়ের রেশে প্রাণপ্রিয়ার মুখ আরেকটু কঠিন হলো? হলো বোধহয়। 

ক্ষোপে ক্ষুব্ধ হওয়া মন নিমিষেই মিইয়ে গেল। ধুলোয় মিশে গুণগুণিয়ে বলল, ‘মেয়েটাকে একবার জড়িয়ে ধর, সাদিফ। যদি কখনো আর সুযোগ না হয়?’
সাদিফ মনের কথা শুনে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষীকে বিস্ময়ের অতল গভীরে ঠেলে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে বুকের বা'পাশটায়। ঠিক যেখানে তার অসহ্য লাগছে। ঠিক যেখানটা মানুষীকে করুণ সুরে ডাকছে। অথচ... অথচ কঠিন হৃদয়া মানুষী যেন সাদিফের হাহাকার শুনেও শুনলো না। ইস্পাতের ন্যায় শক্ত হয়ে পরে রইলো সাদিফের বুকে, মনে। মেয়েটার টলমলে চোখ, কঠিন মুখে একটুখানি বেদনার ছাপ যেন সাদিফকে বলল, ‘কেন এসেছেন? কেন কষ্ট বাড়াচ্ছেন?’

সাদিফ উত্তর দিতে পারে না। কণ্ঠ কাঁপে। চোখ জ্বলে। ছেলেরা কাঁদে না। সুপুরুষেরা কাঁদে না। একটা মেয়ের জন্য তো নয়ই। অভিযোগ করে বলে, হেরে গেছ। তুমি হেরে গেছ। তোমার ভুলগুলো তুমি এখনো ঠিক করতে পারছো না সাদিফ। দ্রুত করো। কিছু বলছো না কেন মেয়েটাকে? সাদিফের উত্তর, সে কথা বলতে পারে না। মনের কথা ঘটা করে বোঝাতে পারে না। তার মনে হয়, ভালোবাসলে ওপর পাশের ব্যক্তিটা নিশ্চিত তার চোখ দেখে সব বুঝে ফেলবে? কিন্তু সাদিফ এটাও জানে না, যেখানে সে নিজে ওপর ব্যক্তির চোখ দেখে কিছু বুঝতে পারে না সেখানে ওপর ব্যক্তি থেকে এই আশা করা নিছক কৌতুক।
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp