প্রেমান্বেষা - পর্ব ৪০ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


স্মরণের প্রশ্নে নীলিমার প্রত্যুত্তরের পূর্বেই মাহবুব সবার সামনেই টিপ্পনী কেটে বললো,
" এখন থেকেই বউয়ের জন্য দেওয়ানা! না জানি সামনে কি হবে!"

মাহবুবের কথায় মহল হালকা হলো। সবাই হাসাহাসি করলো স্মরণ ও নীলিমাকে নিয়ে। কিন্তু স্মরণ হাসলো না। সে নীলিমার পানে চেয়ে বিমুগ্ধ গলায় বললো,
" সামান্য শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করায় যদি বউয়ের দেওয়ানা খেতাব পাই তাহলে হ্যাঁ, আমি বউয়ের দেওয়ানা। আমি নীলিমার দেওয়ানা। "

স্মরণের এ কথা বলতে দেরি তবে রুমে 'ওহ হো' ধ্বনি সৃষ্টি হতে দেরি হলো না৷ বাহাদুর শেখ তো শোয়া অবস্থায়ই দুর্বল হাসি দিয়ে বললেন,
" দেখতাছো দিল তোমার নাতির কান্ড? বিয়ার সময় ঘণ্টাও গড়াইলো না আর বেশরমের মতোন ক্যামনে আমার নাতনিডারে লজ্জা দিতেছে।"

নীলিমা এতক্ষণ লজ্জায় মুচকি হাসছিলো। কিন্তু এবার নানার কথায় লজ্জায় যেনো লজ্জাবতী পাতার ন্যায় নুয়ে পড়লো। স্মরণও কিছু বললো না। একটু-আধটু সে-ও লজ্জা পেয়েছে, তবে অপ্রকাশ্যে।

রাতে বাধলো আরেক ঝামেলা। বাড়ির বড়রা বলছে স্মরণ ও নীলিমাকে আজ রাতে একসাথে থাকতে দিবেন না তারা। তাদের কথা, রিসিপশনের পর দুজন একসাথে থাকবে। কিন্তু বাড়ির ছোটরা অর্থাৎ কাজিন পার্টির প্রত্যেকে বড়দের এই মতের বিরুদ্ধে। তাদের কথা হলো, বিয়ে যেহেতু হয়েছে সেহেতু একত্রে রাত কাটাতে সমস্যা কোথায়। শেষে এই বাকবিতণ্ডার অবসান ঘটালো স্মরণ নিজে। গলার স্বর উঁচিয়ে ধমকে উঠে বললো,
" দু পক্ষের ঝগড়া এখানেই থামাও। কেননা আমার বউয়ের সাথে রাত কাটাবো আমি। সো সিদ্ধান্তটা আমারই হবে। আর আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আজ রাতে আমি আর নীলিমা একসাথে থাকবো। এখন এই টপিক এখানেই ক্লোজ। "

স্মরণের ঠোঁটকাটা কথায় উপস্থিত সকলে বিস্ময়ে হতভম্ব হলো। সকলেই কিছুক্ষণ হা হয়ে রইলো।।নীলিমা তো পারে না লজ্জায় মাটি খুঁড়ে ভেতরে ঢুকে যেতে। স্মরণে মা, চাচি, ফুপু দুজন পড়লো ভীষণ লজ্জায়। আনিস সাহেবও ছেলের হেন কথায় তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। অতঃপর পরিস্থিতি এড়াতে ফোনকলের অজুহাতে সেখান থেকে কেটে পড়েন তিনি৷ 
সবার এই লজ্জায় লাল হওয়া দেখে স্মরণ ভ্রু কুঁচকে স্বাভাবিক কণ্ঠেই শুধালো,
" কি ব্যাপার? সবাই এত লজ্জা পাচ্ছো কেনো? তোমরা যেমন টাইপের তর্ক করছিলে তেমন টাইপেরই উত্তর পেয়েছো। আর বিয়ের পর জামাই বউ তো একসাথেই থাকবে। আমাদের আলাদা রাখতে চাচ্ছো কেনো মা চাচিগণ?"

নাজমা বেগম এবার লজ্জায় বললেন,
" মুখে একটু লাগাম দে বাছা। বিয়ে হয়েছে বলে বেশরমের ট্যাগ পেয়ে গিয়েছিস নাকি?"

স্মরণ এ প্রশ্নের উত্তরে দাঁত কেলিয়ে বললো,
" একটু বেশরম না হলে বাচ্চা পয়দা করবো কিভাবে। তুমি দাদি আর ফুপি নানিই বা হবে কি করে!"

নাহ, স্মরণে বেফাঁস কথাবার্তায় এখানে টিকে থাকা দায় হয়ে যাচ্ছে। দু গালে হাত ছুঁয়ে তওবা পড়তে পড়তে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। রাতের খাবারের জন্য ভাত বসাতে হবে। মিলি বেগমও ভাতিজার এহেন কথায় চুপচাপ 'আস্তাগফিরুল্লাহ' পড়তে পড়তে কেটে পড়লেন৷ সবাই লজ্জা পেলেও আসমানী বেগম তো ভীষণ খুশি হলেন। নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
" একদম তর দাদার মতো হইছোস স্মরণ। তর দাদাও হঠাৎ-মটাৎ এমন কথা কইতো। শরমে আমি টিকতে পারতাম না। "
বলেই তিনি আরেক হাত নীলিমার মাথার উপর রেখে প্রাণ খুলে দোয়া করে চলে গেলেন নিজের রুমে। বাহাদুর শেখ ঘুমাচ্ছেন। তার শারীরিক অবস্থা পূর্বের তুলনায় খানিকটা উন্নত। হয়তো বেঁচে থাকার স্পৃহা সৃষ্টি হয়েছে তার মনে!

ড্রইংরুমে এখন কাজিন মহলের সব ক'টা সদস্য উপস্থিত, ব্যতিত রাফি, পাখি, মানতাসা ও তার স্বামী ফাহাদ। স্মরণ ও নীলিমার বিয়ের পরে দুপুরের খাবার খেয়েই মানতাসা শ্বশুরবাড়ি ফেরত গিয়েছে। দাদার শারীরিক অবস্থার কথা শুনে ঈদের সামনের কাজ ফেলে ছুটে এসেছিলো সে। ওদিকে তার শাশুড়ীরও জ্বর। একারণেই দায়িত্বের মূল ভাগ এসে পড়েছে তার কাঁধে। এরপর ঈদের দিন একেবারে কোরবানির দায়দায়িত্ব মিটিয়ে তবেই এখানে আসবে সে। 

স্মরণ ও নীলিমা পাশাপাশি সোফায় বসে আছে। এতক্ষণে তারা রুমে চলে যেতো। কিন্তু রাফা আর সাদের ছবি তোলার অনুরোধে তারা এখনও বসে আছে। বিয়ের পরপরই দিনের আলোয় পুকুরপাড় ও বাগানের ওদিকে গিয়ে বেশ ছবি তোলা হয়েছে। কিন্তু এতেও রাফা ও সাদের মন ভরেনি। রাফার ভাষ্যমতে, স্মরণ ও নীলিমাকে আজ বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর লাগছে, একসাথে মানাচ্ছে। রিসেপশনের দিন যদি এতোটা সুন্দর না লাগে তবে!
ছবি তোলা শেষে মাহবুব ক্র্যাচে ভর দিয়ে এগিয়ে এলো স্মরণের দিকে। স্মরণের পিঠে হাত চাপড়ে বাহবা দিয়ে বললো,
" আরে বাহ! আমাদের স্মরণ বাবাজি দেখি বাসরের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে৷ মুখে নেই কোনো লাগাম। কোথায় গেলো সেই আলাভোলা স্মরণ যে নীলিমাকে পাওয়ার জন্য পীর সেজে বসে ছিলো? "

স্মরণ সরু চোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অতঃপর মেকি হাই তোলার ভান করে বেশ আয়েশি গলায় বললো,
" মা, বাপ, চাচা,ফুপাদের ভাগানোর জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু আর মাথায় আসেনি। "

মাহবুব আরোও যোগ করলো,
" বিয়ের পরপরই দ্যা গ্রেট লুচ্চা স্মরণের অভিষেক হয়ে গেলো তাহলে!"
মাহবুবের সাথে এবার যোগ দিলো সাজিদও। বললো,
" তোমার রূপ দেখি গিরগিটির চেয়েও খারাপ স্মরণ! ইশ, আমার নীলিমার জন্য চিন্তা হচ্ছে, শালি সাহেবা আমার কত লুচ্চা একটা বর পেলো।"
বলেই সে নীলিমার দিকে কৃত্রিম আফসোসের চাহনিতে চাইলো। নীলিমার তখন একই সাথে রাগ ও লজ্জায় মিশ্রিত অনুভব হলো। সে পারে না এখনই বাঁশ দিয়ে স্মরণের মাথায় বাড়ি মারতে। হতচ্ছাড়া স্মরণের জন্য সেই দুপুর থেকে লজ্জা পেয়ে পেয়ে ক্লান্ত সে। 

নীলিমা ও স্মরণকে বাসরঘরে পাঠানো হলো। যদিও রুমের সাজসজ্জা খুব একটা জানান দিচ্ছে না যে এটা বাসর ঘর। সময় ও ফুলের অভাবে কাজিন মহল চেয়েও বাসর ঘর সাজাতে পারেনি। তাই সাধারণ রুমকেই বাসরঘর হিসেবে সাজাতে মাত্র কয়েকটা মোমবাতি ব্যবহার করেছে তারা।

নীলিমাকে রুমে বসিয়ে নওরীন ও রাফা বেরিয়ে গেলো। তারা রুম থেকে বেরোনো মাত্র স্মরণ তাদের মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো। তবে দরজা বন্ধ করার পূর্বে নীলিমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ইচ্ছে করে নওরীন ও রাফাকে বললো,
" তোমরা আমাকে লুচ্চা উপাধি দিয়েছো। এখন দেখো তোমাদের বোনের সাথে কি কি করি আমি৷ হা হা হা হা।"
বলেই সে মেকি হাসি দিলো। নওরীন তাকে অবশ্য পাত্তা দিলো না। তার কথাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললো,
" দেখা যাবে তোমার পারফরম্যান্স কত রেটিং পায়, হা হা হা হা। "
বলে সে-ও স্মরণের মতো হাসলো৷ স্মরণ সরু চোখে চেয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিলো৷ অতঃপর নীলিমার দিকে অগ্রসর হবার জন্য দু কদম বাড়ালো। তৃতীয় কদমে নীলিমা খোদ সামনে এগিয়ে আচমকা স্মরণের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে ক্রোধান্বিত চাহনিতে চাইলো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
" এখন পারফরম্যান্স দেখাবেন তাই তো? খবরদার, এ মুহূর্তে আমাকে একটুখানি স্পর্শ করলেই ঠ্যাঙ ভেঙে একদম গলায় ঝুলিয়ে দিবো। লুচ্চা বুইড়া একটা। "
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp