নীলাম্বরে রৌদ্দুরের হাতছানি - পর্ব ০৭ - বেলা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


-"তোর তার ছেঁড়া ভাইকে দেখে তো আমি নওরিজ মাহবুব খানের হাঁটু কাঁপা কাঁপি অবস্থা সুরেলা। এই শফি এখনি ফিট না খাই! যা তো অ্যাম্বুলেন্স ডেকে নিয়ে আয়।"

সাথে সাথেই হাসির রোল পড়ে; ছোটু, মারিয়া সহ নওরিজের সাথে আসা লোকজন। শুধু দু'জনের মুখে হাসি নেই। সুরেলার চোখে মুখে চিনচিনে রাগের ছবি। সম্মুখের বলিষ্ঠ মানবের চোখে মুখ গাম্ভীর্যে ঠাসা। সুরেলাকে রাগে ফুঁসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,

-" সমস্যা কি তোর? ও সম্মান প্রদর্শন করে দুলাভাই ডাকতেই পারে। এখানে তোর রেগে যাওয়ার কারণ দেখছি না তো। ও শুধু তোকেই আপা ডাকে? ওর আর কোনো বোন নেই?"

সুরেলা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে। সম্মুখে দন্ডায়মান মানবকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শফির উদ্দেশ্যে বলে,

-" শফি, জলদি চল? বৃষ্টি নামবার পারে আবারও। শাপলারে রাখতে আইছিলি?"

শফি ভদ্র ছেলের মতো মাথা সায় জানালো। সুরেলা হাঁটা দেয় বান্ধবীর হাত ধরে। শফিও চুপচাপ পিছু হেঁটে যায়। স্বল্প দূরত্বে ছোট্ট কালি মন্দিরের আড়ালে লুকায়িত মানব বাঁকা হাসে। চোখে মুখে তাঁর পৈশাচিক আনন্দ উপচেপড়া। খেলায় তো মজা এখন হবে।

নওরিজ ক্ষণপল ছোট ছোট চোখে চায়। হুট করেই লম্বা লম্বা পা ফেলে সুরেলাদের পাশে হাঁটে। গাম্ভীর্য ভাবটা বজায় রেখে বলে,

-" শফি, ফকিন্নীর ঝিয়ের আবার কি...."

সুরেলার ধারালো চাহনিতে থেমে যায় নওরিজ মাহবুব। বাঘিনী ক্ষেপে গেল বুঝি? সুরেলা শক্ত চোয়াল রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে,

-" অন্যকে ছোট করে খুব আনন্দ পাওয়া যায় তাই না রিজ ভাই?"

নওরিজ মাহবুব সুক্ষ্ম নজরে পরখ করে মানবীকে। চেহারায় গুমট ভাব দেখে বলে,

-" মজা করে বলি..."

-" হ্যাঁ মজা করে বলেন। সেই মজায় সামনের ব্যাক্তি কষ্ট পেলো কি আনন্দ তাতে ভ্রুক্ষেপ নাই। এ কেমন মজা রিজ ভাই?"

হুট করেই যেন আবহাওয়া বদলে গেলো। ঝিরিঝিরি বর্ষণে প্রকৃতি মাতোয়ারা। দমকা হাওয়ায় রাস্তার ধারের গাছের পানি বৃষ্টির ফোঁটার মতো পতিত হয়। নওরিজ শান্ত চোখে তাকিয়ে। সুরেলা হেসে বলে,

-" ছোট বেলা থেকেই মায়ের সাথে আপনাদের বাড়ি যাওয়া আসা করি। কখনো মনে হয় নাই আপনার পরিবারের কেউ মানুষ ভাবছে; এক রওশন ভাই ছাড়া। অবুঝ আমি তবুও যেতাম। আমাদের তো ছোট্ট ছনের ঘর ছিলো কিন্তু ওই বাড়িটা একদম রাজপ্রাসাদের মতো ছিলো। মায়ের রূপকথার গল্পের ছোঁয়া পেতাম সেখানে। রাজা রাজপুত্তুর আভিজাত্যের ছোঁয়া। তারপর একদিন ভ্রম ভেঙ্গে গেল। শুনুন নওরিজ মাহবুব আরেকবার ওই সম্বোধন করলে আপনার থোবড়া আমি আস্ত রাখবো না।"

নওরিজ মাহবুব শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে নিষ্পলক। চেয়ে দেখে রাগে অগ্নিশর্মা রমনীর গমন পথ। পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে ঘার একটু বাঁকা করে করে আপন মনে বিড়বিড় করে,

-" সুরেলা সালেহ, তুই শুধু আমার হয়ে দেখ! তোর বলতে কিছুই রাখবো না। আগা ট্যু গোড়া সব এই নওরিজ মাহবুব খানের।"

••••••••

বৃষ্টির দরুণ খোদ্দেরদের দেখা নেই গ্যারেজে। একলা সিনান সালেহ টেবিলে কনুই ঠেস রেখে উদাস মনে বসে আছে। দমকা হাওয়ায় গা'টা শিন শিন করে। একটা উষ্ণতায় মোড়ানো চাদর হলে মন্দ হতো না। নয়তো এক উষ্ণ বৃষ্টি বিমুখ কুহেলী। তাঁর মিষ্টি আলিঙ্গনে আবদ্ধ হতো সিনান সালেহ। তার গায়ের নেশালু ঘ্রাণে ডুবে যেত তৃষ্ণাতুর পাগল মন। গা টা তৎক্ষণাৎ ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। উটকো ভাবনাকে গা ছাড়া দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেল দেয়। এই বৃষ্টিময় মুহূর্তে শয়তানে ক্যান লা*ড়া দেয় বা*ল! সে গ্যারেজ বন্ধ করে দেয়। চামের জুতো জোড়া হাতে তুলে একটা বড় পলিতে মাথা পিঠ ঢেকে বের হয়। ফাঁকা দোকানে মশার চুমু খাওয়ার মানেই হয় না। তারচেয়ে ভালো বাড়ি গিয়ে জব্বর ঘুম দেওয়া যাবে। মা'কে বলবে খিচুড়ি বসাতে। আমের আচার দিয়ে জমিয়ে খাওয়া যাবে। বাড়ির পথ ধরলেও একটু গিয়ে কি মনে করে গন্তব্য স্থল পাল্টে নেয়।

চেয়ারম্যানের বাড়ির পেছনে একটা আড্ডাখানা আছে। সেখানে বসে তাস খেলছে চেয়ারম্যানের কিছু লোক। তাদের মাঝে বেশ কিছু টাকা রাখা আছে। বোঝাই যাচ্ছে জুয়া খেলতে বসেছে। একটা বাঁশের তৈরি ঝুড়ি গ্রাম বাংলায় যাকে টুরি বলা হয়। তাতে মুড়ি আর গুঁড় রাখা। সবাই গুঁড়ের টুকরো সহ মুড়ি মুখে পুরে হাসি মুখে তাস খেলছে। দরজা বিহীন ঘরটার দরজায় আধভেজা সিনান এসে দাঁড়ায়।‌বাবাকে দেখা যাচ্ছে। ভেজা পলিথিন ও জুতো জোড়া রেখে ভেতরে এগিয়ে যায়। ভেতরে ঢুকতে সবার আগে নজরকাড়ে পাটের ছালার উপর রাখা টাকা গুলোর উপর। তারপর বাবার উপর যার সম্পূর্ণ মনোযোগ তাসের কার্ডে। সালেহউদ্দিনদের পাশে বসা কালাম সিনানকে খেয়াল করে। সালেহউদ্দিনের কনুইয়ে গুঁতো মেরে সিনানের উদ্দেশ্য বলে,

-" আরে সিন যে! আয় বয়। এক পাঠ খেলে যা। বেশি না একশ টাকা রাখবি। জিতলে হাজার টাকা পাবি ভাইস্ত্যা।"

সালেহউদ্দিন ছেলের দিকে তাকায়। একটা কার্ড সম্মুখে ফেলে বলে,

-" ও এসব খেলে নাকি? বাজান দু'শো টাকা দে তো! সব টাকা জলে গেছে। মহিরের থাইকা দু'শো কর্জ করলাম। ওরেই দিমু।"

সজ্ঞানে মিথ্যে বলছে তা সিনানরে বুঝতে বাকি থাকে না। সে পকেট হাতরে দেখে পঞ্চাশ টাকার নোট ছাড়া কিছুই নেই। সে এসেছিল বাবার থেকে একশটাকা নিয়ে মহিষের মাংস কিনে বাড়ি ফিরবে। বৃষ্টির দিন হওয়ায় দামটা কম যাচ্ছে। সে পঞ্চাশ টাকা বাবার হাতে ধরিয়ে বেরিয়ে আসে দোজখ খানা থেকে। নিজের উপরই হাসি পায়; চিনচিনে রাগ হয় নিজের উপরই। শা*লার অতি মাত্রায় সুখে ভরপুর একটা জীবন যাপন করছে। 

••••••••••••••

বিছানায় দু পা মেলে বসে আছে ছবি। কোলের উপর মিষ্টির প্লেট। একটা একটা মিষ্টি মুখে পুরে খাচ্ছে মনে সুখে। ছামিনা বেগম মেয়ের পাশে এসে বসলো। উঁচু পেটে হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করে।

-" নড়েচড়ে?"

মুচকি হেসে মাথা নাড়লো এবি। মাঝে মাঝে নড়ে। তবে খুবই অল্প। ছামিনা বেগম মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেও হাসে। 

-" জামাই আসলো না কেন? রেখে তো যেতে পারতো। আজ নওরিন আর বড় জামাই না গেলে একা পাঠাতে পারতো?"

-" তখন রেখে যেতো। আপুরা যাওয়ায় সুবিধা হয়েছে আসতে হলো না। বলেছে কিছু দিন পর এসে নিয়ে যাবে।"

 -" সে কি! বড় জামাই কিছু বলে নি? একেবারে ডেলিভারীর পর পাঠাবো আমরা।"

মায়ের কথায় ছবি মুচকি হাসলো। পানি খেয়ে প্লেটটা কোলের উপর থেকে সরিয়ে রাখে। মায়ের আঁচলে মুখ মুছে ঘ্রাণ শুঁকে। আহা! কেমন আপন আপন সুবাস। যেন জান্নাত। 

-" বলেছিলো। উনিও ওনার সীদ্ধান্ত জানিয়েছেন।"

ছামিনা বেগমের মুখখানা মলিন হয়ে আসে। ভেবেছিলেন মেয়েকে অনেক দিন কাছে পাবেন। বিয়ের তিনবছর অথচ সব মিলিয়ে পাঁচবার, এবার নিয়ে ছ'বার হবে মেয়ে বাপের বাড়ি এলো। এসেও লম্বা সময় থাকে তা মোটেই নয়। মেয়ে জামাই মেয়েকে সাথে নিয়ে আসবে, নিয়ে যাবে। রেখে গেলেও খুব বেশি দু'দিন। প্রথম প্রথম খুশি হতেন তিনি। জামাই মেয়েকে চোখে হারান। ধীরে ধীরে অবশ্য তাঁর ভাবনা মলিন হয়। মেয়ের উদাসীন চোখে যে বিষন্ন রাতের হাতছানি দেয়। 

-" আমিও পাঠাচ্ছি না আমার মেয়েকে। সে জামাই যতই ঘার ত্যাড়ামো করুক।"

ছবি কিছু বলে না প্রত্যুত্তরে। মুচকি হেসে মায়ের বুকে মাথা রাখে। তখনি রূপসার আগমন। মাথার দুই বেনীতে রঙিন ফিতে বেঁধে হেলেদুলে আসে। এক বেনী পিছনে ঠেলে কিশোরী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,

-" ছবি আপু, রিজ ভাই এসেছে। ডাকে তোমাকে। তোমার ভাবী বাচ্চার জন্য ইয়া বড় দোলনা এনেছে। জলদি আসো?"

কথা শেষ করে অপেক্ষা করে না। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই ছুটে গেলো। ছবি সোজা হয়ে বসে। বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে,

-" চাচি রিজ ভাইয়ের জন্য রূপকে নিবে তাই না? যদিও রিজ ভাইয়ের বয়সটা বেশি হয়ে যাবে রূপসার জন্য। তবে ভালোই হবে। এক মেয়ে চোখের সামনে থাকবে তোমার। আর রিজ ভাই একটু গম্ভীর রাগী হলেও মনটা খুব নরম। রূপকে রানি বানিয়ে রাখবে।"

ছামিনা বেগমের মুখটা গম্ভীর হয়ে আসে। মেয়ের হাত ধরে বলে,

-" একবার ভুল করেছি বারবার না। রিজ যথেষ্ট ভালো ছেলে আমি স্বীকার করতে বাধ্য। তবে ভাবী? অহংকারে মহিলার মাটিতে পা পড়ে না। এখন ভালোবাসা দেখাচ্ছে পরে চোখের বালি হবে না তাঁর গ্যারান্টি কি? নিজেদের মধ্যে কিছু বলতেও পারবো না। আর ভাবী শিক্ষিত ছেলে বউকে পছন্দ করবেন না। আমি এক মেয়ের পড়াশোনায় খিল দিয়েছি, আরেকজনের দিবো না। জামাই কিন্তু বলেছিল বিয়ের পরও পড়াবে তোকে। শেষে কি হলো? মায়ের বুদ্ধিতে তোর পড়াশোনা জলে ভেসে গেছে। আমি হলফ করে বলতে পারি তোরা মিয়া বিবির মাঝে কাঁটা তোর শাশুড়ি। সাদমানের অতিরিক্ত মা ভক্তি.."

-" মা, আমাদের মাঝে শাশুড়ি কাঁটা নয়। না আমাদের কোনো ঝামেলা আছে। তুমি প্লিজ এসব ব্যাপারে কথা বলবে না। বললে এবাড়িতে আসতে আমার আরো ভাবতে হবে।"

মা'কে থামিয়ে শক্ত গলায় বলে। আস্তে ধীরে হেঁটে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। বসার ঘরে যেতেই দেখা মেলে নওরিজ মাহবুবের। সাথে সুন্দর কারুকাজে খচিত কাঠের দোলনা। বেশ নজরকাড়া। ছবিকে দেখেই নওরিজ উঠে দাঁড়ালো। ছবির মাথায় টোকা মেরে বলে,

-" মুটকি হয়ে গেছিস ছবি! কতবার বলেছি জামাইয়ের মাথা কম করে খা। কিন্তু তুই তো কানেই নিস না আমার কথা।"

-" আর তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছো রিজ ভাই। নওরিন আপু ছোট তোমার। তাঁর কত বড় বড় দু'টো বাচ্চা। আমিও একটা ডাউনলোড করবো ইনশাআল্লাহ। আর তুমি এখনো আইবুড়ো হয়ে ঘুরছো। লজ্জা করে না?"

মাথা ডলতে ডলতে বলে ছবি। নওরিজের কপালে এবার বিরক্তের রেখা ফুটে ওঠে। কিছু বলবে ইকরাম উল্লাহ শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে। নওরিজের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-" সম্বন্ধি বাবু একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ সালাহ্ দিই মন দিয়ে শোনো। একজন মানুষ টক পছন্দ করুক আর না করুক, দেখে জিভে পানি জমবেই। লোভ করে যখন টক স্বাদের কিছু মুখে নিবে মুখ বিকৃত হবেই কিন্তু? বিয়েও তেমনিই একটা বিষয়।"

-" ভুল বললেন দুলাভাই। বিয়ের তুলনা শুধু টকের সাথে দিলে ভুল হবে। বিয়ে মানে টক ঝাল মিষ্টি। কখনো টক খেতে লাগবে তো কখনো ঝাল আবার শেষ পাতে মিষ্টি অনুভূতি।"

রওশনের কথায় সবাই দরজার দিকে তাকায়। দুই হাত দুই ভাগ্নে ভাগ্নির দখলে। নওরিন বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,

-" তুই এতো জ্ঞান বিলাচ্ছিস। লুকিয়ে চুরিয়ে দুই তিনটা বিয়ে করে নিয়েছিস নাকি?"

রওশন হেসে এগিয়ে রূপসার পাশে এসে সোফায় বসে বলে,

-" একটাই করাচ্ছো না তিন চারটা! সব দোষ রিজ ভাইয়ের । না নিজে বিয়ে করছে না আমাকে করার সুযোগ করে দিচ্ছে। রিজ ভাই এবার তো রহম ফরমাও? ওদিকে আমার না হওয়া বউটা বুড়ি হয়ে যাচ্ছে।"

নওরিজ সোফার হাতলের উপর ঠেস দিয়ে বসে। দুই হাত বুকে গুঁজে গমগমে গলায় বলে,

-" আমার যখন বিয়ে করার মুড হবে সোজা শশুর বাড়ি গিয়ে বউটাকে তুলে নিয়ে আসবো। তোর ব্যাপার তুই বুঝে নে।"

-" হ্যাঁ কাজির মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে কবুল বলবে দু'জন ‌ তারপর দরজায় খিল।"

ইকরাম নওরিজকে চোখ টিপে ধীমান স্বরে বলে। নওরিজ ভ্রু কুঁচকে চায় শুধু। ইকরাম উল্লাহ গলা খাঁকারি দিয়ে আশেপাশে তাকায়, কেউ শুনলো না তো? বাচ্চা দু'টোও এখানেই যে। আবার পিচ্চি একখান শালিকাও আছে। নওরিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

-" শশুর বাড়ি গিয়ে বউ তুলে আনবি। তার মানে পছন্দ আছে নিশ্চয়ই? কে সে?"

সবাই জহুরি নজরে তাকিয়ে নওরিজের পানে। নওরিজ ভাবলেশহীন। তার মাঝে জবাব দেওয়ার কোনো ভাব লক্ষ্য করা গেলো না। তবে এ নিয়ে বেশ ক্ষণ চর্চা চলে। সবাই হুড়মুড়িয়ে পরে তাঁর উপর । পেট থেকে কথা বের করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েও ব্যর্থ হয়। মহারাজ মুখে পুরে কুলুপ এঁটে বসেছেন কি-না। রওশন দোলনা দেখে বলে,

-" বাহ্ সুন্দর তো। কে আনলো?"

-" রিজ এনেছে ছবির বেবির জন্য।"

ছবি এগিয়ে এসে ফাঁকা দোলানায় দোল দিয়ে বলে,

-" বেবির বাবা তৃতীয় মাস চলাকালীন একটা কাঠমিস্ত্রিকে বলে একটা বানিয়ে এনেছে। একটা আছেই আরেকটা দিয়ে কি করবো? রিজ ভাই রেখে দাও। যখন এ বাড়িতে বেবি আসবে এই দোলনায় দোল খাবে। নয়তো রিজ ভাই কোনো কালে বিয়ে করলে তাঁর বাচ্চা কাচ্চা হবে তখন কাজে লাগবে। তা না হলে রওশন ভাই তুমি কাজে লাগিও!"

রিজের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে।

-" এই সাদমানের প্রবলেম টা কি বলতো? ঝি জামাইদের বস্তা পঁচা ভাব থাকবে স্বাভাবিক। বাট তোর জামাই আল্ট্রা লেভেলের। ইকরাম ভাইও তো খান বাড়ির জামাই। তাকে দাওয়াত দিতে দেরি আসতে দেরি নেই। অথচ ওনার একশ একটা বাহানা। আব্বা না বলা পর্যন্ত মহারাজের পা পড়বে না এবাড়িতে।"

-" তোমরাই খুঁজে আনলা। তোমরাই ভালো জানো। কাজ থেকে ফুরসতই মেলে না ওনার। যখন তখন ডাক পড়ে উপর মহল থেকে। রাত নেই দিন নেই। র্যাব বলে কথা। আর রিজ ভাই নিজের দিকেও তাকিও। তোমার ভাব কতটা জানো? একবারও বোনের সংসারে উঁকি দিয়ে এলে না।"

অভিমানী স্বরে বলে ছবি। নওরিজ হামি তুলে উঠে দাঁড়ালো। টাওজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গুনগুন করে চলে যায় বসার ঘর ছেড়ে। এরা হঠাৎ তাঁর বিয়ে নিয়ে পড়লো কেন? এখন এখানে বসে থাকা মানে স্বেচ্ছায় কান ঝালাপালা করে ফেলা।

•••••••••••••

ইংলিশ গ্রামার বই খুলে বসে আছে চুপচাপ বসে আছে সুরেলা। কাল ইংরেজি পরীক্ষা। দুই ঘন্টা যাবত একটা অনুচ্ছেদ মুখস্থ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু হচ্ছে না। মনোযোগ দিতে পারছে না। শেষমেষ বিরক্ত হয়ে বই বন্ধ করে দেয়। বিকেল বেলা অথচ মনে হচ্ছে সন্ধ্যা গড়িয়েছে। বিরামহীন মেঘ বৃষ্টির খেলায় মেতে আঁধারে নিমজ্জিত ধরনী। সুরেলা বই বন্ধ করে বিছানায় উঠে বসলো। কাঠের জানালা খুলে বাইরে বর্ষণের ছন্দপতন দেখে। তাঁর সুরে স্বপ্ন বুনে যায়। শান্তি বেগম কাঁথা সেলাই করছে দরজার কাছটায় বসে। সেখানেই আলোর চ্ছটা আসছে। এরই মাঝে ছেলের আগমনে সে কাঁথা ভাঁজ করে রেখে দেয়। একখানা গামছা ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে লুঙি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলের শান্ত মুখাবয়ব দেখে একটু বিচলিত হয় তবে ভাবান্তর দেখায় না। ছেলের মেজাজ কখন বরফ কখন আগুন বোঝা দায়। সিনান গা গতর মুছে ভেজা প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পড়ে নেয়। ফুল হাতা গেঞ্জি গায়ে ঢুকিয়ে একটু পরপরই হাঁচি দেয়। শান্তি বেগম খেয়াল করে সরিষার তেল আর পেঁয়াজ মরিচ কুঁচি দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে দেয়। বৃষ্টির দিনে খেতে মজা। সুরেলা জানালা বন্ধ করে নিচে নেমে আসে। ভাইয়ের পাশে পাটিতে বসে মুড়িমাখা খায় আর ভাইয়ের শান্ত মুখটা আড়চোখে লক্ষ্য করে যায়। আবছায়া অন্ধকার ঘরে কুপি জ্বালায় শান্তি বেগম। কিন্তু বিধিবাম কেরোসিন তেল ফুরিয়ে এসেছে। এখন উপায়? ঘরে মোমবাতিও নেই তো। তিনি একটা বোতল এনে মেঝেতে রেখে বলে,

-" হেকমতের দোকান মনে হয় না বন্ধ করছে। যা না বাপ একটু তেল নিয়া আয়! ঝড় বাদলার রাত। একফোঁটাও তেল নাই। কারেন্টও আসবো না।"

সিনান খালি বোতলটার দিকে একপল তাকিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়,

-" কয়টাকার আনবো? দে টাকা?"

-" আমার কাছে চাইরানাও নাই বাপ।"

-" তাইলে আন্ধারেই থাক মা। আলো দিয়া কি হইবো? যেইহানে জীবনটাই কুটকুটা আন্ধার।"

তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে বলে সিনান সালেহ। সুরেলা পাশ থেকে মিহি স্বরে বলে,

-" কাল আমার ইংরেজি পরীক্ষা আছে। সকালেই। না পড়লে পরীক্ষায় কি লেখমু?"

সিনান অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিরক্ত মুখে বোতল টা নিলো। তবে বোনের আবদারে মেজাজ অম্বর ছুঁতে সময় নেয় না। সুরেলা অতি সাবধানে দোনামোনা মনে আবদার করে,

-" কয়ডা চানাচুর আইনো। মুড়ি মাখায় দিলে খাইতে মজা লাগবো।"

চিনচিনে রাগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সিনানের। কুপিটা দরজা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে খ্যাক করে বলে ওঠে,

-" তোরা সব কটা মিলা আমার জীবনটা নষ্ট কইরা দিলি। কুত্তার মতো খাইটা দুই পয়সা কামাই করি। কহনো শখ কইরা নিজের জন্য কিছু কিনি নাই। অথচ তোগোরে শখ ফুরায় না। এইটা দাও ওইডা দাও।‌ বাপের কাছে চাইবার পারোস না? আমার কিসের ঠ্যাকা পড়ছে? আমি অনেক করছি আর পারমু না। মাফ কর তোরা।"

ভরা বর্ষণে ভিজে ওই কান্তিমান নয়ন যুগল। নত মুখে বসে আছে পাটিতে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানো প্রচেষ্টায়। সিনান সালেহ বাক্য শেষ করে ছাতি মাথায় বেরিয়ে গেছে। শান্তি বেগম মুখাবয়ব থমথমে। ছেলে চলে যেতেই গর্জে ওঠে মেয়ের উপর,

-" খুশি ওহন? চোখ সবসময়ই আকাশের দিক রাহোস। পরিস্থিতি বুঝস না। কইলোই চার আনাও নাই তাও ওনার চানাচুর খাইতে হইবো। কয় ট্যাহা কামাই করে বাজান? সেই টাকায় সংসার চালান, তোর পড়াশোনার খরচ। আবার তোর ভবঘুরে বাপের পকেট গরম করা।"

সুরেলা মলিন সুতি ওড়নায় গাল মুখ মুছে বলে,

-" আমার জন্যে খরচ করতে মানা করিস তোর বাজানরে। তবে শেষ আবদার একটা বিষের বোতল আইনা দিস, খাইলে তোরা শান্তি পাবি।"

সাথে সাথেই থাপ্পড় পড়ে গালে। সুরেলা কিছু বলে না। আলগোছে উঠে জানালার ধারে বসে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে। এই এক মুহুর্ত যথেষ্ট ছিলো কিশোরীর মনটা তছনছ করে দিতে। সিনান আসে একটু পরেই। কেরোসিনের বোতল ভর্তি, সাথে এক প্যাকেট সাথী চানাচুর। দুটোই মায়ের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে পাশের ঘরে চলে যায়। শান্তি বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই আনবিই যখন তাহলে খেকিয়ে ওঠার কি দরকার ছিলো?

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গরুর জন্য ক্ষ্যার কাটতে বসেছে সিনান। গম্ভীর মুখে ধারালো কাস্তের সাথে প্যাঁচ কেটে টুকরো টুকরো করে পাশে রাখে। ঘর হতে সুরেলার পড়ার শব্দ ভেসে আসে। উনুনে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ। সেই আগুনের তাপে রান্না বসিয়েছে শান্তি বেগম। ভাত হয়েছে এখন মিষ্টি কুমড়ার সাথে শুঁটকি মাছ ভাজছেন। এমন সময় হড়গড় করে বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করে কিছু যুবক। সিনান স্বীয় কাজ অব্যাহত রেখে বলে,

-" এতো ব্যানা ভিক্ষুক দলের আগমন? খয়রাত দিবার পারমু না। আমারেই দিয়া যা তোরা!"

রওশন মুখ কুঁচকে নেয়। সিনানের পেছনে দাঁড়িয়ে তাঁর চুলের গোছা টেনে বলে,

-" শা*লা তোর মুখ নাকি যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ। সবসময় খ্যাক খ্যাক খ্যাক। একটু ভালো ভাবে কথা বলতে পারিস না?"

-" না। জীবনে এতো মিষ্টি যা বলার মতোন না। অতি মিষ্টিতে মুখ মরে গেছে বুঝলি? এখানে কি চাই? দলবল নিয়া আইছোস দেখতেছি!"

রওশন চুল ছেড়ে দিয়ে বাড়ির এ কোণায় ও কোণায় কাউকে খুঁজে বেড়ায়। উনুন পাড়ে শান্তি বেগমকে দেখে সে সহ তাঁর সাথে আগত বন্ধু সাগর, সৌরভ আর ফাহাদ সেখানে গল্পের আসর জমিয়ে ফেলে। সিনান অল্প হেসে জলদি হাত চালায় কাজে। শান্তি বেগম হাঁক ছেড়ে সুরেলাকে ডাকে চেয়ার টুল আনার জন্য। রওশন দরজার দিকে উঁকি দেয়। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত রমনীর দেখা মিলবে। কিন্তু তাঁর বাঁড়া ভাতে ছাই দেয় সিনান। নিজেই টুল চেয়ার এনে দেয় বন্ধুদেরকে। 

-" গরীবের ঘরে সকাল সকাল কি মনে করে এলি সবাই?"

সাগর ভ্রু কুঁচকে বলে,

-" কেন আসতে পারি না? তুই তো ভুলেও যাবি না। তাই আমরাই এলাম। চাচি আম্মার সাথে দেখা করতে তুই ফুট!"

খিটখিটে সিনান মুচকি হাসলো। সোহাগ মাঝখানে টিপ্পনী কেটে বলে,

-" শুনলাম বিয়া সাদি করছোস? ভালা কাম করছোস সিন। বউয়ের নাম বিউটি তাই না?"

সিনান কিছু বলবে তার আগেই ফোড়ন কাটল সৌরভ।

-" যাই বলিস আমি কিন্তু হেব্বি খুশি। তোর যা মেজাজ, ওই বিউটি ছাড়া কেউই জুটতো না। তা মুখ দেখাবি না বিউটি ভাবীর?"

সিনান হামি তুলে বলল,

-" ফাও পেচাল বাদ কাজের কথা ক? কাজ কতদূর গড়াইলো?"

এবার সবাই যেন হাসি মজাকে পাশে রেখে দিলো। সর্বপ্রথম সৌরভ বললো,

-" আমরা সবার সাথেই কথা বললাম সিন। কাল মাস্টার কাকার সাথে দেখা হয়েছিল। সে ভালোই বললো। তবে মন্টু কাকার সাথে কথা বলতে বলল। গ্রামের সব্বাই হেরে মুরুব্বি মানে আর হের দাপট দূর দূরান্ত অবদি। এখন তুই সাথে চল মন্টু কাকার সাথে দেখা করে আসি।"

সিনান সালেহের মুখটা গুরুগম্ভীর। মন্টু চাচার সাথে তাঁর পড়ে না খুব একটা। সম্পর্কটাও এলেবেলে। বাবার মামাতো ভাই হয়। বোনদের বুড়ো আংগুল দেখিয়ে নানার সমুদয় সম্পত্তি ফুঁসলিয়ে নিজের নামে করে নিয়েছে। এর আগেও এ নিয়ে কথাকাটাকাটি হয়েছিল তার সাথে। ভদ্রলোক এমন বেশে চলাফেরা করে যেন ফেরেশতা সে। সে গম্ভীর স্বরে বলে,

-" তোরা যাইয়া কথা ক। আমার কাজ আছে। এমনিতেও হুমুন্দির পোলারে আমার সহ্য হয় না।"

-" তুই না গেলে হবে? এসবের মাথা তুই। আচ্ছা চল তুই চুপ থাকিস। সৌরভ সবটা বলবে নে।"

ফাহাদের কথায় সিনান ভাবনায় পড়ে। কথা একশ ভাগ সত্য। সে না গেলে মন্টু ত্যাড়া বাঁকা বলবে। তাঁর ছোট্ট স্বপ্নে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। সে সায় জানিয়ে সুরেলাকে ডেকে বলে,

-" সুর, চেক শার্ট টা আনতো!"

রওশন গলা খাঁকারি দিয়ে হাসে। সিনান লক্ষ্য করে চোখ রাঙানি দেয়। রওশন তাকে পাত্তাই দিলো না। সুরেলা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। কালো বোরকা হিজাবে রেডি হয়ে বেরিয়েছে। হাতে একটা কাঠের স্কেল আর জ্যামিতি বক্স। অপর হাতের শার্ট ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিল। সিনান শার্টটা গায়ে জড়িয়ে বলে,

-" রেডি হইছোস যে। খাবি না? মা ভাত কতদূর? ভাত জলদি বসাইতে পারোস নাই?"

শান্তি বেগম কড়াইয়ে খুন্তি চালিয়ে বলে,

-" হইছে। সুর যা থাল আন!"

-" দেরি হইছে, খাওয়ার সময় নাই। আমি গেলাম।"

বলেই সুরেলা পা বাড়ায়। সিনান বোনের থমথমে মুখ দেখে আর কিছু বলে না। বিকেলের কথায় নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে। পেলে পেয়েছে। এটুকু কষ্টে কিই বা আসে যায়! রওশন পিছু ডাকে সুরেলাকে,

-" বাব্বাহ সুরেলা! আমাদের চোখে পড়ছে না? না কি তোমাদের বাড়ি এসেছি বলে ইগনোর করছো।"

-" রওশন ভাই, সাগর ভাই, ফাহাদ ভাই, সৌরভ দা? এখন সময় নাই একফোঁটাও। কিছু মনে করো না। দোয়া কইরো ইংরেজি পরীক্ষা আজকে।"

বলেই সুরেলা বেরিয়ে যায়। রওশন নড়েচড়ে বসল। দেখেও যেন দেখা পেল না তাঁর। এই বেদনা কারে বোঝানো যায়। সিনান বড় পায়ে ঘরে ঢুকে। টিনের বাক্স খুলে কাপড়ের ভাঁজ থেকে বিশ টাকার চকচকে নোট বের করে বেরিয়ে আসে। প্রায় দৌড়ে বোনের গমন পথে ছোটে।
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp