মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৬৪ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


কৌশিক রিসেপশনে সব ব্যবস্থা করে মাত্র রুমে ঢুকেছে। দরজা বন্ধ করতেই কানে এলো অনন্যার গলার স্বর। মেয়েটা বাথরুমে নিজের জগতে হারিয়ে গেছে।

গুনগুন করে ইংরেজি একটা গান গাইছে। অনন্যার কণ্ঠে বেশ আনন্দ জড়িয়ে আছে। মেয়েটা খুশি কৌশিক বুঝতে পারছে। পানির ধারা পড়ার শব্দের সঙ্গে মিশে অনন্যার কণ্ঠস্বর আরও মায়াময় হয়ে উঠেছে। কৌশিক হাসলো। মাথা হেলিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। বাইরে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন। ভেজা বাতাসের নরম পরশ, আর অনন্যার মিষ্টি কণ্ঠ মিলেমিশে ঘরের পরিবেশে শান্তি সৃষ্টি করছে।

You and I, I
Ridin' Harleys in Hawaii-i-i
I'm on the back, I'm holdin' tight,
I Want you to take me for a ri-ide, ride
When I hula-hula, hula
So good, you'll take me to the jeweler-jeweler, jeweler
There's pink and purple in the sky-y-y
We're ridin' Harleys in Hawaii-i-i

কৌশিক হেসে ফেললো। মেয়েটার উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে পুরো ঘরজুড়ে। এখানকার বাথরুমগুলো আধুনিক। বেডরুম থেকে দৃশ্যমান। কিন্তু গ্লাসের আবরণ ঘোলাটে। তবু বাথরুমের ভেতরে উপস্থিত মানুষের ছায়া অস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। কৌশিক নিজের সামনে পড়ে থাকা খুচরো চুলগুলো পেছনে সরিয়ে বিছানায় বসলো। একনাগাড়ে তাকিয়ে রইলো সামনের ঘোলাটে কাঁচের দিকে। ভেতরে অনন্যা নিশ্চিন্তে নিজের জগতে ডুবে আছে। হালকা ভিজে চুল দুলছে তার কাঁধে। পানির ধারা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। কৌশিক শুধু ছায়াটুকুই দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সেই ছায়ার মৃদু নড়াচড়া গানের তালে দুলতে থাকা দেহ সব মিলিয়ে সময়টা মোহময় হয়ে উঠেছে। 

কৌশিকের ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। সমুদ্রের নোনাজল এখনো গায়ের কোথাও লেগে আছে কি না সেটা ভাবার চেয়ে অনন্যার ভয় পাওয়া মুখটাই বারবার মনে পড়ছে ওর। প্রথমবার ডুব দেওয়া বলে কথা! পানি ছুঁতেই অনন্যার শরীর কেঁপে উঠেছিল। ডুব দিয়েই আঁকড়ে ধরেছিল কৌশিককে। তারপর যখন সাহস পেয়ে বুঝতে শুরু করলো। তখন পুরোপুরি বালির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেলো মেয়েটা। কৌশিকের হাতটাও ছেড়ে দিয়েছিল। সমুদ্রের পানির সঙ্গে খেলতে খেলতে নিজের দিকে মনোযোগ ই ছিল না। একগাল হাসি আর ভেজা চুলে লেগে থাকা সোনালি বালি নিয়ে উঠে এসেছিল অনন্যা।

কৌশিক আগেই ভেজা পোশাক পাল্টেছে। এখন শুধু অপেক্ষা অনন্যার জন্য। অনন্যার গানের কণ্ঠ আচমকাই থেমে গেলো। কৌশিক বাথরুমের গ্লাস হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কিন্তু কয়েক মিনিট পার হতেই অনন্যার কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেলো।
অনন্যা কৌশিককে ডাকছে।

"শুনছেন? আছেন?"

কৌশিক বিছানা থেকে উঠে এসে বাথরুমের দরজার পাশে দাঁড়ালো। দেয়ালে হেলান দিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
"শুনছি, প্রিন্সেস। বলো!"

ভেতর থেকে একটু ইতস্তত ভঙ্গিতে অনন্যার কণ্ঠ ভেসে এলো,
"আমার তো ড্রেস নেই। ওগুলো নোংরা হয়ে গেছে। এখন কী পরবো আমি?"

কৌশিকের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। আলতোভাবে দরজায় দুই আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে বললো,
"দরজা খোলো।"

মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো। পানির ধারা পড়ার শব্দ মিলিয়ে গেছে। কেবল কৌশিকের কথাগুলো বাষ্পভেজা বাতাসের মধ্যে স্থির হয়ে রইলো।
অনন্যার বুকটা ধুকপুক করছে। সে চমকে উঠে বলল,
"কককেনো?"

"ড্রেস চাইছো। এখন ড্রেস কি উপর থেকে ছুঁড়ে মারবো?"

অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
"হ্যাঁ সেটাই করেন। আমি দরজা খুলতে পারবো না।"

"কেনো? কি প্রবলেম?

"লজ্জা করছে।"

"ওহহো! এতক্ষণ তো লজ্জা লাগছিল না? বাই দ্য ওয়ে, লজ্জা করার মতো কিছু দেখছি না। তোমার সবকিছু সম্পর্কে তো আমি পরিচিতই।"

"ইশশশ! অসভ্য লোক! চুপ থাকেন!"

কৌশিক মৃদু হাসলো। দরজায় টোকা দিলো কয়েকবার। ভেতরে অনন্যা মাথায় হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের অবস্থায় সে আরও বিব্রত বোধ করছে। এখানে একটা বাথরোব থাকলে ভালো হতো! কিন্তু শুধু তোয়ালে রাখা আছে। আগে এসব নিয়ে চিন্তা কেন করলো না? যদিও চিন্তা করার মতো অবস্থাতেও ছিল না।

বাইরে কৌশিক নির্ভার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। আর ভেতরে অনন্যা সংকোচে গুটিয়ে যাচ্ছে। অনন্যা দ্বিধায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। কিন্তু কোনো উপায় না দেখে একসময় বাধ্য হয়ে দরজা একটু ফাঁক করলো। উঁকি দিয়ে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বললো,

"স্যার! আমি তো তোয়ালেতে আছি, তাই চোখ বন্ধ রাখবেন।"

কৌশিক হাসি থামাতে পারলো না। ফিক করে হেসে ফেললো। পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে অসম্ভব রকম মজার লাগছে। কিন্তু অনন্যার মুখের অভিব্যক্তি দেখে নিজেকে ধাতস্থ করলো। হাসি গোপন করে চোখ বন্ধ করলো সে। মুখে গম্ভীর স্বর এনে বললো,
"ঠিক আছে।"

"দিন। ড্রেস কোথায়?"
অনন্যা হাত বাড়িয়ে দিলো। কৌশিক এক হাত দিয়ে অনন্যার হাত ধরলো, অন্য হাত দিয়ে দরজা ধরলো। তারপর ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লো। অনন্যা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কৌশিকের দিকে। কৌশিকের ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। সে অনন্যার হাত ছেড়ে দিয়ে আচমকা নিজের টিশার্ট খুলে ফেললো। চোখ বন্ধ অবস্থায়ই টিশার্টটি পড়িয়ে দিলো অনন্যা কে। অতঃপর চোখ খুলে নিজের হাত অনন্যার কোমড়ে নিয়ে কাছে টেনে নিলো মেয়েটাকে। অনন্যর মাথা কৌশিকের শূণ্য বক্ষের নিচের স্থানে গিয়ে ঠেকলো। সে মৃদু চিৎকার করে সরে যেতে চাইলো। কিন্তু সরতে দিলো না কৌশিক। জাপটে ধরে থাকলো তাকে। অনন্যার শরীরে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু পানি কণা কৌশিকের শরীরে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। অনন্যা ঢোক গিললো। লোকটার হৃদযন্ত্রের আওয়াজ অনন্যার কানে আসছে। ইশশশ! এতো কাছে ! তাও স্যারের উদাম দেহে লেপ্টে আছে সে। কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে অনন্যার।

কৌশিক নিচুতে ঝুঁকে অনন্যার দুই গালে আলতো চুমু খেয়ে বললো,
"আরেকটু আগে ডাকা উচিত ছিল, মিসেস হার্ট! কতকিছু মিস করে গেলাম।"

"হু?"

"একসাথে গান গেতে পারতাম আমরা।"

"আপনি শুনেছেন?"
অনন্যা বিস্মিত হলো।

"কান আছে। তোমাকে শোনার জন্যই আছে।"

অনন্যা হতাশ হলো। কৌশিক কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিলো অনন্যাকে। তারপর অনন্যার গালে হাত রেখে বললো,
"অপেক্ষা করো। ড্রেস কিনে নিয়ে আসছি।"

কৌশিক বাইরে চলে যেতে নিলো। অনন্যা দ্রুত তার হাত ধরে বললো,
"এভাবে যাবেন?"

কৌশিক ঘুরে দাঁড়ালো। অনন্যা স্যারের শরীরের দিকে দৃষ্টি রেখে আবার সরিয়ে নিলো। কৌশিক নিম্ন স্বরে ফিসফিসিয়ে বললো,
"কি আর করবো! "

অনন্যা শক্ত করে হাত ধরলো। যেতে দিতে চায় না লোকটাকে। চোখ নিচে রেখে বললো,
"থাক লাগবে না।"

কৌশিক প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে তাকালো। অনন্যা ধীর পায়ে কাছে আসলো‌। তার চলনে বাথরুমের ফ্লোরে পানির আওয়াজ হলো। অনন্যা তার পায়ের আঙুলে ভর রেখে পা উঁচু করলো। কৌশিকের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
"আমার বরকে এই অবস্থায় অন্য কেউ দেখবে তা আমি কি করে সহ্য করবো। বলুন তো!"

কৌশিক নিচুতে ঝুঁকে অনন্যার নাকে নাক স্পর্শ করে বললো,
"তাহলে এখন কি করা যায় আপনিই বলে দিন।"

অনন্যা কৌশিকের গালে হাত স্পর্শ করে ঠোঁট এগিয়ে দিলো। কৌশিকের সুন্দর হালকা গোলাপি ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেয়ে বললো ,
"কিছু করার দরকার নেই। শুধু আমার সাথে থাকুন।"

"এই একটু আগে কেউ লজ্জা পাচ্ছিলো মনে হলো। কে সেটা ? মিসেস হার্ট, এতো ছোট্ট আক্রমণে আমার কাজ হলো না। আরো বড় বড় আদর চাই।"

কৌশিক আচমকা অনন্যাকে কোলে তুলে নিলো। অনন্যা আরো একবার হতভম্ব। দ্রুত হাত নিয়ে স্যারের গলা জড়িয়ে ধরলো। কৌশিক হেসে বললো,
"আজ তোমার প্রাইভেট ক্লাস নেবো। রেডি তো?"

অনন্যা হেসে ফেললো। খিলখিলিয়ে হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
"জ্বি! রেডি। দেখা যাক কি ক্লাস নেন আপনি।"

*******

দুপুরের প্রখর রোদ শেষে বিকেল এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু এখনও খাওয়ার পাঠ চুকেনি ওদের। অনন্যা ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছে। তার চোখে কিছুটা লাজুকতা। কৌশিক অনন্যার কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করছে যা তার বক্ষে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনন্যার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে কৌশিক বললো,
"তুমি এখানেই থাকো। আমি খাবার আনতে বলছি।"

অনন্যা সামান্য হেসে বললো,
"হুম!"

কৌশিক অনন্যার শরীরের দিকে তাকিয়ে ধীরেস্বরে প্রশ্ন করলো,
"শরীর ব্যথা করছে?"

অনন্যা একটু নীরব থাকল, তারপর আস্তে আস্তে বললো,
"একটু।"

কৌশিক নিচুতে ঝুঁকে অনন্যার ললাটে চুম্বন বসিয়ে বললো,
"স্যরি! "

"হুম না। আ'ম ওকে।"

অনন্যার ওষ্ঠ শেষবারের মতো আঁকড়ে ধরলো কৌশিক। অনন্যা কৌশিকের গলায় আস্তে করে হাত বসিয়ে দিলো। লোকটা এতো হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করে বসে অনন্যা বুঝতেই পারে না। সিক্ত ওষ্ঠ ছেড়ে দিয়ে আরেকবার গলার মাঝে ডুব দিলো কৌশিক। ফিসফিসিয়ে বললো,
"ইউ আর মাই পার্সোনাল ড্রাগস। আই ওয়ান্ট ইউ এভ্রি ডে, প্রিন্সেস।"

অনন্যা চোখ বন্ধ করে ফেললো। কথা বলার অবস্থাতে নেই সে। কৌশিকের চুলগুলো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। মনে হচ্ছে আজ স্যারের ভালোবাসার সমুদ্রে শেষ না হয়ে যায় সে। কিন্তু কৌশিক বেশিক্ষণ রইলো না। অনন্যাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ভালোমতো কম্বল দিয়ে ডেকে দিলো মেয়েটাকে।

কৌশিক আধা ঘণ্টা পর ফিরে আসলো। হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে। শরীরে নতুন পোশাক ছিল। অনন্যার জন্যও নতুন পোশাক নিয়ে এসেছিল। অনন্যা কম্বলের তল থেকে উঁকি দিয়ে মৃদু হাসলো। 
কৌশিক বললো,
"সন্ধ্যায় কিছু একটা পার্টি আছে। আমরা সেটা অ্যাটেন্ড করবো।"

অনন্যার মুখে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়লো। সে তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে বললো,
"পার্টি! বাহ!"

কৌশিক হাসলো। স্নেহময়ভাবে অনন্যাকে পোশাক পরতে সাহায্য করলো। তারপর দুজনে একে অপরকে খাইয়ে দিলো। তাদের সময় এক সাথে কাটানোর সৌন্দর্যে পূর্ণ হয়ে উঠলো। আর হাসি আনন্দে প্রতিটি মুহূর্ত জমে উঠলো। দুজনেই আজ বেশ আনন্দ ঘন মূহুর্ত কাটালো। পার্টির জন্য অনন্যা সুন্দরভাবে সাজলো। রেড রঙের সালোয়ার কামিজে সে একেবারে ঝলমলে হয়ে উঠলো। আর কৌশিককেও ব্ল্যাক স্যুটে দারুণ মানিয়েছে। তাদের প্রস্তুতি শেষ হতেই কৌশিক আচমকা বললো,
"আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। তুমি প্রস্তুত হয়ে থাকো, আমি মেসেজ করলে তুমি নিচে এসে পড়ো।"

অনন্যা একটু চিন্তিত হয়ে বললো,
"কিন্তু আমি একা কীভাবে?"

কৌশিক হেসে স্নেহভরে অনন্যার লাল লিপস্টিক মাখা ঠোঁটে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুল রাখলো।
"আমি থাকবো। তোমাকে কখনো একা হতে দেবো না। যখন থেকে আমার প্রবেশ তোমার হৃদয়ের গহীনে ঘটেছে, তখন থেকেই আমি তোমার মাঝে আছি। তাহলে একা কী করে হবে? হারিয়ে গেলেও ভিড়ের মাঝে আমাকে ঠিক খুঁজে পাবে অথবা আমিই খুঁজে নিবো। আমার চোখ সর্বদা তোমাতেই আটকে থাকবে। বুঝলে? ভালোবাসি, মাই প্রিন্সেস।"

অনন্যা বাকরুদ্ধ হয়ে লোকটার কথা শুনলো। হঠাৎ বুকের ভিতরটা কেমন একটা অচেনা, অজানা ব্যথায় মরে গেলো। বারবার কেনো হারিয়ে যাওয়ার কথা আসে। অনন্যা এই কথাগুলোকে ঘৃণা করে। সে চায় এটা স্বপ্ন হলে যাতে কখনো না ভাঙুক। কৌশিক স্যার মানুষ না হলেও তার কাছেই থাকুক। স্যারের মধ্যে ঘাটতি থাকলেও অনন্যা বারবার তাকেই চাইবে‌। প্রতি জনমে এই লোকটাকে খুঁজে বেরাবে অনন্যার মন। অনন্যার চিন্তা ভাবনা ভেঙে গেলো যখন কৌশিক স্যার জোর কদমে বাইরে চলে গেলেন। অনন্যা নিশ্চুপ হয়ে বিছানায় বসে রইল। আজ নিজের শরীরের প্রতিটি কোণে স্যারের স্পর্শ পেয়ে মনে হয়েছে এই লোকটাকে ছাড়া অনন্যার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। এতো এতো আদর, স্নেহময় স্পর্শ, ভালোবাসাময় যত্ন অনন্যা আজীবনে কখনো ভুলতে পারবে না। ভুলতে চায় ও না অনন্যা। কিন্তু কিছু কথা থাকে যা বারবার মনে খচখচ করে। যে কথা মুখে বলা যায় না শুধু ভেতরটা ব্যাথায় ভরে যায়। সেই অচেনা ব্যথার উৎস কৌশিকের প্রিন্সেসের শরীর জুড়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে চায় না অনন্যা। তাও কখনো কখনো ভেনোরার কথা মনে পড়ে, আবার কখনো স্যারের সেই দিনের শক্তি নেওয়ার দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে।

কৌশিকের মেসেজ পাওয়ার পনেরো মিনিট পর অনন্যা রুম থেকে বেরিয়ে এল। ধীর পায়ে লিফটে উঠে নিচে নামলো। নিচে এসে লিফটের দরজা খুলতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল সামনে বিশাল আয়োজন! ঝলমলে আলোয় সাজানো পুরো হলরুম, মানুষের কোলাহল, সুগন্ধে ভরা নানা রকম খাবারের স্টল, আর চারপাশের পোস্টার দেখে বুঝতে পারলো, এটি হোটেলের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সেরেমনি।

কিন্তু অনন্যার চোখ শুধু একজনকেই খুঁজছে। ভিড়ের মাঝে স্যারের চেনা অবয়ব কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কৌশিক গেল কোথায়? অস্থির মনে অনন্যা একবার ডানদিকে তাকায় তো একবার বাঁদিকে।

হঠাৎ স্টেজে এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়ালো। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললো,
"লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যান, অনেক দেরি হয়ে গেছে! এখন হবে ডান্স পারফরম্যান্স!"

অনন্যা হতাশ হলো। হাত গুটিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। মুখে সাধারণ প্রসাধনী, কোনো গহনাও নেই, তবু কি সুন্দর এক লাল আভায় মোড়ানো লাগছে তাকে! ভিড়ের মধ্যেও সে আলাদা হয়ে জ্বলজ্বল করছে।

গানের তালে হলরুমের বাতাস ভরে উঠলো। সবাই আপন জগতে হারিয়ে গেছে। বেশিরভাগই নিজেদের সঙ্গীকে নিয়ে এসেছে। কেউ বা এই জমকালো পার্টিতেই পেয়েছে নতুন সঙ্গী। অনন্যা একটু সরে গিয়ে একপাশে দাঁড়ালো। সেখানে যারা একা এসেছে, তারা গুছিয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসিমুখে চারপাশটা দেখছিল সে।কেউ নাচছে, কেউ হাসছে, কেউ কারো চোখে ডুবে আছে।

ধীরে ধীরে তার পাশের জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। সবাই সঙ্গী খুঁজে নিয়ে তালে তাল মিলিয়ে মেতে উঠেছে। অনন্যা একবার ফোনের স্ক্রিনে তাকালো, বারবার কৌশিক স্যারের পাঠানো মেসেজটা পড়লো। কোথাও কোনো ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে কি না বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু না, কিছুই নেই। একসময় নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা পার্সে রেখে দিলো।

ঠিক তখনই! এক ঝটকায় কেউ তার পার্সটা টেনে নিলো! অনন্যা চমকে উঠে পাশে তাকালো এবং পরের মুহূর্তেই শক্ত এক স্পর্শের শিকার হলো তার নরম হাত। অন্য হাতে কেউ এত্তগুলো লাল গোলাপ তার বুকে ঠেলে দিলো।

গভীর, চেনা কণ্ঠস্বর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
"মাই ফেভারিট কালার ইজ রেড! এন্ড টুডে ইউ বিকাম মাই ফেভারিট লেডি।"

অনন্যার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ বাড়তে থাকলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চেনা সুগন্ধ মিশে গেলো তার নিশ্বাসে। কৌশিক স্যার! 
মৃদু আলোয় সেজে থাকা হলরুমটা এক স্বপ্নরাজ্য হয়ে উঠেছে। কৌশিক অনন্যার হাত শক্ত করে ধরে বললো,

"মাই ফেভারিট লেডি, লেটস গো টু দা ডান্স ফ্লোর।"

অনন্যা বুকে জড়িয়ে রাখা গোলাপগুলো সাবধানে পাশের টেবিলে রেখে দিলো। কিছু সময় তাকিয়ে রইলো লাল ফুলগুলোর দিকে। চোখ দুটো ঘোলা হয়ে আসলো। সেই রঙের মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজছে সে। কৌশিক তার ধ্যান ভাঙলো। অনন্যার কোমল হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো ফ্লোরের দিকে। অনন্যার আঙুলে রিং পড়া স্থানটায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো কৌশিক। মৃদু ঠোঁটের ছোঁয়ায় মনের ভাষা প্রকাশ করলো সে।

কৌশিকের আঙুলের ইশারাতেই বদলে গেলো গান। তাল মিলিয়ে মৃদু সুর ভেসে উঠলো। হলরুমের আলো খানিকটা নরম হয়ে এলো। শুধুই তাদের জন্যই এক মায়াবী পরিমণ্ডল তৈরি হলো।

অনন্যার চোখ ধীরে ধীরে উঠে এলো কৌশিকের চোখের দিকে। যেখানে আকশসম মায়া খেলা করছে, অনন্যা সেখানে হারিয়ে যেতে লাগলো।

Baby, I'm dancin' in the dark with you between my arms
Barefoot on the grass while listenin' to our favourite song
When you said you looked a mess, I whispered underneath my breath
But you heard it, "Darling, you look perfect tonight"

গানের তালে তালে পা চলছে। অনন্যা কৌশিক স্যারের মাঝে হারিয়ে গেছে, এই দিন দুনিয়ার কোনো খবর নেই তার। এই সময়টা যদি অনেক ক্ষণ ধরে রাখা যেত খুব কী ক্ষতি হতো?!

******

আরণ্যক চুপচাপ ভাতের থালায় আঙুল চালাচ্ছে। কিন্তু খাচ্ছে না। মন অন্যস্থানে পড়ে আছে। ভেনোরার কথাগুলো বারবার কানে ভাসছে। আরণ্যকের অমনোযোগিতা দেখে ওর মা বিরক্ত চোখে তাকালেন। মনে মনে ভাবলেন এই ছেলেটা সারাক্ষণ কী যেন ভাবতে থাকে! একটা মেয়ের পেছনে এমন পাগল হয়েছে, কিছুতেই ছাড়াতে পারছেন না। তিনি ছেলের পাশে বসে থাকা রুশার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন। রুশা বুঝে গেলেন মায়ের অসহায়ত্ব। ভাইয়ের কাঁধে ঠেলা দিয়ে বললো,
"আরুর বাচ্চা! কি করছিস এসব? খাওয়ার বদলে ভাত নিয়ে খেলা করছিস?"

আরণ্যক কোনো সাড়া দিল না। বোনের কথা এখনো কানে যায়নি।
রুশা এবার ভ্রু কুঁচকে বললো,
"ভাগ্যিস, বাবা এখনো ফেরেনি! এসব দেখলে তোকে একদম ছাড়বে না!"

কথাটা কানে পৌঁছুতেই আরণ্যক সামান্য সচকিত হলো। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। একরাশ ভাবনা তার চোখেমুখে খেলা করছে। মা গভীর দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

আরণ্যক প্লেট ধাক্কা দিয়ে বললো,
"খিদে নেই। পরে খাবো।"

আরণ্যকের মা বিরক্তের সহিত চিৎকার করে উঠলেন,
"কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?"

এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। কলিংবেলের তীক্ষ্ণ শব্দে সবাই একসঙ্গে চমকে উঠল। চারপাশে সেকেন্ডের মধ্যেই থমথমে পরিবেশ তৈরি হলো। নিঃসন্দেহে আরণ্যকের বাবা ফিরে এসেছেন। তার গম্ভীর ব্যক্তিত্ব আর কঠোর শাসনের জন্য পরিবারের সবাই তাকে একরকম ভয়ই পায়। আরণ্যকের মা দ্রুত ছেলেকে ইশারায় টেবিলে বসতে বললেন যেন সব স্বাভাবিক দেখায়। কিন্তু আরণ্যকের মুখে বিরক্তি। সে অসন্তুষ্টভাবে চ শব্দ করে চেয়ারে বসে পড়লো। 

রুশা একবার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, তারপর ধীরপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে তারও। দরজার হাতল ধরে একটু দ্বিধা করলো সে। বাবার মুখোমুখি হওয়া মানেই কড়া জেরা, কঠিন নির্দেশ। কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে ধীরে ধীরে দরজা খুললো রুশা।
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp