প্রেমান্বেষা - পর্ব ৩৯ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


শেখ বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে গিয়েও স্বাভাবিক হচ্ছে না। এই যেমন বহু কষ্টে স্মরণ ও নীলিমার বিয়ে ঠিক হলো। কিন্তু বিয়ের আগে এসে হুট করেই নীলিমা জ্ঞান হারালো। কি কারণে সে জ্ঞান হারিয়েছে তা কেউ বলতে পারছে না। নীলিমার এহেন অবস্থা দেখে মাসুদা বেগম অনুমান করে বললেন, হয়তো সকালে কিছু খায়নি নীলিমা, এজন্যই এমনটা হয়েছে। কিন্তু রাফার কাছে জানা গেলো, নীলিমা সকালে খেয়েছে। একেবারে যে খালি পেটে আছে তা নয়, আবার একেবারই যে পেট ভরে খেয়েছে সেটাও নয়। তাহলে এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, নীলিমা হঠাৎ অজ্ঞান হলো কেনো।

নীলিমার জ্ঞান ফিরলো মিলি বেগমের হাতের পানির ছিটায়। পিটপিট করে সে চোখ মেলে দেখলো তার চারপাশে বাড়ির সকল মহিলাগণ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হতেই সে বুঝতে পারলো মিনিট দুয়েকের মতো সে অজ্ঞান ছিলো। এই বুঝ হতেই সে মা ও ছোট মামিকে ধরে বিছানায় শোয়া থেকে উঠলো। নীলিমার এহেন অবস্থায় উদ্বিগ্ন সকলের মুখেই একই প্রশ্ন ঘুরপাক খেলো,
" নীলু? ঠিক আছিস তো এখন? না কি এখনও মাথা ঘুরছে?"
এই বলতে বলতে নাজমা বেগম এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। নীলিমা পানি খেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
" এখন ঠিক আছি। তবে অল্প একটু দুর্বল লাগছে।"
মিলি বেগম এবার নীলিমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। কাঁদো কাঁদো গলায় উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
" হঠাৎ জ্ঞান হারালি কেন নীলু? সকালে ভালো মতো কিছু খাসনি? একটু পোলাও খাইয়ে দিবো? রান্না হয়ে গিয়েছে। "

নীলিমা নাকচ করলো। ক্ষীণ দুর্বল গলায় বললো,
" না আম্মু। আমার খেতে ইচ্ছা করছে না । আর খাবারের জন্যও এমনটা হয়নি।"

" তাহলে কিসের জন্য হলো? হুট করে জ্ঞান হারালি তুই! কিছুক্ষণ আগেও তো সব ঠিক ছিলো।"

মিলি বেগমের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে রাফা টিপ্পনী কাটলো,
" আরে খালামনি বুঝো না? স্মরণ ভাইয়ের সাথে বিয়ের অতিরিক্ত খুশিতে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছে আমাদের নীলু। "
বলেই সে মুখ টিপে হাসতে লাগলো। নীলিমা সরু দৃষ্টিতে কটমট করে চাইলো। তার স্বপক্ষে যুক্তি দেয়ার পূর্বেই মিলি বেগম বললেন,
" এখন দুষ্টুমি করিস না তো রাফা। মেয়েটা আমার বিয়ের আগ দিয়ে এমন হুট করে অজ্ঞান হয়ে গেলো। এখন তো ওর বাপে এসে আমাদেরই দোষ দিবে। "

নওরীনও এবার মুখ টিপে হেসে বললো,
" আব্বু কিসের দোষ দিবে? তোমার মেয়ে সত্যিই বিয়ের খুশিতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। ওকে জিজ্ঞেস করো, জ্ঞান হারানোর আগে আমাদেরকে ধরে কি কি বলছিলো। করো জিজ্ঞেস। "

মিলি বেগম এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই মিইয়ে গেলো নীলিমা। তখন নিজের ভেতরকার উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা দমিয়ে রাখতে না পেরেই নওরীন, রাফা ও মানতাসাকে সব বলেছিলো। তাই বলে তারা এভাবে লজ্জা দিবে!
আসমানী বেগম এবার এগিয়ে এলেন। মিলি বেগমকে সরিয়ে দিয়ে নিজে নাতনির পাশে বসলেন। নীলিমার মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিলেন। অতঃপর নীলিমাকে অবাক করে দিয়ে নওরীনের পক্ষে বললেন,
" তো কি হইছে শুনি? প্রেমের নাগরে লগে বিয়া হবার কথা শুইনা বেহুঁশ হইতেই পারে। তোরা মজা নিতাছোস ক্যান?"

নওরীনের কথায় নীলিমা এতক্ষণ যতোটা না লজ্জা পেয়েছিলো, নানীর কথায় এর চেয়েও দ্বিগুণ লজ্জায় চুপসে যায় সে। লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে এলে বললো,
" এসব কি বলো নানী? আমি....."

আসমানী বেগমও সুযোগ বুঝে টিপ্পনী কেটে বললেন,
" বুঝি রে নীলু, সব বুঝি। এতো লজ্জা পাওনের কিচ্ছু নাই। বিয়ার খুশিত জ্ঞান হারাইতেই পারোস। আমি খালি চিন্তা করতেছি, বিয়ার আগেই এই অবস্থা। আল্লাহ জানে বাসর ঘরে কি হইবো!"

আসমানী বেগমের এহেন কথায় ভারী পরিবেশটাও মুহূর্তে হালকা হয়ে এলো। সমস্বরে হেসে উঠলো সবাই। আর নীলিমা লজ্জায় নানীকে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকালো। 

বাড়ির সব পুরুষেরা নামাজ পড়ে ফিরে এসেছে। সাথে নিয়ে এসেছে কাজী। তার সাথে এসেছে শেখ বাড়ির চারপাশের বাড়ির পুরুষেরা। এই স্বল্প সময়ের সিদ্ধান্তে হওয়া বিয়ের খবরও চোখের পলকে গ্রামে রটে গিয়েছে। নীলিমার বউ সাজার পূর্বেই আশপাশ থেকে মহিলারা এসে জড়ো হয়েছে। এদিকে আকস্মিক এত জনগণের উপস্থিতি দেখে মিলি বেগম ও নাজমা বেগমসহ মহিলাগণ ভারী চিন্তায় পড়ে গেলেন। কেননা তারা একা হাতে বেশি পরিমানে রান্না করতে পারেননি। ততটাই রান্না করেছেন যতটা বাড়ির আশেপাশের আত্মীয়স্বজনদের ডেকে দুপুরের খাবার হিসেবে খাওয়াতে পারবে। এদিকে পর্যাপ্ত সময়ও নেই এখন যে পুনরায় সব রান্নার ব্যবস্থা করা যাবে। 

এদিকে বাড়িতে কাজি সাহেব এসে উপস্থিত হলেও নীলিমা তৈরী ছিলো না৷ বউ সাজতে এতো দেরি হলো কেনো, এই জিজ্ঞেস করতে এসেই ছড়িয়ে পড়লো যে নীলিমা বিয়ের খুশিতে জ্ঞান হারিয়েছিলো। তাই এতোটা দেরি হলো। 
নীলিমা এ কথা ছড়ানোর ব্যাপারে বারবার নিষেধ করেছিলো। কিন্তু পেট পাতলা রাফির মুখে এই কথাটুকু এঁটে থাকেনি। সে এই সংবাদ শুনেই সর্বপ্রথম স্মরণকে জানিয়েছে। স্মরণও উদ্বিগ্ন হয়ে তখনই নীলিমার সাথে দেখা করতে চলে যায়। কিন্তু কেউই তাকে রুমে প্রবেশ করতে দেয়নি। এদিকে নীলিমাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। এ মুহূর্তে নীলিমার সাথে সরাসরি কথা না বলা অব্দি অস্থিরতায় ডুবে থাকবে সে।
নীলিমার স্বাস্থ্য ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে উৎকণ্ঠায় স্মরণ নাজমা বেগমকে বললো,
" মা? নীলিমার অবস্থা কি বেশি খারাপ? বেশি খারাপ হলে আজকে বিয়েটা এখনই ক্যান্সেল করি। কাল....."

নাজমা বেগম মুহূর্তেই চোখ গরম করে বললেন,
" কান পিছে মারবো একটা। এ বিয়ের জন্যই নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে কত কাহিনি করলি, আর এখন বিয়ে করবি না! বলি কি এটা কি নাট্যমঞ্চ পেয়েছিস! "

স্মরণ খানিকটা মিইয়ে গেলো বটে। সত্যিই তো এ বিয়ের জন্য কত ঘটনা ঘটলো! কিন্তু এদিকে নীলিমার শরীরও যে ভালো না! তাই স্মরণের হৃদয়খানা নীলিমাকে আজ বিয়ের মতো ধকল দিতে সায় দিচ্ছে না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তার কিছু করারও থাকলো না। 

নীলিমাকে বউরূপে সাজানো হয়েছে সাদা শাড়িতে। গলায়, কানে ও মাথায় স্বর্ণেট গহনা। হাতে স্বর্ণের চুড়ি, মেহেদি। মাথায় বিয়ের লাল ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা। সবদিক দিয়ে তাকে বউ রূপে দারুণ লাগছে। স্নিগ্ধ ও ছিমছাম এ সাজ তাকে মানিয়েছেও বেশ!

বিয়ে পড়ানোর ক্ষেত্রে প্রথমে সিদ্ধান্ত হলো ছেলেমেয়েকে আলাদা রুমে কবুল বলানো হবে। কিন্তু বাড়ির জোয়ান সদস্যদের আধুনিকতার জোরে ছেলেমেয়েকে একই রুমে বিয়ে পড়ানোর সিদ্ধান্ত হলো। সবদিকে ভাবনাচিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, বিয়ে পড়ানো হবে বাহাদুর শেখের রুমে, তাঁর সামনে। এক্ষেত্রে পাখি ও রাফি স্মরণ ও নীলিমার মাঝে নাজমা বেগমরে বিয়ের লাল শাড়ি ধরে রাখবে, আবছা পর্দা হিসেবে। নওরীন এই পর্দাটা ফুল দিয়ে বানাতে চেয়েছিলো। কিন্তু সময়ের স্বল্পতায় সেটা পারেনি বলেই বিয়ের ওড়না দিয়ে কাজ চালাতে হয়েছে। 

সকল দোয়া দরূদ ও আনুষ্ঠানিকতা মেনে স্মরণ ও নীলিমার বিয়ে পড়ানো সম্পন্ন হলো। মোহরানা ধার্য করা হলো পাঁচ লক্ষ টাকা। এই মোহরানা ধার্যের ব্যাপারে স্মরণকে কোনো জোর করা হয়নি। বরং সে হাসিমুখে মন থেকেই এই মোহরানা আদায় করতে ইচ্ছুক হয়েছে। নীলিমা অবশ্য এতো বড় অঙ্কের মোহরানায় নাকচ করেছিলো। কিন্তু স্মরণের আশ্বাসে সে-ও রাজি হয়ে যায়। ইমাদ সাহেব অবশ্য স্মরণের এ মোহরানার অঙ্ক শুনে মনে মনে বেশ খুশিও হলেন। হাজার হোক, বাঙালি মেয়ের বাবা বলে কথা!

সবশেষে স্মরণ কাবিননামায় সই করার পর তা গেলো নীলিমার কাছে। কিন্তু নীলিমা সই করতে পারলো না। বিয়েতে কবুল বলতেই তার ঘাম ছুটে গিয়েছিলো। এ পর্যায়ে কাবিননামায় সই করতে গিয়ে তার হাত কাঁপতে লাগলো। সকলেই আশপাশ থেকে মুখের বুলির মাধ্যমে ভরসা দিতে লাগলো। মিলি বেগম মেয়ের বাহু ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু নীলিমা শান্ত হতে পারছে না। এ পর্যায়ে ইমাদ সাহেব এগিয়ে গেলো। তিনি পরম যত্নে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ভরসা দিলো,
" সই কর মা। এই সইটুকু করলেই তোর সুখের জীবনের সূচনা ঘটবে। "
বলেই তিনি নীলিমার কম্পিত হাতটা চেপে ধরলেন। আশ্বাসের সুরে বললেন,
" সই কর নীলু। আমরা সবাই আছি এখানে। "

নীলিমা ভরসা পেলো। তার অস্থির হৃদয়টা শান্ত হতে আরম্ভ করলো। বড় বড় শ্বাস টেনে বাবার ভরসায় সে কলম চালিয়ে সই করলো। অতঃপর সই হতেই কলম ছুঁড়ে আচমকা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। তার কান্নায় মহল ভারী হয়ে এলো। সবার চোখেই জল। এমনকি স্মরণের চোখেও। তার এই চোখের জল জানান দিচ্ছে নীলিমাকে চিরতরে পেয়ে গিয়েছে সে। নীলিমা এখন মৃত্যুর আগ অব্দি স্মরণের। মৃত্যুর পরেও হয়তো আল্লাহর ইচ্ছায় স্মরণেরই হবে। 

বিয়ের পরের কান্নাকাটির পর্ব শেষ হতেই পাখি ও রাফিকে পর্দা নামানোর নির্দেশ দেয়া হলো। স্মরণ এগিয়ে এলো নীলিমার দিকে। ইমাদ সাহেব স্মরণের হাতে নীলিমার হাত রেখে আকুতিপূর্ণ কণ্ঠে বললো,
" তোমাদের বিয়েতে প্রধান বাঁধা আমি হয়েছিলাম। কিন্তু এই আমিই এখন আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিলাম স্মরণ। ওকে কখনও দুঃখ দিও না। আমার কারণে ওর চোখে যে জল এসেছিলো তা তুমি সুখ দিয়ে মুছে দিও। আমার মেয়েকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবেসো স্মরণ। বড় আদরের মেয়ে আমার।"
বলতে বলতে ইমাদ সাহেবের চোখ উপচে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। ওদিকে মিলি বেগম ও নওরীনও সশব্দে কাঁদছে। তাদেরকে সান্ত্বনা দিতে সকলে বললো, নীলিমা দূরে কোথাও যাচ্ছে না, ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকছে। তবুও তাদের কান্না থামলো না। 
নীলিমাও মৃদু শব্দে কান্না করছে। স্মরণ এবার নীলিমার পানে চেয়ে ইমাদ সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,
" নীলিমা আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত অর্জন ফুপা। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন ওর ব্যাপারে। তবে যেদিন আপনার মনে হবে আপনার মেয়ে সুখে নেই সেদিন আমার শাস্তি হিসেবে আমাকে মৃত্যুদন্ড দিবেন।"
ইমাদ সাহেব প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না। হাত সরিয়ে নিলেন তিনি। যদিও স্মরণের আত্নবিশ্বাসীপূর্ণ কথায় তিনি ভীষণ খুশি হলেন। 

স্মরণ এ পর্যায়ে নীলিমার কান্নায় জর্জরিত নত মুখখানা দেখে তার দু হাত এগিয়ে নিয়ে আলতো করে চুমু খেলো। অতঃপর সেই হাত দুটো নিজের চোখে চেপে ধরে বিড়বিড় করে বললো,
" আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ। "

নীলিমা পূর্বের ন্যায়ই দাঁড়িয়ে রইলো। এবার স্মরণ চোখের উপর হতে নীলিমার হাত দুটো সরিয়ে তার শারীরিক অবস্থার প্রেক্ষিতে মোলায়েম গলায় শুধালো,
" এখন কি সুস্থ বোধ করছো নীলি? মাথা ঘুরাচ্ছে না তো?"
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp