শান বাঁধানো পুকুরের ধারে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে নওরিজ মাহবুব। দুই হাত বুকে ভাঁজ করে সামনে দন্ডায়মান ব্যাক্তির কথা শুনছে মনোযোগ দিয়ে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নেয় সবটা। লোকটার সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে হেঁটে যায় সম্মুখে। শূন্য পরিপাটি গোয়াল ঘরে কিছু লোকেরা কাজ করে যাচ্ছে বিরতিহীন। আজ গরু তোলা হবে খামারে। প্রায় বিশ টা গরু আনা হবে। তাঁদের রাখার জায়গা,খাবার জোগান করা হচ্ছে। আর এসবের তদারকি নওরিজ খোদ পর্যবেক্ষণে নেমেছে। নিজের শখের খামার বলে কথা। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে গ্রামে আসা হয়েছে লম্বা সময় হলো। চাকরি বাকরিতে তাঁর পোষায় না। অন্যের জি হুকুম করা নওরিজের কাছে এলার্জি ছাড়া কিছুই না। বাবার বাঁধা সত্ত্বেও বাড়ির আঙিনায় খামারের বন্দোবস্ত করেছে। পুকুরে মাছ চাষ চলছে। খেতে খামারেও সামনের মৌসুম থেকে নিজ হুকুমেই চাষ করার পরিকল্পনা আছে। নওরিজ সব তদারকি করে বা হাতের কব্জিতে হাতঘড়ি দেখে নেয়। সকাল দশটার ঘরে কাঁটা ঘুরছে। এমন সময় নোমান মাহবুব গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসেন। নওরিজ নরম গলায় বলে,
-" কিছু বলতে চান আব্বা?"
নোমান মাহবুব ছেলের সামনে দাঁড়ান। পরণের হালকা বেগুনি রঙের পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করতে করতে বলেন,
-" আপনে সত্যিই গরু আনবেন? আপনে আর গরু পালন হজম হতে চাচ্ছে না। আবার নাকি ছাগলও তোলার পরিকল্পনা। রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি আমার গোয়াল ঘর বানানোর ফন্দি আটতেছেন নাকি?"
-" আব্বা আপনার রাজপ্রাসাদ রাজপ্রাসাদই থাকবে। আমি শুধু একাংশ নিলাম। এতে আপত্তি থাকলে বলবেন। আফটার অল বাড়ি ঘর জায়গা জমি সবই আপনার।"
ছেলের কাঠ কাঠ গলায় নোমান মাহবুব হেসে বলল,
-" আপত্তি কেন থাকবে? আমি তো আপনাকে নিয়ে চিন্তিত। আপনি তো সামান্য ঘামের গন্ধই সহ্য করতে পারেন না। সেখানে গরু, গোবর একটু সংশয় হচ্ছে। শেষ মেষ গরু কিনে পরদিনই বেঁচার তাগিদ না দেন! না মানে এমনিতেই বললাম।"
-" আমি নওরিজ মাহবুব যা করি ভেবেচিন্তে করি। আর গরু আনছি মানে এই না গরুর গলা জড়িয়ে বসে থাকবো। কর্মচারীরাই সবটা করবে। আমি শুধু মাঝেমধ্যে খবর নিবো। আপনার হলে বলুন? মতি কাকা সহ বাকিরা গরু কিনতে হাঁটে যাবে।"
নোমান মাহবুব একটু অপ্রসন্ন হন। বাড়িতে গরু পালন, আঙিনায় গোবর ঠাসা! ছেলে খামারে কাজ করবে পছন্দ হয় না তাঁর। লোকে কি বলবে? তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে জব্বর বুদ্ধি আঁটেন। বলেন,
-" মতি যাবে গরু কিনতে? আপনি যাবেন না? কেন? গরু হাঁটে যেতে নিশ্চয়ই গা ঘিন ঘিন করে! অথচ বাড়িতেই গরুর হাট বানাবেন। বলি এতই খামার দেওয়ার শখ তাহলে নিজেই হাঁটে গিয়ে গরু কিনে আনুন। আমিও একটু আশ্বস্ত হবো!"
বাবার কথায় গম্ভীর নওরিজের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ দেখা যায়। হাট মানেই ভিড়ভাট্টা। একেঅপরের গা ঠেলাঠেলি! তার উপর গরুর হাট! গোবর, গরুর প্রেসাবের রগরগা গন্ধ! ভাবতেই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। তাঁর পক্ষে সহজ নয় তবে অসম্ভব নয়। বাবার নীরব আবাহনে সায় জানিয়ে বের হয় হাঁটের উদ্দেশ্যে।
•••••••••••
সকাল হতেই ব্যস্ত শান্তি বেগম । বাড়ি ঘর উঠোন ঝাড়ু দিয়ে ঘরদোর সাফ সাফাইয়ের কাজে ব্যস্ত। বাড়িতে অতিথি আসবে কি-না। তিনি কাজ করে আর সুরেলাকে হাঁক ছাড়েন। কিন্তু সুরেলার খোঁজ খবর নেই। সেই যে প্রতিবেশী শাপলা দের বাড়িতে ঢুকলো আর বেরোচ্ছে না। তিনি বেজায় চটে যান। কিছু বলতেও পারছে না। মেয়েটা রাগে জেদে ভাইয়ের কোনো অংশে কম নয়। কিছু বললে দেখা যাবে ঘার ত্যাড়ামো করবে।
সুরেলা প্রতিবেশী শাপলাদের ঘরে বসে আছে চুপচাপ। শাপলা নামক কিশোরী তাঁর সঙ্গীনী। মেয়েটা সেভেনে পড়ে। বাবা গত হয়েছে বছর হবে। মা আর জমজ ভাই শফিরে নিয়ে ছোট্ট সংসার। সংসারের ভার ছোট্ট শফির উপর বর্তায়। মাঝে মাঝে নানা এসে খোঁজ খবর নেয়। কিছু পয়সা কড়ি দিয়ে যায়। এতেই চলে যায় ছোট্ট সংসারটি। তাছাড়া মরহুম বাবার গচ্ছিত পুঁজি দিয়ে বাগিতে জমি জমা চষে ভালোই টাকাকড়ি কামায়। শাপলা সুরেলার পাশ ঘেঁষে বসে বলে,
-" ও সুর আপা, কিছু তো কও? মন খারাপ কইরা আছো ক্যান? চাচি ডাহে হুনন নও না! জগি ঠাকুরের মতো বইসা আছো শুধু।"
সুরেলা তবুও প্রত্যুত্তর করে না। তাঁর মন সাগরে যে ঘূর্ণিঝড় হেনেছে। নীলাম্বরে মেঘের আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। বিষন্ন সেই আঁধার যেন ক্রমশই গাঢ় হচ্ছে। শাপলা তাঁর এক বাহু ধরে ঝাঁকায়। শাপলার মা চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকে। স্টিলের থালায় মুড়ি আর এক টুকরো পাটালি গুঁড় মেঝেতে সুরেলার সামনে রেখে বলে,
-" মাইয়া হইয়া জন্মাছু যহন পরের ঘরে যাইতেই হইবো। খোদা কার লগে ধাগা বান্ধছে তিনিই ভালো জানেন। রিজিকে যদি ওই মহিরের ঘরের ভাত লিইখা রাখে তাইলে তোর আমার ক্ষমতা নাই আটকানোর। মুড়ি কয়ডা খাইয়া যা বাত্তে। মায়ের হাতে হাতে কাজ কইরা দে। তোর ভাই যদি হুনে পিঠে খড়ি ভাইঙবো তোর।"
ডাগর ডাগর মায়াবী আঁখি যুগল হতে টপটপ করে নোনাজলের বর্ষন হয়। ভিজে দেয় শুকনো কপোল দ্বয়। সুরেলার মুড়ির থালা ঠেলে সরিয়ে উঠে চলে যায় ঘর ছেড়ে। শাপলার মা স্নেহ ভরা চোখে তাকিয়ে দেখে তার গমন পথ।
সিনান সালেহ কয়লা পিষ্ঠ করে এক হাতের তালুতে নিয়ে অপর হাতের তর্জনী আঙ্গুলের সাহায্য কয়লার গুঁড়ো নিয়ে দাঁত ঘষে অনবরত। উঠোনেরর এক কোণায় থুতু ফেলে গোয়াল ঘর থেকে গরুটা বের করে নিজেই গোয়াল পরিষ্কার করে। ফিতে ছাড়া জুতোর সাহায্য গোবর ঝুড়িতে তুলে সুরেলাকে ডাকে,
-" সুর? এই নবাবের বেটি কই মরছু? ডাকি কানে যায় না? আসমু আমি?"
ভাইয়ের কর্কশ গলায় সুরেলা গোয়াল ঘরের টিনের দরজায় দাঁড়ায়। তাঁর ভেজা চোখ নজরে এলেও আমলে নেয় না। গোবরের ঝুড়ি দেখিয়ে বলে,
-" কোনে ডিল্কি মারবার গেছিলি? যা গোবর ভাইঙ্গা দিয়া আয়। তার আগে বাজার ঘাট কি কি লাগবো একটা লিস্ট বানা। আমি পাগার থাইকা ঝাঁপ দিয়া আসি।"
গোয়াল ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে টাঙানো রশি হতে গামছা লুঙ্গি নিয়ে চলে যায় পুকুর পাড়ে। সুরেলা গম্ভীর মুখে গোবরের ঝুড়ি নিয়ে চলে যায়। বাজারের লিস্ট বানাতে তাঁর বইয়ে গেছে। সিনান গোসল সেরে এসে ভেজা গামছা গলায় ঝুলিয়ে ভেজা লুঙ্গি মেলে দিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
-" লিস্ট দে কি কি আনা লাগবো! পাঁচশো টাকা ধরায় দিয়ে নবাব ফুরুৎ। বাজারের ভাও বোঝে? পাঁচশো টাকার কি আনমু? আমার কাছে তো সাপের পা আছে। সবাই শ্যাষ কইরা দিলি আমারে। আমি শা*লা দেইখা তোগোর ফরমায়েশ খাটি। অন্য কেউ হইলে বুড়া আঙ্গুল দেখাইতো।"
শান্তি বেগম চুপচাপ হজম করে নেয়। খাতা কলম এনে ছেলের হাতে ধরিয়ে কি কি আনতে হবে একে একে বলেন সবই। সিনান চুপ নেই, তিরিক্ষি মেজাজে ভর্ৎসনা করে যায়।
••••••••••••
সরোজপুর বাজারের ঠিক মাঝ বরাবর ফুটপাত ঘেঁষে একেকটা ছাপড়ি দোকান। সেখানে দিনমজুরের দল বিভিন্ন দোকান নিয়ে বসেছে। এক জিলেপির দোকানে বাবুর্চি দক্ষ হাতে জিলেপির প্যাঁচ দেয়। সম্মুখে পাতা কাঠের টেবিলে সজ্জিত খুরমা, জিলেপি, গজা সহ আরো কিছু মিষ্টান্ন রাখা হয়েছে। মাছি ভন ভন করছে তার উপর। সাদাকালো পেপার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে মাছি থেকে রক্ষার জন্য। দোকানের মালিক চেয়ার পেতে বসে খোদ্দেরদের সাথে হাসিমুখে বেচা কেনা করে। আশেপাশের দোকানের তুলনায় ভিড় যেন সবসময়ই। কিছু বয়স্ক মানুষের আনাগোনা একটু বেশিই। কি যেন গুসুর ফুসুর করে জিলেপির প্যাকেট নিয়ে হাত মিলিয়ে চলে যায়। নওরিজ মাহবুব একটু দূরে দাঁড়িয়ে কালো চশমা ও মাস্ক পরিহিত অবস্থায় সবটাই দেখে যায় তীক্ষ্ম নজরে । সব স্বাভাবিক লাগলেও কোথাও যেন একটু খটকা লাগে। কিছু সময় অবলোকন করার পর নিজেই এগিয়ে যায় সেখানে। ওয়ালেট বের করে দোকানির উদ্দেশ্যে বলে,
-" দু কেজি জিলিপি দিবেন। সদ্য ভেজে তোলা। এই মাছি পড়া গুলো না।"
দোকানে কাজ করে মধ্যবয়সী লোকটা হাত স্বীয় গায়ের শার্টে দুই পোছা মেরে পেপারে জিলেপি তুলতে শুরু করে। মাস্কের আড়ালে নওরিজের নাক মুখ কুঁচকে যায়। কপালেও সুক্ষ্ম রেখা দেখা যায়। তবে কিছু বলে না। এমতাবস্থায় পাশে একটা লোক দাঁড়ায়। নওরিজ পাশ ফিরে চায়। ভদ্রলোকের হাতটা গোপন জায়গায় চুলকাতে ব্যস্ত। কালো দাঁত দেখিয়ে হেসে 'মন্টু ভাই' বলে ডাক দেয় শুধু। মন্টু নামক লোকটা দোকানের মালিক। সে প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে চোখে চোখে কি যেন ইশারা করলো। নওরিজ মাহবুব বুঝতে পারে না তাদের ইশারা তবে সন্দেহ আকাশচুম্বী। ভদ্রলোকটা চলে যায় তৎক্ষণাৎ। নওরিজ তাঁর প্রস্থান দেখে তীক্ষ্ম ধারালো দৃষ্টিতে। লোকটা হাঁটছে কেমন হেলেদুলে পেরে। যেন এখুনি মাঝরাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে ঢুলে পড়বে।
-" বাবা নেন আপনের জিলাপি। আর কিছু নিবেন?"
মন্টুর কথায় নওরিজ সামনে ফিরে। না বোধক মাথা নেড়ে টাকা বাড়িয়ে দেয়। মন্টুর কথাবার্তা শুনে তো ভদ্রলোকই মনে হয়। কন্ঠে যেন রসের সিরা! মনটা আসলে কেমন? সে চলে যায় জিলেপির পলিথিন নিয়ে। মন্টু চেয়ারে বসে স্মিত হাসে। বাবুর্চি লোকটা বলে,
-" ভাই চিনছেন নি? চেয়ারম্যানের পোলা রিজ খান।"
মন্টু তাকিয়ে রয় হনহনিয়ে চলে যাওয়া বলিষ্ঠ মানবের পানে। একটা জিলেপি মুখে নিয়ে বলে,
-" পুরা সরোজপুর চষে বেড়াই আর হেরে চিনমু না? হে তো আমাগোরে ঘরের পোলা। নওরিজ মাহবুব খান।"
জিলেপির প্যাকেট হাতে নওরিজ চিন্তার সাগরে ডুবে। আশেপাশ নজর বুলিয়ে তখনকার লোকটাকে খুঁজে বেড়ায়। আশ্চর্য এখানেই তো ছিলো কই গেলো এই কয়েক মুহূর্তের মধ্যে? সূর্যালোকের তেজস্বী প্রকটে ঘাম ছুটেছে। ফর্সা নজরকাড়া মুখটা লাল হয়ে আছে রৌদ্দুরের হাতছানিতে। নওরিজ হাঁটা দেয় নিজ গাড়ির উদ্দেশ্যে। গরু হাঁটা যেতে দেরি হচ্ছে ক্ষণ। প্রতি মধ্যে কারো সাথে ধাক্কা লাগে। হাতের প্যাকেট ছিটকে পড়ে রাস্তায়। সাথে সাথেই মেজাজ গরম হয়ে আসে। কিছু বলবে তার আগেই অপরপক্ষের লোক খেঁকিয়ে ওঠে,
-" বা*ল চোখ আসমানে রাইখা হাটোস?"
মানবটার মুখ দেখে নওরিজ শান্ত চোখে চায়। বুকে হাত গুটিয়ে বলে,
-" আমি আসমানে রেখেই হাঁটি। তুই কোথায় রেখে এসেছিস চোখ জোড়া?"
মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া আলু গুলো ব্যাগে ভরে সিনান সালেহ। চেনা পরিচিত আওয়াজ শুনে মাথা তুলে তাকায়। নওরিজকে দেখেও ক্ষিপ্ত মেজাজ ঠান্ডা হয় না। তবে অল্প হাসার চেষ্টা করে বলে,
-" রিজ ভাই যে! তাড়াহুড়োয় ছিলাম। তবে দেখেই হাঁটছিলাম। আপনিই বেখেয়ালে হাঁটছিলেন। কোনো সমস্যা?"
পড়ে থাকা আলু তুলে রাখে নিজ ব্যাগে। জিলেপির প্যাকেট তুলে নওরিজের উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দেয়। নওরিজ হাতে নেয় না। সিনানের কাঁধ জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
-" সমস্যা তো বিশাল সিনান। মন্টুর দোকান থেকে জিলেপি আনলাম। চেনো তাকে?"
-" চিনি তো। ভালো করেই চিনি। চাচা হয়। বাড়িটাও খুব বেশি দূরে নয়। কেন বলেন তো?"
নওরিজ চমৎকার হাসলো। জবাব না দিয়ে বলে,
-" সম্পর্ক কেমন?"
-" সম্পর্ক বলতে আব্বার মামতো ভাই। তার সাথে মিল বেশ। কথাবার্তা হয়। বিয়ে অনুষ্ঠানে আব্বার দাওয়াত পরে এই যা।"
নওরিজ সিনানের কাঁধ জড়িয়ে হাঁটে। কালো চশমাটা খুলে বুক পকেটে ঝুলিয়ে নিয়ে চোখে হাসে।
••••••••
দিনপঞ্জি থেকে ফুরিয়ে গেছে কিছুদিন। বসন্তের হাওয়া হারিয়ে যাচ্ছে সাথে বৈশাখের তুখোড় মেজাজের আবির্ভাব। গত কাল বৈশাখে প্রথম বর্ষণে সরোজপুর স্নান সেরে নিয়েছে। লজ্জা ভেঙ্গেছে বর্ষণ কন্যার। এখন ঘনঘন দর্শন দিবে নির্লজ্জ কন্যা তছনছ করে দিবে ভয়ংকরী রূপে। গত রাতের মুসলধারে বর্ষণের পরও আজ মেঘমেদু গোমড়া মুখে। চারিপাশ কেমন আঁধারে ছেয়ে। এ ভোর যেন সাঝবেলা। সুরেলা কুপি জ্বালিয়ে ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে বসেছে। সম্মুখে নবম-দশম শ্রেণীর বাংলা বই। কুপির আলোয় গদ্য পাঠ করছে রমনী। আজ তাঁর বাংলা পরীক্ষা। বিদ্যালয়ে অর্ধবার্ষিক এক্সাম চলছে। ঝড়বাদল যাই হোক পরীক্ষা তো বাদ দেওয়ার অবকাশ নেই। সে সব গদ্যে চোখ বুলিয়ে নেয়। বইয়ের শেষ পাতায় বলকলমে ছোট্ট করে লিখে রাখে,
"অনুভূতির দরজায় খিল দিলাম। আবেগের ঝড়ে উড়ে বেড়ানো সুরেলা স্বীয় সুর হারিয়ে ফতুর।"
(২৪/ ৫/১২)
ছোট্ট করে তারিখটাও টুকে রাখলো। বই বন্ধ করে কুপি টেবিলের উপর রেখে বোরকা পরে রেডি হয়ে নেয়। দুইখানা কলম ও প্রবেশ পত্র জ্যামিতি বক্সের ভেতরে ভরে আটকে নেয়। কাঠের স্কেল সহ বক্সটা নিয়ে বেরোতে নিয়েও ফিরে আসে। ঘরের টিনের বাক্স খুলে ছোট্ট আয়নায় নিজেকে দেখে নেয় একপল। পাশের ঘরে চৌকিতে কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমন্ত ভাইকে দুয়েক বার ডেকেও সারা না পেয়ে বেরিয়ে আসে।
ঝাটা হাতে উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে শান্তি বেগম। সুরেলা তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে বলে,
-" মা? ইস্কুলে যামু আজ প্রথম পরীক্ষা। দোয়া করিস।"
-" আচ্ছা ভালো কইরা দিস। মনোযোগ দিয়া লেখিস। চিড়া ভিজা দিছিলাম গুঁড় দিয়া খাইছোস নি?"
-" হুঁ। মাচার উপর কলার ছড়ি..."
-" কলা খাইস নাই তো? কলা অশুভ হয়।"
সুরেলার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে শান্তি বেগম। সুরেলা ঠোঁট চেপে হেসে বলে,
-" খাই নাই।কোন অশুভ টশুভ না। আল্লাহর ফল অশুভ কেবা কইরা হইবো। আল্লাহর নামে খাইলে সবেতে রহমত আছে। যাই?"
-" যাই আবার কি? ক আসি?"
মায়ের কর্কশ গলায় সুরেলা তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে,
-" আচ্ছা তাইলে আসি?"
-' আচ্ছা। দেইখা শুইনা যাইস। ঝড় বাদলের দিন। কহন কি হয় সাবধানে থাকিস। একলা রুমে থাকবি না।"
শান্তি বেগমের মেয়েকে সাবধান করে দেয়। সুরেলা মাথা নেড়ে সায় জানালো। তবে যায় না। সেখানেই দাঁড়িয়ে কাঁচুমাচু মুখে। শান্তি বেগমের বুঝতে বাকি থাকেনা মেয়ের মতিগতি। ঝাটা ফেলে আঁচলের গিঁট খুলে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে মেয়ের হাতে ধরিয়ে দেয়।
-" তোগোর জ্বালায় কাছে কয়ডা ট্যাহাও রাখবার পারি না। যা ওহন? দাঁড়াই আছোস ক্যান?"
-" আরও দুই ট্যাহা দে না মা? ঝালমুড়ি আনমু নে তোর জন্যে!"
সুরেলার মিনমিনে সুর। শান্তি বেগম চোখ পাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলে,
-" তোগোর ফুটানি দেখলে গা জ্বলে। ভাত পায় না উনি ঝালমুড়ি গিলবো। নাই আমার কাছে যা ফুট?"
-" ভাইয়ের কাছ থাইকা আইনা দে?"
-" হ আমার পোলারে চুইষা খাবি সবাই ডাইনির মতো। গেদা আমার ঘুমে হের বাপে পকেট থেকে দুশো টাকা নিয়ে ফটুয়া হইছে। তুইও তাই কর গিয়া। যা?"
বলেই রাগে গজগজ করতে করতে উঠোন ঝাড়ু দেয়। সুরেলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মায়ের অহেতুক রাগের কারণ বুঝতে বাকি থাকে না। ভাই ঘুম থেকে উঠে টাকা না পেলে বাড়ি মাথায় তুলবে। আর মা জননী বাবার দোষ লুকিয়ে ভুজুং ভাং বুঝিয়ে সব নিজের উপর নিবে।
বাড়ির আঙিনা পার হয়ে কাঁচা রাস্তায় উঠলে পিছু ডাকে সুরেলা থেমে যায়। বগলে কালো রঙের ছাতা ঠেস দিয়ে ধরে রেখে শার্টের বোতাম আটকাতে আটকাতে এগিয়ে আসে সিনান সালেহ। ভাইকে দেখে সুরেলার অধরকোণে হাসি ফুটে ওঠে। সিনান রাস্তায় উঠে ছাতি ফুটিয়ে বোনের মাথার উপরে ধরে। গুড়ি গুড়ি ছন্দে বৃষ্টি পড়ছে।
-" চল আমি দিয়া আসি। বৃষ্টি নামবার পারে। রাস্তাঘাট ফাঁকা একা যাওন ঠিক হইবো না। শাপলা যাইবো না, পরীক্ষা নাই?"
সুরেলা ভাইয়ের বাহু জড়িয়ে ধীর পায়ে হাঁটে। কাঁদায় ভরপুর পিচ্ছিল রাস্তা। পড়ে টরে না যায়।
-" ওর দুপুর থাইকা। আমাগোরে সকালে।"
আর কথা হয় না ভাই-বোনের মাঝে। অন্য সময় হলে সুরেলা এটা ওটা বলে ভাইয়ের কাছে নিজ স্কুলের গল্পের ঝুলি খুলে বসতো। সেদিনের রাতের ভাইয়ের কথায় মনটা অভিমান করে বসেছে। যদিও পরদিন ভাই চেয়ারম্যান চাচার কাছে স্পষ্টভাবে মহির নামক লোকের প্রদত্ত প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। একেবারে মুখের উপর বলেছিলো,
-" আমরা গরিব তাঁর মানে এই না জেনে শুনে বোনকে দোজখের দিকে ঠেলে দিবো। বোনকে আজীবন নিজের কাছেই রেখে দিবো তবুও এমন নেশা খোর ছেলের হাতে তুলে দিবো না। গরীবের ঘরে জন্ম নিবার পারে চাচা তয় বোন আমার আদরের পুতুল।"
শাপলার মুখে শুনে সুরেলা আপ্লুত হয়ে পড়েছিলো। যেন নৈরাশায় ঢাকা নীলাম্বরে রৌদ্দুরের হাতছানি। তবে রাতের কথা ভোলে নি সুরেলা। তাই তো স্বাভাবিক তবে নীরব অভিমান। কিছু পথ অতিক্রম করার পর সিনান শুধায়,
-" স্কুলে কোনো পোলাপান বিরক্ত করে না তো?"
-" উঁহু"
-" করলে বলবি। ভয়ে লুকাবি না। যুগ জমানা ভালো না। পোলাগোর থাইকা দূরে থাকবি। সাথে খারাপ মাইয়া মানুষের লগে মিশবি না।"
মাথা নেড়ে সায় জানালো সুরেলা। হঠাৎ বজ্রপাতে চমকে মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে ভাইয়ের হাত খামচে ধরে। বৃষ্টি শুরু হয় ঝমঝমিয়ে। সিনান বেজায় চটে যায়। বৃষ্টি আসার আর সময় পেলো না! ধ্যাত বা*ল। এই বৃষ্টিতে ছাতাতে মাথা বাঁচলেও বাকি অঙ্গ বৃষ্টির সাথে ঠিকই আলিঙ্গন করে সে বোনকে আগলে রেখে দ্রুত পা বাড়ায়। তখনি হর্ণের শব্দে সিনানের মুখ বিহ্বর হতে নিঃসৃত হয় ভয়ঙ্কর গালি। রাস্তার সাইডে চলে যায়। একটা সাদা রঙের গাড়ি এসে থামে তাদের পাশে। গাড়ির গ্লাস অল্প খুলে কেউ বলে,
-" সিন ভাই? সুর আপু? ভিজে যাচ্ছো তো? ভেতরে আসো একসাথে যাই।"
তার মিহি গলার স্বর সুরেলা বা সিনান কারোরই অচেনা নয়। সিনান বোনের দিকে তাকায়। আধভেজা অবস্থায় কুঁকড়ে আছে। স্কুলে যেতে আরো ভিজে চুপচুপে হয়ে যাবে। কাঁদা মাটির কথা বাদই থাকলো। তবুও স্বীয় ঔদার্যে স্থীর থেকে বলে,
-" ধন্যবাদ কিন্তু তাঁর দরকার নাই। ছাতি আছে সাথে। আপনারা যান।"
গাড়ির সামনের আসন থেকে কাঁচ নেমে আসে। রওশন মাহবুব গলা খাঁকারি দিয়ে ধমকে বলে,
-" শা*লা তোরে উঠতে বলছি নাকি? তুই ভিজে মোরগ হয়ে বাড়ির পথ ধর। সুরেলা তুমি এসো? পেছনে রূপসার পাশে বসো।"
ঘার ত্যাড়া সিনান তবুও রাজি হয় না। এদিকে বৃষ্টির সাথে দমকা হাওয়ার মেলা বন্ধনে পরিবেশ যেন আরেকটু খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিশোরী রূপসা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে ডাকছে দু'জনকে। রওশনও বন্ধুর ত্যাড়ামির জন্য বকে যাচ্ছে। সিনান এবার একটু দমে যাবে তখনই গমগমে আওয়াজ ভেসে আসে,
-" নাটক লাগিয়েছিস তোরা? সিনান, আমি এক কথা একবারই বলতে পছন্দ করি। ভদ্রলোকের মতো বোনকে নিয়ে ভেতরে আয়। ওয়েদার খারাপ এমনিতেই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে সে। এক্সাম দিবে কিভাবে? নাক টানছে। আরো ভিজলে জ্বর হবে। বাকি এক্সাম দিবে কিভাবে?"
সিনান ছোট্ট শ্বাস ফেলে বোনকে ইশারা করে ভেতরে ঢুকতে। রূপসা হাসি মুখে দরজা খুলে দিয়েছে। তবে বাঁধ সাধলো স্বয়ং সুরেলা। ভাইয়ের বাহু শক্ত করে চেপে বলে,
-" ভাই হেঁটেই যাই। গাড়িতে উঠি নি কখনো। বমি হতে পারে। আর ভিজে তো গেছিই। আরেকটু ভিজলে কিচ্ছু হবে না।"
-" ফকিন্নীর ঝি, আমার হাতের থাপ্পড় খেয়েছিস কখনো? আরেকটা কথা বললে স্বাদ কেমন বুঝিয়ে দিবো। ওঠ?"
গাড়ি হতে কড়া গলায় ধমক ভেসে আসে। সুরেলা দাঁতে দাঁত চেপে ভাইয়ের দিকে তাকায় অসহায় চোখে। সিনানও ব্যাপারটা সহজে নিলো না। থমথমে গলায় বলে,
-" রিজ ভাই? আমার বোন আমার ভাঙা কুটিরের রাজকন্যা। আমি ধমকাবো বকবো কারণ আমার চোখের নয়ন সে। অন্য কেউ ধমকাবে মেনে নিবো না। ভুল কিছু বললে মাফ করবেন।"
কয়েকপল নিস্তব্ধ দেয়ালে ঢেকে যায় আসপাশটা। বৃষ্টির রুম ঝুম ছন্দপতনে সুরেলা তান ভেসে বেড়ায়। এক পল, দুই পল, তারপর চলে যায় গাড়ি শা শা করে। কাঁদা এসে ছিটকে লাগবে এমন মুহূর্তে সিনান বোনের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। কাঁদা পানিতে মেখে যায় তনু। দাঁত কিড়মিড় করে খেঁকিয়ে বলে,
-" শা*লা সম্বন্ধির দল!"
•••••••••••
খান বাড়িতে উৎসব মহল পরিবেশ বিরাজমান। বাড়ির মেয়েরা শ্বশুরালয় থেকে বাড়ি ফিরেছে বলে কথা। নোমান মাহবুবের বড় মেয়ে নওরিন জাহান। প্রায় নওরিজের সমবয়সী। বছর দেড়েক ছোট বড় হবে। ছাব্বিশ উর্ধ্ব রমনী চেহারায় গুনে গানে মায়ের ছোঁয়া পেয়েছে। মায়ের চোখের তারা বলা যায়। তাঁর বছর দেড়েক বড় নওরিজ মাহবুব; না মায়ের হাবভাব পেলো ,না বাবার। তবে নোমান মাহবুব মাঝে মাঝেই গর্বের সাথে বলেন, ছেলের মাঝে ওনার বাবার প্রতিচ্ছবি খেলে যায় ক্ষণে ক্ষণে। বাড়ির আরেক মেয়ে ছবি। বয়স খুব বেশি নয়। বিশ পেরিয়ে একুশ হবে। অথচ সংসার জীবন তিন বছর গড়িয়েছে। সাত মাস উঁচু পেট নিয়ে সেও এসেছে বাবার ভিটায়। এসেই মায়ের গলা জড়িয়ে একদফা কেঁদে ভাসিয়েছে। বড় চাচির গলা জড়িয়ে কান্নার সুর তুলবে রমজান মিয়া বিরক্তির সুরে ধমকে থামান। নওরিনের স্বামী ইকরাম উল্লাহ হেসে বলেন,
-" আরে ছোট শশুর মশাই বকছেন কেন শালী সাহেবানকে? এতোদিন পর এলো একটু কান্নাকাটি কিছু্ই না। লাস্ট মে বি গত ঈদে এসেছিল। তাও একদিনের জন্য। ছবির হাসবেন্ড সেলিম তো তাড়ার উপর বসে ছিলো। মেয়েটা প্রানখুলে দুদন্ড গল্প আবদি করতে পারে নি। অথচ নওরিন কমপক্ষে দু মাস অন্তর অন্তর এসে তিন চার দিনের দেখা দিয়ে যায়। দাদা শ্বশুরের মৃত্যুবার্ষিকীতে আসতে পারে নি বলে কি রাগ তার। তাও বাচ্চাগুলো কে পাঠিয়েছে। কই আমার বাচ্চারা? ইয়ামিন? ইকরা?"
বলেই নিজ জমজ দুই বাচ্চাকে কাছে ডাকে। নওরিনও এদিকে ওদিকে তাকিয়ে খোঁজে নিজ সন্তানদের। জমজ ছেলে মেয়ে তাঁর; বয়স আট গড়াবে।
সুন্দর মায়াময় চেহারার অধিকারীনি ছবি ভেজা চোখ মুছে মা ছামিনা বেগমের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-" বড় আব্বাজান, রিজ ভাই, ভাইয়া, রূপ কাউকেই দেখছি না ওরা কোথায়? আমি আসবো বলো নি?"
রেবেকা বানু এগিয়ে এসে ভাতিজির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-" রূপসা পরীক্ষা দিতে গেছে।তোর ভাই বাজারে বেড়িয়েছে, আদরের বোন আসবে বলে কথা। রিজের কথা আর কি বলি। ছেলে কি করে নিজেই জানে। তুই বল? জামাই এলো না কেন?"
-" ওনার কথা বাদ দাও তো। সবসময় কাজ আর কাজ। বড় আম্মা? লম্বা সময় নিয়ে এসেছি কিন্তু! রিজ ভাইয়ের বিয়ে না খেয়ে যাচ্ছি না। ছেলেকে আধবুড়ো করে রাখায় পরিকল্পনা করছো না তো?"
অতি সন্তর্পণে কথার মোড় ঘুরিয়ে দেয় ছবি। রেবেকা বানু ছেলের কথা আশায় আর কিছু মনে আনেন না। ছেলের কথা বলতে ভদ্রমহিলা কখনো বিরক্ত হন না। ছামিনা বেগম মলিন চোখে মেয়ের শুকনো ভাঙা চোরা মুখটা দেখে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। রমজান মিয়া ইকরাম উল্লাহর সাথে কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নওরিন ছেলে মেয়ে দু'টোকে খুঁজে বেড়ায় সর্বত্র। ছেলে মেয়ে দু'টো এমনিতে খুব ভদ্র তবে নানার বাড়ির এলে তাদের ভদ্রতা যেন গিরগিটির মতো রঙ বদলে ফেলে।
•••••••••••••
-" এই মুক্তা? ছোট প্রশ্ন, 'মমতাদি' বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন নাকি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়? আসলে বন্দোপাধ্যায় নিয়ে কনফিউজড। বল না ভাই?"
-" আমি ওটা দিই নি সুর। স্যার আসছে সোজা হ।"
সোজা হয়ে বসে সুরেলা। ইচ্ছে করে বেঞ্চে মাথা ঠুকে ঠাস করে অজ্ঞান হতে। সকালেই সব রিভিশন দিয়ে এলো অথচ এখন মনে আসছে না। সামনে বেঞ্চে বসা মুক্তা লিখেছে এই উত্তরটা। সে আবছা একটু দেখেছে উঁকি দিয়ে। তবে শয়তান মেয়ে বলছে না। অথচ সে মুক্তাকে কতগুলো ছোট প্রশ্ন দেখালো। মিরজাফরের দল!সে প্রশ্ন আঁকি বুকি করে। সময় যে নেই। সতর্ক ঘন্টা বেজেছে। আর মাত্র পনেরো মিনিট। ওদিকে স্যার এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন সমস্ত নকল সেই করছে। সুরেলা সামনে দৃষ্টি স্থীর রেখে কন্ঠ খাদে নামিয়ে পাশে বসা হাবাগোবা গোছের ছেলেটাকে শুধালো,
-" তুমি জানো?"
-" শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হবে না?"
ছেলেটা সায় জানিয়ে জবাবে উল্টো প্রশ্ন করে। সুরেলা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-" আহম্মক শরৎ কাকা শ্রী অভাগীর স্বর্গ লিখেছেন।"
সুরেলা চোখ বুজে দু'টো আঙ্গুলে দু'জনের নাম নির্ধারণ করে কামড় বসায়। যেটায় ব্যাথা পেলো সেই আঙুলে নির্ধারিত নামটা বিসমিল্লাহ বলে উত্তরপত্রে লিখে দেয় সুন্দর করে। জ্যামিতি বক্স গুছিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বেরিয়ে আসে পরীক্ষার কক্ষ হতে। নিচ তলায় বান্ধবীর কক্ষের সামনে গিয়ে ইশারা করে। দু'জনের মেলা বন্ধন দেখো? বান্ধবীও তাকায়।সুরেলা ইধারায় জলদি খাতা জমা দিয়ে বের হতে বলে। মারিয়া দেরি করে না। জমা দিয়ে বেরিয়ে আসে হাস্যোজ্জ্বল মুখে। বান্ধবীর বাহু জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
-" পেপার কেমন দিলি রে সুর?"
-" একবারে ফাটাই ফেলছি। স্যার নম্বর দিতে বাধ্য। সুকুমার মামার ছায়াবাজি পুরোটা মুখস্থ ছিলো লিইখা দিছি সুন্দর করে,
আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা _
ছায়ার সাথে কুস্তি করে গাত্রে হলো ব্যথা!"
দুই লাইন আবৃত্তি করে শোনায় সুরেলা। আত্মবিশ্বাস তার আকাশচুম্বী। সেই আত্নবিশ্বাসে জল ঢেলে দেয় মারিয়া। হেসে বলে,
-" গাধী কবি আর পাঠ পরিচিতি লিখতে বলছিলো। তুই কবিতা লিখে দিছোস। নাম্বার স্যার দুই এক ধইরা দিবো নে।"
সুরেলার মাঝে কোনো রূপ চিন্তার অবকাশ খুঁজে পাওয়া যায়। হাসিমুখে হাঁটে। কবিতা আর কবির নাম ছাড়া কিছুই জানে না। তাই যা মন চেয়েছে লিখে এসেছে। স্যার নম্বর দিলে দিবে নইলে না। স্যারের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার স্যাপার। বড় কালো ঘটকদের ছাতা হাতে সুরেলা বান্ধবীকে বগল দাবা করে মাঠে নেমে পড়ে। মাঠে জমায়িত গোড়ালি অবদি বৃষ্টির পানিতে হেঁটে যাবে দুই সখি। এখন বৃষ্টি নেই। তবে মাঠে পানিতে নামার আগেই সুরেলার চোখে পড়ে গেইটের কাছে একজোড়া লাল চোখ। ভয়ে অন্তরাত্মা যেন অল্প হলেও ছ্যাত করে ওঠে। বান্ধবীকে বগল দাবা করে উল্টো পথে পা চালায়। মারিয়া 'কি হয়েছে?' বলে কানের পোকা বের করলেও সুরেলা কিছু বলে না। পেছনের গেইট দিয়ে বেরিয়ে এসে বান্ধবীকে জানায়,
-" কিছু হয় নি। পানিতে জোঁক থাকবার পারে। আর তুই তো জোঁক রে জমের লাহান ভয় পাস। তাই তোর কথা ভাইবা শখ কবরে পাঠাইলাম"
প্রাণপ্রিয় সখির কথায় ভেংচি কাটলো মারিয়া। নেকাবের আড়ালে তা দেখতে না পেলেও বান্ধবীর মনোভাব বুঝতে সময় নেয় না সুরেলা। বাহু জড়িয়ে বলে,
-" রাগ করিস না সই। চল তোরে দিদির দোকানের প্রেম কালাই কিনা খাওয়ামু সই।"
মারিয়ার তীক্ষ্ম নজর দিদির দোকানের পেছনে দু'জন মানব মানবীর উপর। তাদের শ্রেনীর এক ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণীর মেয়ের সাথে চুপি চুপি কথা বলছে। মেয়েটা লাজুক হাসছে আর ভয়ে ভয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। মারিয়া বান্ধবীকে কনুই মেরে ইশারায় দেখায়। সুরেলা দুঃখি মুখ বানিয়ে বলে,
-" ওটা তো সোহাগ। পোলা সবসময় ক্লাসে ফাস্ট হয়। আবার পিরিতও চালায়। বহুত চালু মা"ল। আর আমরা আকাইম্ম্যা না পড়ালেখা করি, না পিরিতি। এই জীবন পুরোটাই বেদনার!"
বলেই দু'জন হাসিতে ফেটে পড়ে। লুকিয়ে প্রেমালাপ চালিয়ে যাওয়া কপোত যুগলের আলাপে বিঘ্ন ঘটে। মেয়েটা উল্টো পথে চলে যায় হনহনিয়ে। ছেলেটা মাথা চুলকে লাজুক হাসে। তবে তাঁর হাতের আঙুলের ভাঁজে সিগারেট দেখে সুরেলা অবাক হয়। যতদূর জানে সোহাগ ছেলেটা অতিমাত্রায় ভদ্র। তাদের এলাকারই। দরিদ্র পরিবারের একমাত্র ছেলে। অন্যের জমিবগরা চুক্তিতে চষে বেড়ানো কৃষক বাবার একমাত্র আশা। ছেলেটাও তুখড় মেধাবী। সেই ছেলেটির হাতে কলমের বদলে সিগারেট মোটেই মানাচ্ছে না যে।
স্কুলের পেছনের সরু রাস্তা পেরিয়ে কাঁচা রাস্তায় আসতেই খেয়াল করে পেছনে সেই লাল চাহনি নিক্ষেপ করা মানব ধেয়ে আসছে। সুরেলা বান্ধবীর হাত শক্ত করে ধরে। মারিয়ার ওতশত খেয়াল নেই। আপন মনে গল্প করে বান্ধবীর হাত ধরে হাঁটছে। সুরেলা শুকনো ঢোক গিলে পায়ে পা মেলায়। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই চেনা মুখ দেখে যেন স্বস্তি ফিরে পেলো। অজান্তেই অধর কোণে হাসিরা লুকোচুরি খেলে যায়। পায়ের গতি বাড়িয়ে ছুটে যায়। মারিয়া বান্ধবীর হাবভাব লক্ষ্য করে টিপ্পনী কেটে বলে,
-" দেখেই এতো এনার্জি এলো পাটখড়ির মতো শরীরে। বান্ধবী তুমি বহুত চালু মা*ল। বেস্ট অফ লাক।"
সুরেলা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। নিজ কান্ডে লজ্জা পায় খানিকটা। সকালেই না অনুভূতির দরজায় খিল এঁটে দিলো! কে জানতো, মানবকে দেখে অনুভূতিরা বেইমানি করে বসবে। হাঁটার গতি কমিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলে,
-" আজগুবি কথা বলবি না। রিজ ভাইয়ের সাথে শফি আছে। নিশ্চয়ই ভাই পাঠাইছে আমারে নিতে।"
-" হ্যাঁ জানি তো। তুই তোর রিজ ভাইয়ের জন্য ছুটছিস বলেছি আমি?"
বান্ধবীর হেয়প্রতিপন্নতায় সুরেলা চোখ পাকিয়ে দূর হতেই ডাক দেয় শফিকে। শফি হেসে হাত নাড়িয়ে কাছে ডেকে বলে,
-" সুর আপা জলদি আহো। দুলাভাই কহন থাইকা অপেক্ষায় আছে!"
শফির কথা শুনে মারিয়া হা করে চায় বান্ধবীর দিকে। সুরেলা অসহায় চোখে তাকিয়ে মাথা নেড়ে না বোঝায়। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে খুঁতখুঁতে লাট সাহেবের চ্যালারা দাঁড়িয়ে দাঁত দেখাচ্ছে। সে হনহনিয়ে শফির কাছে গিয়ে মাথায় জোরে চাটি মেরে বলে,
-" কারে দুলাভাই কস? আমি কিন্তু ভাইরে কইয়া দিমু শফি।"
শফি কাঁচুমাচু মুখে তাকায় রিজ ভাইয়ের দিকে। একদিকে বাঘ অপর দিকে সিংহ। কার দলের হয়ে কথা বলবে সে?সে কিছু বলবে তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রাশভারী গলায় বলে,
-" তোর তাঁর ছেঁড়া ভাইকে দেখে তো আমি নওরিজ মাহবুব খানের হাঁটু কাঁপা কাঁপি অবস্থা সুর । এই শফি এখনি ফিট না খাই! যা তো অ্যাম্বুলেন্স ডেকে নিয়ে আয়।"
সাথে সাথেই হাসির রোল পড়ে; শফি, মারিয়া সহ নওরিজের সাথে আসা লোকজন। শুধু দু'জনের মুখে হাসি নেই। সুরেলার চোখে মুখে চিনচিনে রাগের ছবি। সম্মুখের বলিষ্ঠ মানবের চোখ মুখ গাম্ভীর্যে ঠাসা।
.
.
.
চলবে........................................................................