শুভ্র ফতুয়ায় এক যুবা জারুল গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। তাঁর মোহিত দৃষ্টি সম্মুখে কিশোরীতে আঁটকে রাখা হয়েছে জোরজবরদস্তি। সে চাইলেও নজর সরাতে পারবে না। এক স্নিগ্ধতার ভোরে বিভোর এক টুকরো শুভ্র মেঘ। অম্বরে মিষ্টি রৌদ্দুরের হাতছানি দিচ্ছে শ্যাম বরণে। কাজলে আঁকা ওই মনোমুগ্ধকর চোখে সেই দ্যুতি প্রণয়ের তুফান ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভিজে ওষ্ঠাপুট ভুবন মোহিনী মায়ার ইন্দ্রজালের স্বপ্ন বুনে যায়। দু ভ্রু দ্বয়ের ঠিক মাঝখানের ছোট্ট কালো তিলটা শ্যামবরণ মুখটাকে সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পতিত করে। কব্জিতে খেলে বেড়ানো শুভ্র রেশমী চুরি, শ্যামল হ্যাংলা পাতলা দেহখানা শুভ্র কামিজে ঢাকা। পিঠ ছড়ানো কালো মিচমিচে চুলের নেশাতুর ঘ্রাণে মৃত্যু নিশ্চিত। দু হাত মেলে কিশোরী ঘুরছে আপন গতিতে। হাসছে মিঠিমিঠি। যুবার গম্ভীর মুখে হাসিরা লুকোচুরি খেলে যায়। কিশোরীর হৃদয় বরাবর সেই হাসি বিঁধে যায়। ত্রিকোণ মোচাকার যন্ত্রে ধ্বক ধ্বক শব্দ বেড়ে যায়। হাসিমুখে ছুটে আসে কিশোরী। যুবকটি হাত বাড়িয়ে দেয়। দু'জনের হাতের স্পর্শে যেন প্রকৃতি গেয়ে উঠলো। দুই পাক ঘুরে এসে কিশোরী শুভ্র সুদর্শন মানবের বুকে দুই হাত রেখে তাকিয়ে রয় পলকহীন। মানবটি হারিয়ে যায় সেই সাধনে।
আচানাক হাত সরিয়ে চোখ খুলে তাকালো নওরিজ মাহবুব খান। অধরকোণে পরিস্ফুটিত হয় এক মিহি হাসির দানা। পালঙ্কে চিৎ হয়ে শুয়ে সেই মানব দুই হাত ছড়িয়ে মিহি সুরে বলে,
-" সুরেলা , আমি রিজ যতটা যাতনায় পুড়ছি ঠিক ততটুকুই ফিরিয়ে দিবো। উম.. নাহ্ কিঞ্চিত বেশি পুড়াবো ডার্লিং।"
বিছানা ছাড়লো নওরিজ মাহবুচব। আলমারি হাতরিয়ে খুঁজে খুঁজে শুভ্র শার্ট খানা গায়ে জড়িয়ে নেয়। টেবিলের সম্মুখে চেয়ার টেনে বসে। কলমদানি হতে একখানা কালো বলপেন, কাগজ খুঁজে একখানা শুভ্র কাগজে গোটা হাতে লিখে যায় যায়,
জনাবা সুরেলা,
সালাম নিও। কেমন আছো? নিশ্চয়ই রেগে আছো আমার উপরে? আমার মজার ছলে বলা শব্দ দু'টোয় দুঃখ পাও জানলে, শব্দ ভান্ডার হতে সেই শব্দ দু'টোকে বিলীন করে দিতাম। রৌদ্দুরে ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে, তোমাকে পাবো না গো বলো? নাকি জারুল গাছের নিচে দু'কান ধরে উঠবস করতে হবে? যাও তোমার জন্য না হয় দুই হাঁটু জমিনে ফেলে দুইহাত মেলে বুক চিরিয়ে ভালোবাসা জ্ঞাপন করে পুষ্প অর্পন করলাম। পরিশেষে বিনীত প্রার্থনা, বিশাল অপরাধ টুকুর করিও মার্জনা।
ইতি
এক নিরংকারী প্রেমিক
(২৭/৫/১২)
কাগজ খানা অতি যত্নসহকারে ভাঁজ করে। রুষ্ট শুকনো অধর ছুঁয়ে দেয়। সাদা খামে ভরে বেলকনিতে যায়। হাত বাড়িয়ে বাড়ির আঙিনায় লাগানো শুভ্র গোলাপ ছিঁড়ে নেয়। নাক টেনে সুবাস নিয়ে শ্বাস ফেলে। খামে ভরে রেখে দেয় বুক পকেটে। এলোমেলো কৃষ্ণ কালো চুলে এক হাত ডুবিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়। কল্পনায় আয়নায় প্রতিবিম্বের পাশে আরেকটা প্রতিবিম্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হৃদয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।
রেবেকা বানু দুই নাতি নাতনির সাথে বসে বসে টিভিতে সিসিমপুর দেখছেন। ইকরা হেসে বলে,
-" নানু, ইকরা আর ইকরি! আমাদের দু'জনের নামে কত মিল তাই না?"
রেবেকা বানু সায় জানায়। ইয়ামিন নানুর আরেক হাত ধরে বলে,
-" আমার নামের সাথে মিল নেই কেন?"
-" তোকে আজ থেকে হালুম বলে ডাকবো। তাহলে হলো না মিল?"
ইয়ামিন খুশি হয়ে যায়। নোমান মাহবুব খবরের কাগজ হাতে মুচকি হাসলেন। চশমাটা খুলে পকেটে রাখেন। খবরের পাতা ভাঁজ করতে করতে বলেন,
-" হালুম? যাও তো তোমার বড় মামাকে ডেকে আনো। বলবে আমি ডাকছি এক্ষুনি আসতে।"
ইয়ামিন তবুও ঠায় বসে থাকে টিভির সম্মুখে। ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট সে যাবে না। রেবেকা বানু জানায় সে ডেকে আনছেই। তবে এর মাঝেই বসার ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে নওরিজ জবাব দেয়,
-" কাউকে ডাকতে যেতে হবে না। আমিই এসেছি। আব্বা কিছু বলবেন?"
নোমান মাহবুব উঠে দাঁড়ালো। ছেলের পিঠ চাপড়ে বেরিয়ে আসে। নওরিজ বাবার পাশে হাঁটে পকেটে হাত গুটিয়ে। নোমান মাহবুব বলেন,
-" গ্রামের দু'টো ছেলে মেয়ে কে হাতেনাতে ধরেছে গ্রাম বাসী। মেয়েটাকে দু'টো তিনটে চর থাপ্পড় দিলেও ছেলেটাকে আধমরা করেছে। সেটা নিয়েই শালিশ বসেছে। এইসব ছোট খাট বিষয়ে আমি যাই না। তবে ছেলেটার বাবা এসে পায়ে পড়ে কেঁদে দিলো কিছুক্ষণ আগেই। গরীব বাবার ছেলে। মেয়েটা মন্টুর কেমন যেন আত্মীয় হয়। মন্টুকে তো চেনেন। চেংরা মুরুব্বি গিরি ভালোই করে। সবাই মান্যও করে। তাই ছেলেটাকে তো এমনিতেই ছেড়ে দিবে না। আমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না তবে ছেলেটার বাবা এমন ভাবে পা জড়িয়ে মরা কান্না জুড়ে দিলো আমার মনটাও নরম হলো।আমি যেতে পারবো না তবে আপনি কষ্ট করে একটু সামলে নিবেন। আজ দশটার দিকে বসবে বিচার সভা।"
নওরিজ মাহবুব টুকটাক তথ্য সংগ্রহ করে বাবাকে আশ্বাস দেয় সে সামলে নেবে সবটাই। দু'জনে হাঁটতে হাঁটতে পুকুর ঘাটে চলে আসেন। তিন-চার জেলে এসেছে। পুকুরে চুন প্রয়োগ করছে। সে জেলের সাথে কথা বলে গোয়াল ঘরে যায়। আঠারোটা গরু তোলা হয়েছে খামারে। পাঁচটা ষাঁড় বাকি গুলো বকন গরু তন্মধ্যে শুধু একটা গাই। এখানে আনার পরদিনই বাছুর দিয়েছে। বিশাল দেহি অস্ট্রেলিয়ান গাই হতে বেশ রুষ্ট পুষ্ট বাছুর। তাকে খামারে আটকে রাখা দায়। গলা ফাটিয়ে ডেকে যাবে ভঙ্গুর স্বরে। ছেড়ে দিলে পুরো আঙিনায় নেচে কুদে বেড়াবে। সাথে গলায় ঝুলন্ত ঘন্টি'টা টুংটাং বেজে চলে অনবরত। ইকরা, ইয়ামিন তো খুশিতে তাঁর পিছু ছোটে। তাদের দিকে তেড়ে এলে ভয়ে জানহারা। নওরিজ খেয়াল করে গাই গরুটার কাছে বাছুর ছোটাছুটি করছে। মা'য়ের গা বেয়ে উঠছে। সে খামারের দরজা খুলে দিতেই বাছুর ছানা যেন মুক্ত স্বাধীন বিহঙ্গের নেয় উড়াল দিলো। এক ছুটে চলে গেলো বাগানের দিকে। গোয়ালি হেসে বলে,
-" বাছুরডা একদন্ডি স্থির থাকবো না। ছাড়া পেলে আর মায়ের কাছ ঘেঁষবো না। যহন পেটে তাও লাগবো আইবো তার আগে না!"
-" চাচা? বাছুর না ডেকে ওকে একটা সুন্দর নাম দিতে পারেন।"
নওরিজের কথায় লোকটা প্রসন্ন হেসে গলার গামছা মাথায় বেঁধে বলে,
-" নাম তো একটা ভাবছিই বাজান। বাহাদুর নামটা ভালা না?"
নওরিজ ছোট্ট করে সম্মতি জানালো। বাকি গরুর দিকে তাকিয়ে দেখে গা গতরে গোবরে মেখে আছে। সে কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-" ওদের গায়ে তো গোবর লেগে আছে। মাছি ভোঁ ভোঁ করছে। মশার উপদ্রবও বেশি। মটর সেট করে সব কটাকে গোসল করিয়ে দিন চাচা। আর দিনে তিনবার রাতে দুবার গোবর পরিষ্কার করে যাবেন তাহলে আর গা নোংরা হবে না।"
রহমত আলী আমতা আমতা করে। গরু যেদিন আনা হলো সেদিনই সাবান পানিতে গোসল করে খামারে তোলা হয়। খুব বেশি দিন হয় নি। আবার গোসল? সবকটারে ঠান্ডায় না ধরে। সে কিছু বলবে তার আগেই রওশন এগিয়ে এসে বলে,
-" এক কাজ করতে পারো রিজ ভাই। তুমি যেমন দুবেলা গোসল করো গরুদেরকেও করিও । তাও নিজ হাতে। রহমত চাচা তুমি সাহায্য করবা না কিন্তু? আর একটা ভালো বুদ্ধি দিই। গরুর পাছায় টোপা বেঁধে রাখ। যেন নাদা'র সাথে সাথে টোপার ভেতর ল্যান্ড করে। মুতুর গন্ধ দূর করতে কি করা যায় বড় আব্বা?"
নোমান মাহবুব হেসে ভাতিজার কান টেনে চলে যান। যাওয়ার আগে ছেলেকে আবারও স্মরণ করিয়ে দেন দরবার সভায় যেন উপস্থিত হয়। রওশন কফির মগে ঠোঁট ডুবিয়ে মিটিমিটি হেসে ভাইয়ের দিকে তাকায়। কফির মগ বাড়িয়ে বলে,
-" ওমন করে তাকিয়ে আছো কেন? খাবে কফি? নাও ধরো! আমি শুধু পাঁচ বার চুমুক বসিয়েছি। তবে হলফ করে বলতে পারি এ কফি এঁটো নয়।"
নওরিজ নেয় কফির মগ। রওশন বিস্ময়কর চাহনি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে। রিজ ভাই তাঁর এঁটো খাবে এটা হজম হচ্ছে না! নওরিজ কফির মগ উবু করে গরুর খালি চারিতে ঢেলে দেয়। আড়িল গরু চেটে চেটে খেতে লাগল।
-" ভাই তোমার গরু গুলোকে সকাল বিকাল গরম কফি দিতে পারো। ক্যালরি পাবে। তোমার বুক পকেটে সাদা কিসের খাম ওটা?"
নওরিজের সাদা শার্টের পকেটে খামের বাড়ন্ত অংশ দেখে শুধাল। নওরিজ কিছু বলবে তার আগেই রওশন কেড়ে নেয় খাম খানা। হেসে খামের ভেতর হতে ফুলটা বের করে বলে,
-" বাহ্ খামে সাদা গোলাপ। তার মানে নিশ্চয়ই এটা লাভ লেটার? তবে নিরামিষ খুঁতখুঁতে রিজ ভাই আমার, লাল গোলাপ দিতে হয় প্রেয়সীকে। এই তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি? কখনো জানাও নি তো?"
নওরিজের গম্ভীর মুখে হাসিরা পরিস্ফুটিত হয়। ভাইয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-" গার্লফ্রেন্ড নেই তো। একটা না হওয়া বউ আছে। শিঘ্রই বউ বানিয়ে ঘরে তুলবো।"
রওশন ছোট ছোট চোখে চায়। তাঁর নিরামিষ খুঁতখুঁতে ভাইটাও হৃদবাড়ির দেয়ালে ছবি এঁকে যায় গোপনে। সে গলা খাঁকারি দিয়ে খাম হতে ভাঁজ কৃত অর্ধেক কাগজ বের করে ভাইয়ের দিকে তাকায়। এক ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,
-" ছোট ভাইয়ের পড়ার উপযোগী হবে তো? অতি প্রাইভেট কিছু?"
নওরিজ মৃদু হাসে। রওশনের হাত থেকে শুভ্র ফুলটা হাতে নেয়। সে জানে সে পড়তে বললেও রওশন পড়বে না। এতোটা ভদ্রলোক ছেলেটা। রওশন কাগজ পুনরায় খামে ভরে ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দেয়।
-" কি না কি লিখেছো! পড়ে আমি লজ্জায় পড়তে চাই না বাপু! তবে অনুরোধ করবো জলদি ভাবীকে ঘরে তুলে আনো। আমার বিয়ের বয়সটা পেরিয়ে যাচ্ছে; সাথে তাঁরও। তাঁর বাপে নিত্যনতুন ছেলে ধরে আনে যে।"
নওরিজের কপালে ভাঁজ পড়ে। কিছু বলবে আগমন ঘটে জাফর নামক এক যুবকের। নওরিজের সাঙ্গপাঙ্গদের মধ্যে শিক্ষিত আর গুনী একজন। তেজী স্বভাবের ছেলেটা এসেই যান্ত্রিক মানবের মতো সালাম প্রদর্শন করে ভনিতা ছাড়াই বলে,
-" রিজ ভাই, ওই গাঁজা খোরের নাম রাম আবার অনেকেই বলে আফাজ। নিজেকে হিন্দু বলে দাবি করে আবার বিয়ে বাদাড়ে গরুর মাংস খায়। বাড়ি বাড়ি কালেমা পাঠ করে ভিক্ষা করে, মুসলিম হিসেবে। আবার মন্দিরেও প্রসাদ খায়। লোকের কাছে শুনেছি, রাম নেশায় ডুবে থাকে সবসময়। বউ সংসার ছিলো। একটা ফুটফুটে মেয়েও ছিল নাকি। পরে নেশায় এমন বুঁদ হয় সোদবুদ্ধি হারিয়ে পাগলের খেতাব অর্জন করে বউ সংসার সবই জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। পাশের গ্রামে পুরনো দাস বাড়ীতে যাতায়াত করে। দামিনীর সাথে নাকি কানেকশন আছে।"
-" দামিনী কে? আর রাম কে আমিও চিনি। দাদাজানের মৃত্যুবার্ষিকীতে এসেছিলো তো। পুরো চার প্লেট ভাত খেয়েছিলো। মাংসতো ছিলোই। খাচ্ছিলো আর বলেছিলো তিন দিন হলো নেশা পানি ছাড়া কিছুই খায় নি। আর রিজ ভাই তুমি রামের খোঁজ নিয়ে কি করবে?"
রওশন একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকে। নওরিজ মাহবুব বিরক্ত হয়ে বলল,
-" আছে দরকার। তোর মাথা ঘামানোর দরকার নেই রওশন। কফি আন গিয়ে আমার জন্য ;এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। তুই না আসলে রূপসাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিস। আর হ্যাঁ কফির মগ যেন ঢাকা থাকে।"
রওশন অমান্য করে না তাঁর কথা। চলে যায় খালি মগ হাতে। যেতে যেতে শুনতে পায় নওরিজ মাহবুব বলছে,
-" দামিনী নামটা চেনাজানা মনে হচ্ছে। কে সে? তাঁর ডিটেইলস জানো? আর রামের সাথে মন্টুর কিসের সম্পর্ক? দামিনীর সাথে মন্টুর কোনো প্রকার কানেকশন.."
আর কানে ভেসে আসে না। রওশন শোনার চেষ্টাও করে না। ওসবে তাঁর মাথা ব্যথা নেই। সে নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। প্যাঁচ কোচ মাথায় খেলে না খুব একটা। সে সোজা বাড়িতে ঢুকে রসুই ঘরে যায়। ভাগ্যক্রমে রূপসা সেখানেই পিঁড়িতে বসে আছে গালে ভাত নিয়ে। তাঁর মা খাইয়ে দিচ্ছে আদরের মেয়েকে।
-" এই রূপ? রিজ ভাই কফি দিয়ে আসতে বললো। খামারের দিকটায় দাঁড়িয়ে।"
ভাইয়ের হুকুমে রূপসার চোখে মুখে বিরক্তি। গালের ভাত চিবিয়ে বিনুনি নাড়াচাড়া করতে করতে বলে,
-" পারবো না আমি। মহারাজের হাজারটা নক্কর চক্কর। কফি নিয়ে গেলে একটুও খাবে না। বলবে আমি নিশ্চয়ই চুপিচুপি ওই মগে কফি খেয়েছি।"
ছামিনা বেগম হাসেন। উনুনে কাঠ খড়ি ঠেলে রেবেকা বানু হেসে বলেন,
-" ছোট বেলায় একবার খেয়েছিলি তো। ভরা এক মগ কফি পাঠিয়েছিলাম ঢকেঢকে খেয়ে তলানিতে অল্প একটুখানি নিয়ে রিজকে দিয়েছিলি। তাই তো ছেলে আমার এখনো সন্দেহ করে।"
রূপসা গাল ভর্তি ভাত নিয়ে গলা ফুলিয়ে নেয়। রওশন হেসে বোনের মাথায় গাট্টা মেরে চলে যায়। রেবেকা বানু ছেলের জন্য কফি বানিয়ে ঢাকনায় ঢেকে নেয়। সাথে স্বামীর জন্য কাপে চা ঢেলে নেন। রসাই ঘর থেকে বেরিয়ে অন্দর মহলের উঠোনের দিকে যায়। নোমান মাহবুব সেথায় একশা বসে আছে চিন্তিত বদনে। তিনি চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,
-" কি হয়েছে গো? চিন্তিত লাগছে আপনাকে।"
নোমান মাহবুব স্ত্রীর পানে চেয়ে চায়ের কাপ হাতে নেন। কাঠের চেয়ারের হাতলের উপর কাপ রেখে বলেন,
-" বসো রেবেকা। একটা কথা বলি মন দিয়ে শুনো!"
রেবেকা বানুকে একটু পেরেশান দেখায়। আটপৌরে শাড়ির আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা কাঁধ গলিয়ে পিঠে ঠেলে পাশের চেয়ারে বসে। নোমান মাহবুব কতিপয় সময় চুপ থেকে শান্ত গলায় শুধায়,
-" রিজের সাথে রূপসার ব্যাপারে তুমি সত্যিই ভেবেছো?"
-" হ্যাঁ। রিজের সাথে রূপসাকে মানাবে বড্ড। হঠাৎ এ প্রশ্ন? রমজান ভাই আবার দোনামোনা করছে নাকি? ছামিনার হাবভাব দেখে বোঝা যায় খুশি না। তবে রমজান ভাই তো পারে না এখনি মেয়েকে তুলে দেয়। বউয়ের কান পড়ায় আবার মন পাল্টালো না কি?"
তাচ্ছিল্যের সাথে বলে রেবেকা বানু। নোমান মাহবুব ঢের বিরক্ত হয় বউয়ের বাড়াবাড়ি ভাবনায়।
-" এক বললে উনিশ বিশ বোঝা মহিলাদের একমাত্র গুন। রমজান কিছুই বলে নি। তোমার আদরের ছেলের মতিভ্রম ঘটেছে। রূপসা বেশ ছোট। পরিপক্ক হতে সময় আছে তোমার ছেলের বয়স আটাশ পেরুলো বলে। কেমনে কি ভাই? আমি রমজানের সাথে কথা বলে ঘটককে ঠিক করছি।"
রেবেকা বানুর মুখটা সুবিধার না। রাজপুত্তুরের মতো ছেলে তার। চেহারায় গুনে গানে সেরা। সেরার জন্য সেরাই আনতে হবে তাই না? তিনি অত্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে,
-" ঘটক আনবেন না। রূপসাকে আমার ভারী পছন্দ। অতি ভদ্র নরম স্বভাবের। কখনো উঁচু গলায় কথা বলবে না। আমাদের হাতের নিচেই তো বড় হলো। রাগী ছেলেটার বাধ্য থাকবে সর্বদাই। দেখতে মাশাআল্লাহ ওর মতো সাত গায়ে গঞ্জে খুঁজে পাবেন না। ভেবেছিলাম রূপসাটা এসএসসি দিলে চারহাত এক করে দিবো। তবে মনে হচ্ছে দেরি করা ঠিক হবে না। কাবিন করিয়ে রাখলে ভালো হবে। আপনি রমজান ভাই.. না থাক আমিই কথা বলে নেবো।"
নোমান মাহবুব প্রত্যুত্তর না করে বিরক্ত মুখে উঠে যায়। রেবেকা বানু পিছু ডাকলেও শোনে না। রেবেকা বানু চিন্তার সাগরে ডুবে ছেলের জন্য কফির মগ নিয়ে উঠে যায়। ধোঁয়ায় উড়ানো চায়ের কাপ পড়ে রয় অতি অবহেলায়।
•••••••••••••••
বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে রঙচটা পুরনো আমলের রাজকীয় ভবন। শ্যাওলার আস্তরণে ইট পাথর দেখা ভার। দেয়াল বেঁয়ে লতাপাতা আড় পেতে চেয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে যত্নবিহীন বাড়িটা ধ্বংসের পথে। তবে এই ধারনা মরিচিকার জলের ধারার মতো বিলীন করে দিবে ভেতরের সাজসজ্জা আভিজাত্যের আস্তরণে। বিশাল ঝাড়বাতি ঝুলছে মাথার উপরে। রাজার আমলের ফার্নিচারে সজ্জিত ঘর। সাদা পাতলা তোষক বিছানো দুই পাশে। সবুজ রাঙা কোল বালিশ ও ছোট ছোট বালিশও দেখা যায়। বড় রাজকীয় চেয়ারে এক পা তুলে বসে সৌদামিনী দাস। কৃত্রিম পন্থায় রাঙানো টকটকে অধর কোণে বাঁকা হাসি। লাল আস্তরণে ঢাকা কপোল। গাঢ় রেখায় বক্ররেখা চোখ ছুঁয়ে আছে। কপালে লাল রাঙা পূর্ণ চন্দ্রিমা চেয়ে। লম্বা বিনুনি কাঁধ ছেড়ে মেঝে ছুঁই ছুঁই। রিনিঝিনি চুড়ি হাতে একটা আঙুর মুখে মুখ কুঁচকে নেয় টকে। মিষ্টি হেসে বলে,
-" মাসি মা?কি আঙুর আনলে? টকে মুখেই দেওয়া যাচ্ছে না। দামিনীর মিষ্টি মুখটা টকে গেলো। কাজটি ঠিক করো নি।"
মধ্যবয়সী মহিলা বিরক্ত মুখ তাকায়। একটা আঙুর মুখে তুলে পরখ করে দেখে। কই টক? মিষ্টিই তো লাগছে। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,
-" দামিনী, মিষ্টিই তো। বাদ দাও আওফাও বাত চিত। আমার কথা শুনো ধ্যান দিয়ে। বৈশাখী মেলা হবে সরোজপুর হাঁটে। শুক্কুর আলী পয়গাম নিয়ে এসেছে। তোমার সাথে কথা বলতে চায়। গতবার তোমার জন্য ওনার যাত্রাপালা একদম হাউজফুল হয়ে গেছে। লাভের পুঁজি ব্যাটা দুই লুঙ্গি দিয়ে পুঁটলি বেঁধেও নিতে পারে নাই। এবারও এসেছে লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে। তবে ব্যাটা ন্যাকা। তার নাকে কান্নায় দানবীর তুমি কিন্তু গলে যাবে না। চাহিদা আকাশচুম্বী হওয়া চাই। ব্যাটা দিতে বাধ্য।"
দামিনী উঠে দাঁড়ালো। বিনুনি পেছনে ঠেলে দিলে তা কোমড় ছেড়ে হাঁটু ছুঁই ছুঁই। গোটা কয়েক কিশলয় কপোল ছুঁয়ে আছে। এক হাতে কানের পিঠে গুঁজে বলে,
-"তাকে বলে দাও দামিনী এখন বিজি আছে। পরে দেখা করতে।"
-" কিন্তু দামি.."
-" এককথা বার বাড় দৌড়ানো আমার পছন্দ না মাসি। তুমিও এখন আসতে পারো। তোমার সুশ্রী চেহারা দেখলেই গা জ্বালা করে আমার।"
ক্ষুর ধারালো অস্ত্রের ন্যায় সেই বান। মধ্যবয়সী মহিলা মাথা নত করে নেয়। পিলপিল পায়ে প্রস্থান নেয় ভিতু মুখে। দামিনী লক্ষ্য করে বাঁকা হাসে। গুনগুনিয়ে সুর তুলে,
'এক কালো যমুনার জল সর্ব লোকে খায়
আরেক কালো আমি দামু সকল পুরুষ চায়'
••••••••••••
বিচার সভা বসেছে ঈদগাহ মাঠে। সকল মুরুব্বি আর ক্ষমতাবলে তৈরি মুরুব্বিরা কাঠের চেয়ার দখলে নিয়েছে। দরবার ঘিরে রেখেছে গ্রামবাসী। ছেলে মেয়ে জনিত কেলেংকারি কান্ডকীর্তিতে সকলের মনে কৌতুহল অসীম। বিচার সভা থেকে টুকটাক জেনে মশলাপাতি মিশিয়ে আগামী একমাস রসিয়ে গাল গপ্প হবে প্রতিটি বৈঠকে, মহিলাদের ঢেঁকি খানায়। বিচার সভায় পুরুষের উপস্থিতি বেশি। মহিলা বলতে ওই শেফালী। সে অবশ্য দশটা পুরুষের চেয়ে কম নয়। বাকি গ্রামের কিছু মহিলা আর ঘটনায় জড়িত মেয়েটাও আছে। তবে তাঁরা আড়ালে। ঈদগাহ মাঠ সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনের দিকটায়। পা পা তুলে গম্ভীর মুখে বসে নওরিজ মাহবুব। চোখে মুখে অগাধ বিরক্তি। বিচার সভায় ভারবুদ্ধিপ্রাপ্ত মুরুব্বি, গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের অভাব নাই। কিন্তু সবাই চুপচাপ বসে ঝিমুচ্ছে। চাপা গুঞ্জনের সমুদ্রে মন্টু মিয়া কথা বলে যাচ্ছে অনবরত। আর কাউকেই কথা বলার সুযোগ দিচ্ছেন না; বিশেষ খরে ছেলের পক্ষের মুরুব্বিদেরকে। নিজের সুমিষ্ট গোছানো কথায় সবাইকেই কেমন নিজের অদৃশ্য জালে আটকে নিয়েছে। লোকটার উপস্থিত বুদ্ধি আর চাটুকারিতার প্রসংশা করতে হয়। নওরিজ মাহবুব আর চুপ করে থাকে না। মন্টু মিয়া ক্ষণিকের জন্য স্বীয় বয়ান থামাতেই নওরিজ মাহবুব হেসে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে মন্টুর উদ্দেশ্য,
-" চাচা? আপনি অনুমতি দিলে আমরাও কিছু বলতাম আরকি। এখানে আরও অভিজ্ঞ, গুনী লোকেরা উপস্থিত আপনি তাদের সাথে পরামর্শ করলে ব্যাপাটা সুবিধার হয়। আপনি কি আমার কথায় কিছু মনে করলেন?"
ভদ্রলোকের চোখে মুখে বিরক্তি খুঁজে পাওয়া গেলো না। চাটুকার হেসে সায় জানিয়ে বলে,
-" নাহ্। মনে করবো কেন রিজ বাবা? অবশ্যই সবার সাথে পরামর্শ করা হবে। আমি তো কেবল আমার মতামত দিলাম। বাকিটা ময় মুরুব্বি আছেই তারা দেখে নেবে। আর আমার কথায় ভুল ত্রুটি পেলে আমাকেও সুধরে দিবে তাই না?"
নওরিজ গলা খাঁকারি দিয়ে খানিকটা হাসি ফুটিয়ে তোলে গম্ভীর মুখে। ক্ষত অবস্থায় কালো মুখে দন্ডায়মান ছেলেটা ও তাঁর দুঃস্থ বাবাকে এক পল দেখে নিয়ে বলে,
-" আপনার কথায় ভুল নেই চাচা। আপনার প্রতিটি কথাই যথাযথ। ছেলে মেয়ে দুজনেরই দোষ আছে। আবেগের বশে ভুল করেছে। ভুল যতটা ছেলের ততটাই মেয়ের উপরেও বর্তায়। তবুও আমি ছেলের উপরেই দোষের পাল্লা বেশি দিবো। আপনার কথা ঠিক মন্টু চাচা । মেয়েটার সম্মান নিয়ে খেলা হয়েছে, তাই ছেলেটার উপর জরিমানা করা হোক। টাকা দিলেই মেয়েটার সম্মান ফিরে আসবে তো। টাকাতে সব হয়। ছেলেটা কেন দরিদ্র বাবার ছেলে হয়ে ভালো পরিবারের মেয়ের উপর ঝুঁকে পড়লো? এর পরিণতি আমি আপনারা সবাই জানি। মিলন অসম্ভব প্রায়, বিচ্ছেদই তাদের উপসংহার। তবুও বেহায়া মন যে মানে না। আমার জানা মতে ছেলেটার পরিবার মেয়েটার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। মেয়ের বাবা যা তা বলে অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটা কিন্তু আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। তবুও মেয়েটা ছেলের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। এখানে আপনারা কার দোষ দেখছেন? স্যার আপনি বিবেচনা করুন? ছেলে মেয়ে উভয়েই একে অপরের জন্য পাগল প্রায়। একে অন্যকে ছাড়া কিছুই দেখছে না। না সমাজ, না পরিবার। তাঁরা নিজেদের নিয়ে এতটাই উদগ্রীব আশপাশ তাদের কাছে আগাছা বৈ কিছু না। আপনি দু'জনের সাথেই কথা বলে নিন। তাঁরা কি চায়? সেটাই মুখ্য। কেননা এখন একটা মিমাংসা দিলাম পরবর্তীতে ছেলে মেয়ে আবারও চুনকালি মাখবে না তাঁর গ্যারান্টি কে দিবে?"
বিচার সভায় উপস্থিত মনসের মাস্টারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে নওরিজ থেমে যায়। বৃদ্ধা লোকটা কিছুক্ষণ আপনমনে ভেবে ছেলে ও মেয়ের মুখখানা এক করে। যদিও মন্টু মিয়া আরেক মুরুব্বিকে ইশারায় বাঁধ সাধার আর্জি করেছিল নওরিজ লক্ষ্য করে পাশা পাল্টে নেয়। ছেলে মেয়ে দু'জনকে দূরত্বে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করা হয়। নতমুখী দুজনের মুখে একজবাব। মেয়েটা বাবার গরম চাহনিতে দমে যাবে যাবে ভাব মনসের মাস্টার উঠে এসে স্বীয় ছাত্রীর মাথায় স্নেহের হাত রেখে আশ্বাস দেয়। মেয়েটা ঝরঝরিয়ে কেঁদে জানায় সে ছেলেটাকে চায়। ব্যস মিয়া বিবি রাজি তো আর কি করার আছে? সেই বিচার সভায় মৌলভি সাহেবকে ডেকে বিয়ে পড়ানো হয়। ছেলের বাবা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায় নওরিজের দিকে। নওরিজ চোখে হাসে। বিচার সভা ভেঙে যাবে যাবে ভাব এমনি মুহূর্তে ভূতের মতো উদয় হয় সিনান সালেহ। নওরিজ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এক ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান নজরে তাকায়। সিনান সালেহ পরনে পাতলা ফতুয়া ঠিক করে গলা খাঁকারি দেয়। মিনমিনে স্বরে বলে,
-" রিজ ভাই? গ্রামের প্রায় আশি শতাংশ মানুষ এখানে উপস্থিত। আপনি যদি আমার স্বেচ্ছাসেবক লীগের কথাটা পাড়তেন বড্ড কৃতজ্ঞ থাকতাম আপনার উপর। দয়া করে মানা কইরেন না রিজ ভাই? আপনার সব কামে আমারে আগে পাইবেন। খোদার কসম"
নওরিজ ছোট ছোট চোখে চায়। শালা সম্বন্ধি এখন মিওমিও করছে। অথচ সেদিন গর্জে উঠেছিল না?
-" তোর বাপে তোর জব্বর একখানা নাম দিয়েছে। তারছিড়া! আচ্ছা এসবের বদৌলতে আমি কি পাবো?"
-" এই গরীবের থাইকা কি আর নিবেন? ফ্রি করলে ভালো হতো তবুও যা চাইবেন তাই দিবো সম্ভব হইলে। আমার বহুদিনের স্বপ্ন এটা ভাই।"
নওরিজ চোখে হাসে। সিনান সালেহের কাঁধ জড়িয়ে উপস্থিত সকলের মনোযোগ টেনে নেয় নিজের দিকে। সূচনা, বর্ণনা, সুবিধা আর উন্নতির দিক উল্লেখ করে উপসংহার টানে শব্দের জাদুতে। সিনান হা করে সবটা দেখে। রিজ ভাইয়ের অনবদ্য ভাষা আর সাবলীল ভঙ্গিতে উপস্থাপনায় নিজেই অভিভূত হয়। সবচেয়ে আশ্চর্য তখন হয়, যখন মন্টু মিয়া খুশি হয়ে সর্বপ্রথম সিনানকে বাহবা দেয়। প্রথম দানের খাতায় সারে তিন হাজার টাকা নগদ অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন।
•••••••••••••••
সুরেলাদের বাড়ির সামনে জাহিদা চাচির বড় উঠোনে একটা কূপ আছে। বিশাল সে কূপ। গাঁওয়ের অধিকাংশ বাড়িতে আর্সেনিক যুক্ত টিউবওয়েল থাকার দরুণ খাওয়া দাওয়া রান্নার পানি এখান থেকেই সংগ্রহ করা হয়। সুরেলা স্টিলে কলস কোমড়ে একহাতে বেঁধে অপর হাতে জগ নিয়ে কূপের কাছে আসে। সাথে শাপলাও এসেছে। মোটা রশিতে জগটা বেঁধে নিচে ফেলে রশি নাড়িয়ে জগ ডুবিয়ে পানি ভরে। জগ ভরলে উপরে টেনে তুলে কলস ভর্তি করা শুরু করে। তাঁর ধ্যান ধারণা সব কূয়োর ভেতরে নিবদ্ধ হঠাৎ কারো ছোঁয়ায় চমকে উঠে। পড়তে পড়তে বেঁচে যায় যেন। বুকে থুতু দিয়ে পিছু ফিরে বলে,
-" শাপলার বাচ্চা কূয়ায় চুবাই ধরমু...."
থেমে যায় সুরেলা। এ যে শাপলা নয়। দুই হাত, পা ওয়ালা বাঘ! যার হাতে মাঝারি আকারের একটা ডাল। সেটা দিয়েই খোঁচা মেরেছে পিঠে। আর শাপলা ? সে তো দাঁত কেলিয়ে হাসছে একটু দূরে দাঁড়িয়ে। সুরেলার রাগ তরতর করে বেড়ে যায়। গরম চাহনি নিক্ষেপ করে বলে,
-" রিজ ভাই? এখানে কি করছেন? আর এভাবে ভয় দেখানোর মানে কি ভাই? যদি কূয়ায় পড়ে যেতাম?"
-" যেতি! একটু হাবুডুবু খেতিস সাথে গোসলটাও হতো। কতো দিন হলো গোসল করিস না?"
নওরিজ মাহবুবের গম্ভীর সুরে দুষ্টুমির আভাস। বুঝতে বাকি থাকে না মহারাজ ভাব জমাতে এসেছে। সে দাঁত কেলিয়ে বলে,
-" আজ দিয়ে নয় দিন হবে গোসল করি না। দাঁত মাজি না পাঁচদিন হবে। নখ তো জীবনেও পরিষ্কার করি নি। এতোটা জীবানু জমছে আপনারে একটা খামচি দিলে আপনার কঠিন রোগ হবে। দেবো?"
নওরিজ শান্ত চোখে চায়। এক হাত বাড়িয়ে ইশারায় দিতে বলে খামচি। সুরেলা দাঁত কটমট করে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কূপ হতে পানি তোলায় মনোযোগী হয়।
.
.
.
চলবে.........................................................................