"এতো কান্না করলে বন্যা হয়ে যাবে এই শহরে, আর আমার সুন্দর বাড়িটা ডুবে যাবে। এর দায়ভার কে নেবে? আপনি নিবেন, শিকদার?"
অনন্যার মুখ দুই হাতে তুলে সরাসরি তাকিয়ে বললো কৌশিক। কিন্তু মেয়েটা কিছুই শুনছে না। তার চোখ থেকে নীরবময় প্রবল ধারায় অশ্রু ঝরছে, থামার কোনো লক্ষণ ও নেই। বড্ড কষ্ট পেয়েছে নিশ্চয়ই।
কৌশিক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দেখতে লাগলো অনন্যাকে। দু'চোখ ভেজা, মুখের কোণে অস্বাভাবিক ক্লান্তি, আর নাক মুখ লাল হয়ে আছে কান্নার চাপে। কৌশিক কখনো দেখেনি অনন্যাকে এভাবে ভেঙে পড়তে। এমনভাবে কাঁদছে, মনে হচ্ছে ভেতরের সব কষ্ট একসাথে উপচে পড়ছে দুই চোখ দিয়ে।
ধীরে ধীরে কৌশিক অনন্যার পাশে বসল। এক টানে মেয়েটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। গ্লাভস পরা হাত দিয়ে গাল ছুঁয়ে বললো,
"শান্ত হও।"
অনন্যা কৌশিকের ভারী পোশাক টেনে ধরে আবারো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
কৌশিক বললো,
"আমি কি মারা গেছি? এভাবে কাঁদছো কেনো?"
অনন্যা কান্না থামিয়ে মুখ তুলে ড্যাবড্যাব করে তাকালো। আচমকা কৌশিকের বুকে কিল ঘুষি মেরে বললো ,
"মেরে ফেলবো আপনাকে। এভাবে যন্ত্রণা দিচ্ছেন। শাস্তি তো দিতেই হবে।"
কৌশিক হাসলো। অনন্যা কটমট করে তাকিয়ে বললো,
"একদম হাসবেন না। আমার কান্না দেখে মজা পাচ্ছেন?"
কৌশিক দুই দিকে মাথা নাড়লো। তার নাড়াচাড়ার ভারসাম্য রক্ষা করে খুচরো চুলগুলো সুন্দর করে নড়ে উঠলো। কৌশিক নিজের চুল ঠিক করে অনন্যার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। আঙুলের ডগা স্পর্শ করে কিছু লেখতে থাকলো। অনন্যা ভ্রু কুঞ্চিত করে বোঝার চেষ্টা করলো। আচমকা কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললো , "প্রিন্স!"
কৌশিক হেসে বললো,
"জ্বি! তোমার হাতে প্রিন্সের মরণ লিখে দিলাম। এবার খুশি?"
অনন্যা কৌশিককে ধাক্কা দিয়ে সরে গেল। কৌশিক স্মিত হেসে বললো,
"আচ্ছা আমার প্রথম বিয়ের কথা বলি?"
অনন্যা নিজের কানে হাত চেপে ধরে বললো,
"শুনতে চাই না।"
"আরে শোনো! ভালো লাগতেও পারে।"
কৌশিকের কথায় অনন্যা চোখ ফিরিয়ে তাকালো তার দিকে।
কৌশিক একটু থেমে ভাবল, তারপর মৃদু স্বরে বললো, "আমার জীবনের প্রথম বিয়ে খুব বিষাক্ত ছিল। কিন্তু তবুও, অতি সাধারণ। শুধু এই একটা বিয়ের কথাই যা আমার মনে আছে।"
অনন্যার দৃষ্টি একধাপ কঠিন হলো। ঠোঁট চেপে বললো, "এর মানে আপনি বলছেন আমাদের বিয়ের কথাও আপনার মনে নেই?"
কৌশিক একটু থেমে তাকালো তার দিকে।
চিন্তিত গলায় বললো,
"আছে কিছুটা। আসলে সেদিন আমি একটা ভ্রমের মধ্যে ছিলাম। সবকিছু কেমন অস্পষ্ট লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমি নিজের ইচ্ছায় কিছুই করছিলাম না। আমার মস্তিষ্ক হয়তো পুরো ঘটনা লোড নিতে পারেনি।"
তারপর একটু ঝুঁকে হেসে বললো,
"কী জানি! কী জাদু করেছিলে তুমি!"
"আমি আবার কি করলাম?"
কৌশিক অনন্যার রুমের কাঁচের দেয়ালের বাইরে দৃষ্টি স্থির করলো। গভীর নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
"তুমিই বলতে পারবে, প্রিন্সেস। কিন্তু আমাদের বিয়েটা অনেক ইন্টারেস্টিং ভাবে হয়েছে। দুজনের কেউই জানতাম না একটু পরে আমরা একে অপরের সাথে এভাবে বাঁধা পড়বো। তাই না?"
অনন্যা নিশ্চুপ হয়ে রইলো। বিয়ের দিনের কথা হুট করে মনে পড়লো। সেদিন কি আকামটাই না করেছিল সে। সেই কারণেই হয়তো এই পাগল অমানুষটার সাথে বিয়ে হয়েছে।
কৌশিক হালকা হেসে বললো,
"আচ্ছা, বাদ দাও এসব। যেটা বলছিলাম, আমার প্রথম বিয়ের কথা!"
কৌশিকের দৃষ্টি তখনো জানালার বাইরে, দূরের আকাশের দিকে আটকে গেলো। সে গম্ভীর স্বরে বলতে শুরু করলো,
"আমাদের রাজ্যে বিয়ে হতো চাঁদের দিকে তাকিয়ে। সেদিনও পুরো রাজ্য জুড়ে উৎসবের আমেজ ছিল। রাজপ্রাসাদের চত্বর আলোয় ঝলমল করছিল, মানুষের কোলাহলে চারদিক মুখরিত ছিল।
রাত ঠিক বারোটায়, রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী, আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আমরা বিয়েতে সম্মতি জানালাম। আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো এক সুন্দরী রাজকুমারী। আমাদের বিয়ে পড়ানো হলো। আমরাও সেদিন এক সুতোয় বাঁধা পড়লাম। কিন্তু বিয়ের পর পর রাজ্যে আক্রমণ হলো। সবার একত্রিত হওয়ার সুযোগ নিয়ে শত্রুরা হামলা চালালো। চারপাশে তলোয়ার ঝনঝন শব্দ তুলে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে উঠলো। আগুন জ্বলে উঠলো দুর্গের দেয়ালে। চিৎকার, আর্তনাদে রাজপ্রাসাদ কেঁপে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যে উৎসবের রাত রক্তে ভেসে গেলো।"
কৌশিক পাশে তাকিয়ে দেখলো অনন্যা নেই। ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে ফিরলো সে।
দরজার পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অনন্যা কঠিন গলায় বললো,
"আপনার এসব আজেবাজে কথা বার্তা আপনিই শুনুন!"
কৌশিক বললো,
"বিশ্বাস হয়না?"
"না!"
অনন্যা ঘর ছেড়ে চলে যেতে নিলো। কৌশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে জোর গলায় বললো,
"অনন্যা শিকদার! আমি সবচেয়ে বেশি কাকে ভয় পাই জানো?"
অনন্যার পা থেমে গেলো। সে উল্টো ঘুরে কৌশিকের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। কৌশিক নিজের ব্লাক জিন্সের পকেটে এক হাত গুঁজে মৃদু হেসে বললো,
"নিজের হৃদয়কে। এজন্য এই হৃদয়টাকে লুকিয়ে রাখি সবসময়। মানুষের চেয়ে বেশি আপনার হৃদয় আপনাকে মারাত্মকভাবে ধোঁকা দিতে সক্ষম। তাই বলছি, আমি আমার হৃদয়কে সামলে রাখতে চাই। সাহায্য করবে?"
অনন্যা কিছুই বুঝতে পারছিলো না। কৌশিকের কথাগুলো একেকটা ধাঁধার মতো শোনাচ্ছিল। মাথার ভেতর অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, কিন্তু উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না।
ঠিক তখনই নিচ থেকে ভেনোরার কণ্ঠ ভেসে এলো। কৌশিককে ডাকছে সে। আওয়াজটা কিছুটা তীক্ষ্ণ লাগলো অনন্যার কানে। কৌশিক ধীর পায়ে এগিয়ে এসে অনন্যার হাত ধরলো। অনন্যা সামান্য চমকে তাকালো দৃষ্টি রাখলো স্যারের দিকে।
"চলো।"
শান্ত কণ্ঠে বললো কৌশিক।
অনন্যা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। প্রশ্নগুলো জমে থাকলো বুকের ভেতর। কৌশিক ওর হাতটা শক্ত করে ধরে নিচের দিকে এগিয়ে চললো, আর অনন্যা তার পাশে নিশ্চুপ পায়ে হাঁটতে লাগলো, মনে অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে।
*******
কৌশিক রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ফিল্টার থেকে পানি ঢেলে গ্লাস হাতে নিলো। ধীরে ধীরে এক চুমুক পান করলো, ঠান্ডা পানি গলার নিচে নেমে গেলো। ঠিক তখনই পাশে এসে দাঁড়ালো নিক, হাত মুছতে মুছতে বললো,
"ব্রো! আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।"
কৌশিক চোখের কোনা দিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকালো। টেবিলের চারপাশে বসে আছে অনন্যা, ভেনোরা আর লারা। ভেনোরা অনন্যার সঙ্গে মেশার চেষ্টা করছে, কখনো হেসে, কখনো ইশারায় কিছু বোঝাচ্ছে। অনন্যাও ঠান্ডা গলায় উত্তর দিচ্ছে, তবে কৌশিক বুঝতে পারছে, মেয়েটার ভেতরে কিছু একটা দোলাচল করছে।
তামং খাওয়া শেষ করে রিডোর সঙ্গে ব্যস্ত, আর লারা ধীরেসুস্থে খেতে খেতে কখনো কথায় অংশ নিচ্ছে।
কৌশিক শেষ চুমুকটা নিয়ে গ্লাস নামালো, তারপর নিকের দিকে ফিরলো।
"বলো, কী জানতে চাও?"
নিক এবার আরেকটু এগিয়ে এল, চাপা গলায় বললো,
"তখন ভেনোরা অনন্যার নামে কতকিছু বললো, আর তুমি মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিলে। কিন্তু আমি কিছু বললেই তোমার রাগ সব আমার ওপর এসে পড়ে, তাই না?"
কৌশিক এবার ধীরেসুস্থে নিকের দিকে তাকালো।
নিক থামলো না,
"আমি কিছু বললেই তুমি আমায় মেরে ফেলতে চাও। কিন্তু ভেনোরা যখন বললো তখন তোমার রিয়েকশন একদম নরমাল ছিল! মানে, মেয়ে হলেই কি ওরা বেঁচে যায়? উত্তর দাও আমায়!"
কৌশিক গভীর স্বরে বললো,
"সব অনুভূতি মুখের অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পায় না, নিক। ইংরেজিতে একটা কথা আছে , A silent face can hide a thousand emotions। ভেনোরা যখন বলছিল যে অনন্যা কেন এখনো বেঁচে আছে, তখন আমার ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলছিল। কিন্তু তুমি কি সেটা বুঝতে পেরেছো? না, কারণ আমি সেটা দেখাইনি।"
নিক চোখ সরু করে কৌশিকের দিকে তাকালো।
"তাহলে তুমি চুপ ছিলে কেন?"
কৌশিক কিছুক্ষণ নীরব থাকলো, তারপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
"ভেনোরাকে আমার দরকার। সে আমার কাজে আসবে। আমাকে ঠিক হতে সাহায্য করবে। তাই আমি তখন কিছু বলিনি।"
নিক ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,
"উমম! ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট, তাই তো?"
কৌশিক শান্ত চোখে নিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
"না, সব ক্ষেত্রে তা নয়। কিন্তু যদি কথায় অনন্যার নাম চলে আসে, তাহলে অবশ্যই আমার আচরণ বদলে যাবে।"
নিক মাথা নাড়িয়ে বললো,
"আমার মনে হয় তুমি ভেনোরার জন্য ফিল করো। নাহলে তোমার আচরণ ওরকম হতো না। তুমি হুটহাট রেগে যাও। কিন্তু ভেনোরা যখন..."
কিন্তু সে বাক্যটা শেষ করতে পারলো না। কৌশিকের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। নিক চুপ করে গেলো, কৌশিকের তীক্ষ্ণ আকাশি মণি দেখে ভেতরে এক অজানা আতঙ্ক কাজ করলো। তার গলা শুকিয়ে এলো, ঢোক গিললো একবার। মুখের পেশীগুলোও টানটান হয়ে উঠলো ইতিমধ্যে। ঠিক তখনই ধপ করে শব্দ হলো। ভেনোরা চেয়ার থেকে কীভাবে যেন পড়ে গেছে।
নিক দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে ভেনোরার দিকে তাকালো। কৌশিক ঠোঁটের কোণে হাসি চাপল। ভেনোরা কষ্টে আহ্ শব্দ করে পায়ের দিকে তাকালো। চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকে গেছে তার।
কৌশিক নিকের কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বললো,
"যাও, সেবা করে আসো।"
কিন্তু সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো অনন্যা আর লারা। অনন্যা ভেনোরার পাশে বসে তার পা ধরে দেখলো।কৌশিক এই দৃশ্য উপেক্ষা করে সামনের পথ ধরে এগিয়ে গেলো। সিঁড়ির ধাপ বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেলো, একবারও পেছন ফিরে তাকালো না। কিন্তু ভেনোরার আচমকা পেট ব্যথা শুরু হলো। সে দুই জনের সাহায্যে উঠে দ্রুত বাথরুমের দিকে এগোলো।
*******
কয়েকদিন পর রাতের সময়। আকাশে ভরা ভরা তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঠান্ডা বাতাস জানালার কাঁচে আলতো ধাক্কা দিচ্ছিল, কিন্তু অনন্যার মন অন্য কোথাও ছিল। সে পড়ার টেবিলে বসেছিল ঠিকই, কিন্তু মনোযোগ টিকছিল না। চোখ বারবার পিছনের কাঁচের দেয়ালের দিকে চলে যাচ্ছিল। কি অপূর্ব রাত! অথচ তার মাথার ভেতর এক বিশৃঙ্খল ঝড় বইছিল।
কয়েকদিন ধরে বাইরে অনেক সময় চলে যাচ্ছে, তার মাঝেই সামনে মিড পরীক্ষা অথচ মাথার মধ্যে জটলা পেকে আছে ওর। সমস্যা একটাই, কৌশিক স্যার । এমনিতে পড়াশোনার চাপ থাকলে সে একেবারে বইতে ডুবে যায়, কিন্তু কৌশিক স্যারের কারণে কিছুই ভালো লাগছে না অনন্যার। তার প্রতি যে রাগ জন্মেছে, সেটা একটুও কমেনি। বরং দিনকে দিন আরও বেড়ে যাচ্ছে। আর রাগ কমবেই বা কেন?
অনন্যা খেয়াল করেছে, ইদানীং স্যারের রুমে উনার বান্ধবীর আনাগোনা অনেক বেড়ে গেছে। কালকেই তো সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কিছু কথা শুনেছিল। পুরোটা না বুঝলেও, যা শুনেছে তাতেই বুকের ভেতর কেমন একটা অস্বস্তি জেগেছে।
কৌশিক স্যার বলছিলো,
"আস্তে করবে। খুব ব্যথা লাগে।"
ভেনোরা মেয়েটা বললো,
"আমার মোলায়েম হাত। যত আস্তে পারা যায় ততোই আস্তে করার চেষ্টা করি। তুমিই বাচ্চাদের মতো বিহেভ করছো।"
"ভেনোরা! ব্যথা পাচ্ছি খুব।"
এটা শুনে অনন্যার সারা শরীরে একটা ঝাঁকুনি খেলে গেলো। অনন্যা আর শুনতে পারেনি। নিজের রুমে এসে চুপ করে বসেছিল কতক্ষন। ভিতরে কি হচ্ছিল নিজের চোখে যদি না দেখে তাহলে শান্তি পাবে না সে। ব্যথা পাওয়া, মোলায়েম হাত এসব অর্থ দিয়ে কি বোঝায় অনন্যা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। নাকি দুজনের মধ্যে কিছু চলছে? ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে অনন্যার। বুকটা ধড়ফড় করছে। এসব দেখার চেয়ে সেদিন লোকটার হাতে মৃ/ত্যুকে মেনে নেওয়া শতগুণ ভালো ছিল। যদি এসব সত্যি হয়ে থাকে, স্যার এতো খারাপ কি করে হতে পারে? অনন্যাকে ছেড়ে রাত করে অন্যের সাথে কি করে থাকতে পারে। কথাটা মনে আসতেই কানে হাত চেপে খুব জোরে চিৎকার করলো অনন্যা।
কৌশিক হঠাৎ দরজা খুলে অনন্যার চিৎকার শুনে একটা জোরেশোরে ধমক দিলো। থতমত খেয়ে গেল অনন্যা। কৌশিক স্যারকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো। কৌশিক পড়ার টেবিলের সামনে এসে অনন্যার মাথায় টোকা দিয়ে বললো,
"মনোযোগ দিয়ে পড়ো। দুই দিন পর পরীক্ষা।"
অনন্যা কিছু বললো না। ফোনের পিডিএফে চোখ স্থির করে রাখলো। কৌশিক ও চুপচাপ অনন্যার দিকে তাকিয়ে থাকলো। একটু পর আবার চেয়ার টেনে তার পাশে বসলো। টেবিলে হাত রেখে গালে হাত দিয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে রইল। অনন্যা তারপরও পাত্তা দিলো না।
হঠাৎ ফোনের নোটিফিকেশনে একজনের মেসেজ ভেসে আসলো। অনন্যা ফোনটা হাতে নিয়ে সেখানে মগ্ন হয়ে পড়লো। কৌশিক ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো। আচমকা ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে বললো,
"পড়ার দিকে মনোযোগ দাও।"
"আপনি যান।"
"কেনো?"
কৌশিক বড় বড় করে তাকালো।
"ডিস্টার্ব করছেন।"
"করলে করছি। তুমিও পড়ছো না তাও দেখছি।"
"আপনাকে বিরক্ত লাগে।"
"বিরক্তির কারণ হতে পেরেছি এটাই তো অনেক।"
অনন্যা জোর করে ফোনটা নিয়ে দেখলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ নয়। সে আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো।
কৌশিক ফোনের নিচে অনন্যার খাতাটা টেনে ওর লেখাগুলো দেখলো। চিন্তিত গলায় বললো,
"উমম! এই চিত্রটা ভুল আছে। তুমি হয়তো বুঝোনি। আসো বুঝিয়ে দেই।"
অনন্যা খাতা টেনে বললো,
"লাগবে না। ধন্যবাদ ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। বোঝানোর জন্য ইউটিউব যথেষ্ট। এবার আপনি যেতে পারেন, স্যার।"
স্যার কথাটায় জোর দিলো অনন্যা। কৌশিক নাক ফুলিয়ে উঠে গেলো। যাওয়ার আগে অনন্যার মাথায় আরেকটা টোকা মেরে গেলো। অনন্যা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বেশ অনেকক্ষণ পরে কৌশিক আরেকবার উঁকি দিয়েছে। অনন্যার মনোযোগ তখনো ফোনে।
অনন্যার রুম থেকে সে নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়ে ভেনোরাকে বললো,
"এখনো ঘুমায়নি।"
ভেনোরা পায়ের নখের পরিচর্যা করতে ব্যস্ত ছিলো। মুখ তুলে বললো,
"বসে থাকো মেয়েটার সাথে।"
"পড়ছে। আমি গেলে ডিস্টার্ব হবে।"
"আচ্ছা তাহলে ঘুমের ওষুধ দাও।"
কৌশিক বিরক্তের সাথে বললো,
"হ্যাঁ এতোই সহজ। আমি ঘুমের ওষুধ নিয়ে অনন্যার কাছে গিয়ে বলবো। খাও! ও খেয়ে নিবে? পাগল নাকি তুমি!"
ভেনোরা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো, তার চোখে তীব্র ক্ষোভ ফুটে উঠেছে। কৌশিক ব্যাঘাত ঘটিয়েছে তার কর্মকাণ্ডে।
ভেনোরা কৌশিকের দিকে এক গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
"সিরিয়াসলি, কিয়ান। তোমার মাথায় বুদ্ধি কম। খাওয়ার জন্য কিছু নিয়ে যাও, সেখানে ঘুমের ওষুধ মেশাও।"
কৌশিক মাথা চুলকে বললো, "ঠিক আছে।"
রান্নাঘরে এসে কৌশিক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো, গভীর ভাবনায় ডুবে গেল সে। কী নিয়ে যাবে সে? এই রাতের অন্ধকারে অনন্যা কোনো শরবত খাবে না, সেটি নিশ্চিত। যদি কোনো কিছু খাওয়ার জন্য তাকে জোর করা হয়, তবে অনন্যা হয়তো মুখে ছুঁড়ে মারতেও পারে। রাগ করে আছে যেহেতু। মাথায় রাগ থাকলে অনন্যা মারধর ও করে বসে। কি ডেঞ্জারাস মেয়ে! তাই এমন কিছু নিতে হবে যা অনন্যার পছন্দের, যাতে সে নিরাসক্ত না হয়। বেশ কিছু সময় অনুসন্ধান করার পর কৌশিক একটা আইসক্রিম বাটিতে ভর্তি করল। অনন্যা আইসক্রিম বেশ পছন্দ করে এটা জানে কৌশিক। এর মধ্যেই ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিলো সে। আজকে রাতে যে কাজটা করতে যাচ্ছে তার জন্য অনন্যাকে প্রথমে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকতে হবে। কিন্তু মেয়েটা এখনো ঘুমাচ্ছে না।যদি ঘুমিয়ে পড়তো, তাহলে এসব করতে হতো না।
কৌশিক অনন্যার রুমে বেশ দ্বিধা নিয়ে প্রবেশ করলো। অন্যসময় এমন হয় না। সে কেমন যেন পাগল প্রেমিকের মতো আচরণ করে। কিন্তু আজ একটা খারাপ কাজ করতে যাচ্ছে তাই এতো দ্বিধা মনের মধ্যে।
পড়ার টেবিলে কৌশিক আইসক্রিমের বাটিটা রেখে অনন্যার মাথায় আস্তে করে হাত দিয়ে চাপ দিয়ে বললো,
"প্রিন্সেস! তোমার ফেভারিট ডেজার্ট!"
অনন্যা রাগী দৃষ্টিতে তাকালো কৌশিকের দিকে। কৌশিক হাসার চেষ্টা করে বললো,
"খাও!"
অনন্যা কিছু বললো না। মুখ ফিরিয়ে আবারো পড়ায় মনোযোগ দিলো। কৌশিক চোখ পিটপিট করে সরে গেলো।
সে দূরে দাঁড়িয়ে থেকে কল্পনা করলো, কীভাবে অনন্যাকে জোর করে আইসক্রিম খাওয়াচ্ছে! কিন্তু এটা অভদ্রের মতো আচরণ হয়ে যায়। মনে হয় অনন্যার উপর অত্যাচার করছে সে। কিন্তু এরকম তো করতে পারে না কৌশিক। কিন্তু কৌশিকের এও মনে পড়ে আগে কতো জোর করেছিল অনন্যাকে। অথচ এখন কিছুই পারে না। কৌশিক হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলো কতক্ষণ।
.
.
.
চলবে..........................................................................