"শোন! তোর জামাইকে নিয়ে কাল হোটেল আসিস! আমরা হোটেলে থাকছি। বিয়ে হয়েছে সেই কবে অথচ ছেলেটাকে জামাই আদর করতে পারলাম না।"
"হোটেল? কোন হোটেল?"
অনন্যা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
"তোর মামার বাড়ির যাওয়ার পথেই একটা হোটেল আছে সানসাইন না কি যেন নাম! ঠিক বলছি না পূর্ব?"
অনন্যার মায়ের পাশেই পূর্ব বসেছিল সে চুপচাপ মাথা নাড়লো। চোখ দুটো ফোনেই অনড়। পল্লবী ছেলের মাথায় একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। পূর্ব চেতে উঠলো। উঠে চলে গেলো বাইরের রুমে।
অনন্যা প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। গাড়ি সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। অনন্যা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো,
"হোটেলে থাকছো কোন সমস্যা হয়েছিল কি?"
"হ্যাঁ, নিত্যদিন যা হয় আর কি! ভাইয়ের বউয়ের সাথে ভালোই ঝগড়া হলো, তারপর বেরিয়ে এলাম। সে সব বাদ দে। এক মাস বাংলাদেশ থাকবো, তারপর আবার ফিরে যাবো। আর সুখবর হলো তোর বাবা ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। এত তাড়াতাড়ি যে সব ঠিক হয়ে যাবে আমি কখনোই ভাবিনি। তোর জামাই না থাকলে কী যে হতো!"
পল্লবীর গলা ধরে এলো, কিছু সময়ের মধ্যে চোখ ও ভিজে উঠল। ফ্যাচফ্যাচিয়ে কান্না শুরু করে দিলেন তিনি। অনন্যা একপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখল কৌশিক স্যারকে। কৌশিকও কয়েকবার অনন্যার দিকে তাকিয়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো শব্দ করেননি। মুখে কোনো হাসিও নেই। কোনো এক্সপ্রেশন ও ধরা দিচ্ছে না। শুধু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কোনো সময় আঁকাবাঁকা পথ আবার কোনো সময় সরল পথে এগিয়ে যাচ্ছেন গাড়ি নিয়ে।
মায়ের কান্না অনন্যার কানে জোর কদমে পৌঁছুতেই সে ফোন কানে থাকা অবস্থায় বিরক্ত স্বরে বলল, "কান্না বন্ধ করো, মা। এবার তো সব ঠিক আছে, তাহলে এখন কাঁদছো কেন?"
পল্লবী যেন কথাগুলো শুনতেই পেলেন না, আবেগে জড়ানো কণ্ঠে বললেন, "শোন, তোর বাবা তোর জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছে। ডলারে পাঠিয়েছে বুঝলি! তুই না কি কিনতে চাইছিলি, তাই আরও একটা টিউশনি নিয়েছিস? এখন আর কষ্ট করতে হবে না।"
অনন্যা সোজা হয়ে বসে এক নিঃশ্বাসে বলল,
"কিন্তু মা, আমার টাকা লাগবে না। যেভাবে চলছে, চলতে দাও। তোমরা ব্যবহার করো। তোমাকে বলাই বোধহয় ভুল হয়েছে। আমার কিছু দরকার নেই।"
"একদম না!" পল্লবী কড়া গলায় বললেন।
"কালকে আসবি জামাইকে নিয়ে। ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করবি, আর জামাইয়ের জন্য যা কিনতে চেয়েছিলি, কিনবি। আর কোনো কথা শুনবো না আমি!"
অনন্যা গভীর শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করল। মা’র আদেশ উপেক্ষা করা সহজ নয়, তবু সে চেয়েছিল নিজের উপার্জনে কিনতে। রিংয়ের দাম এতটাই বেশি যে তার পক্ষে বছরের শেষ নাগাদই হয়তো কেনা সম্ভব হতো। মাথায় চাপ অনুভব করল অনন্যা, হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরল। ফোনের ওপাশে পল্লবী আজ অতি খুশি, তাই তো রাতের দিকেও এক মুহূর্ত দেরি না করেই মেয়েকে ফোন দিয়েছেন।
গাড়িটা এসে থামল এক রেস্তোরাঁর সামনে। আশপাশটা বেশ নীরব। দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ। বাতাস বইছে ধীরে। কিন্তু ঠান্ডা একটা অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে। রেস্তোরাঁর সামনের ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো পড়ে রাস্তার একপাশে ছায়া তৈরি হয়েছে। অনন্যা ফোনটা কানে চেপে রেখেই দরজা খুলে বাইরে বের হলো।
কৌশিক নিঃশব্দে তার হাত ধরে ফেলল। অনন্যা চমকালো না, শুধু একবার চোখ দুটো তুলে স্যারের দিকে তাকালো। চোখে কিছু প্রশ্ন, কিছু না বলা কথা। রেস্তোরাঁর দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই কর্মচারীরা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল। এত রাতে অতিথি আসাটা অপ্রত্যাশিত। বেশিরভাগ টেবিল ফাঁকা, কয়েকজন কর্মচারী টেবিল গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। খাবারের সুবাস মিলিয়ে গেছে, বোঝাই যাচ্ছে রান্নাঘর অনেক আগেই বন্ধ হয়েছে।
কৌশিক কোনো কথা না বলে অনন্যাকে নিয়ে চুপচাপ এক কোণে বসে পড়ল। অনন্যা এখনো ফোনের কথোপকথনেই ব্যস্ত। মায়ের সাথে কথোপকথন শেষ করতে গিয়ে সময় লাগছে। চারপাশ বেশ নিস্তব্ধ, টেবিলগুলোর ওপরের আলো ম্লান হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে ঘুমন্ত শহরেরই এক অংশ এই রেস্তোরাঁ।
কিছুক্ষণ পরেই দুইজন কর্মচারী দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো, হাতে মেন্যু নিয়ে। তাদের দৃষ্টিতে দ্বিধা খেলা করছে, হয়তো এত রাতে অতিথি আসার জন্য প্রস্তুত ছিল না তারা। অনন্যা ফোনটা কেটে রাখতেই কৌশিক মেন্যুর পাতা উল্টে একবার দেখে নিয়ে বলল,
"আহ! বুঝতে পারছি না কী অর্ডার করবো। আসলে আপনাদের ম্যাডাম একটু বায়না ধরলেন, তাই আর কী! তো এই রাত করে যা খেয়ে আমাদের পেট ভরবে আর আপনাদের জন্য বানানো সুবিধা হবে, সেটাই নিয়ে আসুন।"
অনন্যা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। কর্মচারীদের মুখেও অবাক ভাব। কৌশিকের পোশাক-আশাক, ভাবভঙ্গি সবই বলে দিচ্ছে সে অভিজাত পরিবারের ছেলে। নিশ্চয়ই বড় কিছু অর্ডার দেবে, এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ সে বরং তাদের সুবিধার কথাই আগে ভাবল! বিস্ময়ে জড়িয়ে তারা একে অপরের দিকে তাকালো, তারপর দ্রুত পরামর্শ করে কী পরিবেশন করা যায় ঠিক করল। কৌশিককে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হাসিমুখে বলল,
"খুব শিগগিরই খাবার নিয়ে আসছি, স্যার।"
তারপর অনন্যার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। অনন্যার জন্য ও প্রশংসা লুকিয়ে আছে সেই হাসিতে। অনন্যাও বিনয়ের সাথে একটুখানি হাসল। কিন্তু মাথার ভেতর তখন অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে কখন বায়না ধরল? সে তো ঘুমিয়েই ছিল! অবশ্য সত্যিই তার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে, এখন না খেলে মনে হচ্ছে পেটটা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তাই বলে কৌশিক স্যার ওর নামে এত বড় মিথ্যা কীভাবে বলে দিল! ভাবতে ভাবতে এক সময় মুখ গোমড়া হয়ে গেল অনন্যার। কৌশিক স্যারকে কিছু বলবে কি বলবে না, তা ঠিক করতে পারছে না।
কৌশিক অপলক দৃষ্টিতে অনন্যার দিকে তাকিয়ে আছে। স্যারের চোখে স্থিরতা। অনন্যা বিরক্ত হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে আশেপাশে তাকালো। সে কতবার জিজ্ঞেস করেছে, কোথায় যাচ্ছে তারা? কিন্তু কৌশিক কোনো উত্তর দেয়নি। এখন তার আর ইচ্ছে নেই এই লোকটার দিকে তাকানোর, কথাও বলার। কিন্তু হঠাৎই কৌশিক হাসতে লাগল।
অনন্যা ভ্রু কুঁচকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল,
"হাসছেন কেন?"
কৌশিক অনায়াসে উত্তর দিল,
"আমার ইচ্ছে।"
অনন্যার ধৈর্য হারিয়ে যাচ্ছে। একটু থেমে ঠান্ডা স্বরে বলল,
"ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবেন না। অন্যদিকে চোখ রাখুন।"
কৌশিক নিঃসঙ্কোচে আবারো বলল,
"আমার ইচ্ছে।"
অনন্যার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। টেবিলে হাতের তালু চাপড়ে বলল,
"চোখ তুলে ফেলবো বলে দিলাম!"
কৌশিক নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত ভাঁজ করল, মুখে খেললো চেপে রাখা এক হাসি।
"বাপরে! কী সাহস!"
অনন্যা স্যারের দিকে আরেকবার কটমট করে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে মাথা ঘুরিয়ে নিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উফফ! এই লোকটা এত খচ্চর হতে পারে! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। কৌশিক কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল, ধীর পায়ে কোথায় যেন চলে গেল। অনন্যা ফোন বের করল সময় কাটানোর জন্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ কৌশিক স্যারের কথা মনে পড়ল। এই লোকটার কি কোনো অনলাইন প্রোফাইল নেই নাকি? কৌতূহলী হয়ে সার্চ দিলো ইশতেহার কৌশিক নাম লিখে। কিন্তু কিছুই পেল না। অন্য নামে সার্চ করতে গিয়েও থেমে গেলো সে। মনে পড়লো এই বিষয়ে অনেক আগেই খতিয়ে দেখেছিল তাদের বন্ধুদের দল। চিন্তা করতে করতে কৌশিক স্যারকে ফিরে আসতে দেখা গেলো। উনার হাতে একটা সফট ড্রিঙ্কসের বোতল। বোতলের ক্যাপ খুলে নীরবে অনন্যার সামনে ধরল। অনন্যা কিছু বলল না, ধরলো ও না। কৌশিক স্যারের ও একি অবস্থা । কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে অনন্যার সিটের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর একটুও সংকোচ না করে অনন্যাকে পাশে ঠেলে বসে পড়ল। অনন্যা তো হতভম্ব ! এ কী করছে লোকটা!
কৌশিক এক হাত পেছনের চেয়ারে রেখে অনন্যার দিকে ঝুঁকল, ফিসফিসিয়ে বলল,
"কি ম্যাডাম? রেগে আছেন?"
অনন্যার গলা শুকিয়ে এলো। ঢোক গিলল ধীরেসুস্থে।কৌশিক আরও কাছে এসে তার কানের কাছে গিয়ে বলল,
"মিসেস হার্ট! অনেক দূরে যাব আমরা।"
অনেক দূরে? এক মুহূর্তের জন্য সমস্ত শরীর দিয়ে হালকা শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল অনন্যার। চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। এত কাছে! উফফ! এতো কাছে এল কেন কৌশিক স্যার?
অনন্যা আস্তে করে বলল,
"ক-ক-কোথায় যাচ্ছি?"
কৌশিক মুচকি হাসল,
"এনি গেস, প্রিন্সেস?"
অনন্যা ধীরে ধীরে চোখ খুলল। স্যারের দিকে ঘুরে তাকাতেই টুক করে কপালে নরম একটা স্পর্শ বসে গেলো! কৌশিক স্যার গভীর চুম্বন বসিয়ে ছেড়ে দিলো অনন্যাকে। তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি তাদের মধ্যে। অথচ অনন্যার পেটে কতগুলো প্রজাপতি উড়ছে। অনন্যা এখনো হতভম্ব হয়ে আছে। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে কৌশিকের দিকে। মনে হলো বুকের মাঝে একটা উষ্ণতা ধীরে ধীরে সময় নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
কৌশিক উঠে আবারো বিপরীত দিকে বসে পড়ল।অনন্যার হঠাৎ মনে হলো, লোকটা একটু বেশিই হাসছে আজ। কৌশিক স্যারকে কখনো এত হাসতে দেখেনি সে!
কৌশিক বললো,
"স্মার্টফোন! স্মার্টফোনের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপস! ইট টেকস ইউর ভ্যালুয়েবল টাইম। দ্যাটস হুয়াই, আই হ্যাভ নো একাউন্ট। ইউ ওন্ট ফাইন্ড মি থ্রু সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপস!"
অনন্যা চোখ বড় বড় করে তাকাল।
"এর মানে আপনার কোনো একাউন্ট নেই?"
"না!"
অনন্যা হেসে বলল, "কি আদিম যুগের মানুষের সাথে থাকি আমি!"
কৌশিক কাঁধ ঝাঁকালো, "যেটা ইচ্ছে মনে করো। বাট যেটা বলেছি সেটা সত্য। দিনে কত ঘণ্টা এসবে সময় কাটাও চিন্তা করো। যাই হোক, তোমাকে এসব জ্ঞান দিয়ে লাভ নেই।"
অনন্যা ঠোঁট কামড়ে ফোনটা ব্যাগে রেখে দিল। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
"তাহলে কীভাবে খুঁজে পাবো আপনাকে?"
কৌশিক ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলল,
"খুঁজতে হবে। কেন? চোখের সামনেই তো আছি।"
অনন্যা মাথা নাড়ল, "উঁহু! যদি কখনো....!"
কৌশিক চিন্তিত হয়ে বললো,
"আমাকে মনে করবে, এসে পড়বো। তাও যদি না আসি, তিনটে গোলাপ দিয়েছিলাম না? নিয়মিত পরিচর্যা করবে। বুঝবো তুমি মিস করছো। তারপর যদি ইচ্ছে হয় আসবো, নাহয়...!"
অনন্যা চোখ কুঁচকে তাকাল কৌশিকের দিকে। মনে হলো, এই লোকটাকে যদি একটা জোরের ওপর কিল মারতে পারত! কীভাবে পারেন উনি এমন একখান কথা বলতে? এই লোকটা না থাকলে তো অনন্যার জীবনে অনেক কিছুই থাকবে না!
ভোরের রোদ এসে গায়ে পড়বে, কিন্তু মন ভরবে না। গাছে ফুল ফুটবে, কিন্তু রঙের উজ্জ্বলতা কমে যাবে। বাতাস বইবে, কিন্তু সেই চিরচেনা সুর থাকবে না। সব ঠিক থাকলেও কিছুই ঠিক থাকবে না। কৌশিক না থাকলে অনন্যার জীবনটা ঠিক আগের মতো হবে না, আর সে এক ফোঁটাও ভালো থাকবে না। তাহলে এই মানুষটা এমন কথা কীভাবে বলতে পারে?
একখান ভালোমতো ঘুঁষি মারার জন্য অনন্যার হাত নিশপিশ করছিল। কিন্তু সে কেবল গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। চোখ সরিয়ে নিলো পাশে থাকা জানালার বাইরে। না, এই লোকটার ওপর রাগ করেও ঠিক থাকা যায় না!
ইতিমধ্যে খাবার এসে পড়েছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল। এখন দুজনেই গাড়িতে বসে। কৌশিক কিছুক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করে এসে পাশে বসতেই আচমকা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো অনন্যা।
"পাহাড় নাকি সমুদ্র?"
কৌশিক একটু থমকালো। এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না সে।
তবু নির্দ্বিধায় উত্তর দিল,
"সমুদ্র!"
অনন্যা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
"কেনো?"
কৌশিক মৃদু হাসল। গাড়ির জানালার বাইরে রাত গভীর হয়ে এসেছে। বাতাসে শীতলতার ছোঁয়া। চোখ মেলে সে একবার আকাশের দিকে তাকাল, তারপর শান্ত স্বরে বলল,
"সমুদ্র ছিল বলেই আজ তোমাকে পেয়েছি। তোমার জন্মের সময় সমুদ্র ছিল বলেই আমার জীবনের সবচেয়ে সুখকর সময়গুলো এই গভীর সমুদ্রের সঙ্গেই কাটাতে পারছি। তাই আমার জন্য সবসময়ই সমুদ্র! সমুদ্র! সমুদ্র!"
অনন্যা মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
"হুম! তাহলে আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি।"
"ওয়াও বুঝে গেছো?"
অনন্যা মাথা নাড়িয়ে হেসে ফেলল। রাগটা আর থাকল না, উধাও হয়ে গেল হাওয়ায় মিলিয়ে ঝিলিয়ে। সিটে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলো, চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্তের জন্য। কৌশিকও ম্লান হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
গাড়ির ভেতর হালকা আলো জ্বলছে, বাইরে রাতের নরম বাতাস গাড়ির জানালায় এসে ধাক্কা দিচ্ছে। কৌশিক একটা গান চালিয়ে দিলো।
পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভোর হয়ে যায়। অনন্যা তো গাড়ির মধ্যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কৌশিক একটু দ্বিধায় পড়ে অনন্যাকে ডেকে তুলতে চেষ্টা করছিল। গাড়ির জানালা দিয়ে ঢুকছে স্নিগ্ধ ভোরের হাওয়া। সাগরের লবণাক্ত গন্ধ বাতাসে মিশে আসছে। কক্সবাজারের সুরেলা ঢেউয়ের গর্জনও সঙ্গী হয়ে ভেসে আসছে। সমুদ্রের তটরেখা জুড়ে আকাশের নরম সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে। দূরে, সূর্য উঠতে শুরু করেছ। সমুদ্রের জলরাশিতে সূর্যের আলো স্বাদ করে শীতলভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে, সাগরের তীর থেকে উঠে আসছে দিনের প্রথম আলো। কক্সবাজারের সৈকতের ধারে চলে আসা স্নিগ্ধ শীতল বাতাস অনন্যার গা স্পর্শ করছে। আর কৌশিক ভাবছে, কখন অনন্যা চোখ মেলবে এবং এই সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাক্ষী হবে। কৌশিক অনন্যার চুল ঠিক করে দিতে লাগলো। কৌশিকের স্পর্শ পেয়ে আর রোদের অল্প আলো চোখে পড়তেই অনন্যা চোখ খুললো। আবছা চোখে প্রথমেই তাকালো চারপাশে। তারপর আচমকাই চিৎকার করে বললো,
"সবাই ছুটে যাচ্ছে সূর্যোদয় দেখতে। আমরা বসে আছি কি করতে?"
কৌশিক বাঁকা চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
"তোমার ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষায়।"
অনন্যা দাঁত কিড়মিড়িয়ে ঠেলা দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো। বের হতে গিয়ে গাড়ির সাথে মাথা লাগিয়ে একখান ব্যথাও পেলো। তাও তোয়াক্কা করলো না সে। ছুটে গেলো দৌড়ে। কৌশিকও আর বসে রইল না। অনন্যার পিছু পিছু গেলো। এই ভোরেও অনেক মানুষের সমাগম। পর্যটকও কম নয়।
সূর্যোদয়ের প্রথম রশ্মি সাগরের উপর পড়ে আকাশের নীলাভ ছায়া ধীরে ধীরে সোনালি আভায় বদলে যাচ্ছে। সাগরের ঢেউগুলো নতুন দিনের সঙ্গীত গাইছে। মৃদু গর্জনে ভোরের নিস্তব্ধতা ভাঙছে। সৈকতের বালিতে ঝকঝক করছে সূর্যের আলো। আর তার প্রতিফলনে সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রের উপর। দূরে, হালকা মেঘে আকাশের সীমানায় সূর্যের গোলাকার আকার অনেকখানি দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। একটি অমূল্য রত্ন আকাশের কোলে ভেসে উঠছে। সৈকতের আশপাশে মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে।
কৌশিক প্রথমবার এখানে এসেছে। কখনো দরকার পড়েনি এখানে আসার। কিন্তু আজ সে এসে দাঁড়িয়েছে, কারণ অনন্যার জন্মস্থান এখানেই। কেউ একজন তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ফেলে চলে গিয়েছিল। কেনো চলে গিয়েছিল, সে প্রশ্নে মগ্ন হতে চায় না কৌশিক। অতীতের যন্ত্রণায় ডুবে থাকতে সে আগ্রহী নয়। হয়তো, অনন্যার জন্মকথাও তেমনই অন্ধকারে ঢাকা, যেমন কৌশিকের নিজস্ব অতীত। অনন্যাকেও কখনো নিজের অতীতের দিকে কৌতুহলী হয়ে দেখেনি। সে বর্তমানকে নিয়ে সুখী। সুখী থাকুক এই ছোট্ট মেয়েটা। কৌশিক মূলত ওকে নিয়ে এসেছিল এই সমুদ্রের সৌন্দর্যকে দেখানোর জন্য। যার জন্য অনন্যার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে বিদ্যমান।
এই পৃথিবী, এই সময়, এই বর্তমান সুন্দর হতেই পারে। যদি আমরা সময়টাকে সুন্দর করে তুলতে পারি। তাহলে কেনো সুন্দর হবে না? কেনো একজন মানুষের হাজার বছর বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগ্রত হবে না? অন্তত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটার হাসি আরো অনেক বছর দেখার জন্য হলেও কৌশিক এই অমরত্বের ভার বহন করতে চায়। এতো দিন জ্ঞান পিপাসু কৌশিক লক্ষ্য বিহীন ছিল। আজ এই মূহুর্তে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তার লক্ষ্য খুঁজে পেলো। এই ধরণীর কাছে আরো কিছু সময় চেয়ে নিলো।
.
.
.
চলবে........................................................................