অন্তর্নিহিত কালকূট - পর্ব ১১১ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


ছোট্ট ঘরটা এখন স্তব্ধ। খানিক বাদে বাদে মীরার যন্ত্রণাকাতর মৃদু গোঙানী শোনা যাচ্ছে কেবল। ভারি বর্ষণ থেমে এখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বজ্রপাতের আওয়াজটা আর নেই। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। একদফা নিজের কাজ সেড়ে নিয়েছে সম্রাট। নেশায় ডুবে থাকা শরীরে এখন ক্লান্তি। ঘামে চিকচিক করছে তুষ্টপুষ্ট উন্মুক্ত শরীরটা। উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াল সম্রাট। আড়মোড়া ভাঙল। মাত্রই এমন নিকৃষ্ট কাজ করে উঠেছে তা ওর মুখভঙ্গি দেখে বোঝার উপায় নেই। অলস হাতে একটা সিগারেট ধরাল ও। লালচে চোখে তাকাল খানিক বাদে বাদে বিদ্যুতে ঝলসে ওঠা আকাশের দিকে। যতবার কোন নারীর সংস্পর্শে আসে, ততবার রাণী নামক মেয়েটা এসে চিনচিনে ব্যথা ধরিয়ে দেয় মস্তিষ্কে। ঐ একটা মেয়ে, যাকে চেয়েও সেভাবে পায়নি সম্রাট। জীবনের এতো নারীর শরীরের স্বাদ নিয়েছে, অথচ সেই নারীর শরীর সেভাবে ছুঁতেও পারেনি যে ওর প্রেমিকা ছিল। প্রতিবার এমন সময়ে ওর মাথায় একটাই চিন্তা আসে, রাণীর শরীরের স্বাদ এর চেয়ে কতবেশি? যে মেয়ের চোখে এতো তেজ, কথায় এতো তেজ। তার শরীরের তেজ কতটা আনন্দদায়ী হবে! চিন্তা করতেই উন্মুক্ত শরীরটা আরও বেশি উষ্ণ হয়ে উঠল ওর। শিউরে উঠল যেন। কিন্তু তখনই মনে এলো, যে আনন্দের স্বপ্ন সম্রাট রোজ দেখে, তা রুদ্র প্রতিরাতে পেয়েছে। উপভোগ করেছে। রাণীর শরীরের প্রতি ইঞ্চিতে বিচরণ ছিল তার। রুদ্র আমের সেই নারীকে সম্পূর্ণরূপে পেয়েছে যে কি-না সম্রাট তাজওয়ারের জন্যে এক অধরা বাসনা। শরীর আরও বেশি গরম হয়ে উঠল সম্রাটের। তবে এবার রাগে-জেদে!
দরজায় 'ঠক ঠক' আওয়াজ হতেই চিন্তায় ছেদ ঘটে সম্রাটের। ভ্রুকুটি করে তাকাল দরজার দিকে। খানিকটা চেঁচিয়ে বলল, 'কী হয়েছে কী?'

ওপাশ থেকে সাজ্জাদ বলল, ' বৃষ্টি থেমে গেছে স্যার। আর দেরী করাটা মনে হয়না ঠিক হইব না।'

বিরক্তিতে মুখ তেঁতো হয়ে উঠল সম্রাটের। বিশ্রী একটা গালি ছেড়ে বলল, 'চুপচাপ বাইরে থাক শু*র। ডিস্টার্ভ করবিনা। এই শালীর সাথে তোগোও মাইরা রাইখা যাইমু নয়তো।'

কথাটা বলে আবার তাকাল বিছানায় পড়ে কাতরাতে থাকা মীরার দিকে। পড়নে শুধুই একটা কামিজ। স্যালোয়ারটা পরে আছে একপাশে। কুমারী শরীর নিতে পারেনি সম্রাটের অমন হিংস্র অত্যাচার। যোনিমুখ থেকে র*ক্ত চুইয়ে নেমেছে হাঁটু অবধি। কিন্তু সম্রাটের ভেতরটার জানোয়ারটা জেনো আরও ভীষণ হিংস্রভাবে জেগে উঠল। হাঁটুতে ভর দিয়ে আরও একবার চড়ে বসল বিছানায়। আওয়াজ শুনে কেঁপে উঠল মীরা। সম্রাটকে ওর দিকে আরও একবার ঝুঁকতে দেখে ফুঁপিয়ে উঠল। বিদ্ধস্ত শরীরটা নড়ানোর শক্তি অবধি নেই। কোনমতে হাত জোড় করার ব্যর্থ চেষ্টা করল। অস্পষ্ট, মৃদু গলায় বলল, ' ন-না, ছেড়ে দি-দিন। আল্লাহ্ দ-দোহাই লাগে। আ- আর ন্ আ।' 

আর কিছু বলার সুযোগ পেলোনা মীরা। তার আগেই নিজের হিংস্র থাবা বসালো সম্রাট। শরীরে অবশিষ্ট কামিজটা একটানে ফ্যারফ্যার করে ছিড়ে ফেলল। খুলে নিয়ে ছুড়ে মারল একপাশে। অতঃপর আবার শুরু হল সেই বিভিষিকাময় অত্যাচার। মীরার মনে হল প্রাণবায়ু এক্ষুনি বেরিয়ে যাবে ওর। সম্রাটের একেকটা নির্দয় প্রক্রিয়ায় যন্ত্রণায় দমবন্ধ হয়ে এলো ওর। একপর্যায়ে সম্রাটের উত্তেজনা এবং উন্মাদনা এতো বেশি বাড়ল যে শরীর অসাড় হয়ে গেল মীরার। চোখের কোণ দিয়ে রক্ত উঠে এলো। সবটা অন্ধকার হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল প্রায়। সেই ঘোরের মাঝেই মীরার মনে ভাসল জয়ের মুখটা। ছেলেটা কী শুনতে পেয়েছে ওর আর্তনাদ? জেনেছে কী ঘটে গেল ওর সঙ্গে। কেন আসছেনা বাঁচাতে? এরপরও কী ভালোবাসবে কখনও জয় ওকে। আগের মতো নিজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বলবে, ভালোবাসি? নাকি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে? ছোঁবেনা আর? আর প্রিয়তা? জয় কী বলেছে প্রিয়তাকে কী হচ্ছে এখানে? সে কেন বাঁচাচ্ছেনা ওকে? ওর সঙ্গে যে অন্যায় হল, তার শাস্তি কী প্রিয়তা এই জানোয়ারটাকে দেবেনা? বাবা-মায়ের কথাও ভীষণ মনে পড়ল ওর। চিৎকার করে কান্না পেল। ইশ্, যদি জয়টাকে আরেকটাবার ভালোবাসি বলতে পারতো। একটাবার শেষবারের মতো দেখতে পারতো। আরেকটাবার!

ক্লান্তিতে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল সম্রাট। ঘামে ভিজে চুবচুবে হয়ে গেছে শরীর। মীরার ওড়নাটা তুলে নিয়ে কোনমতে মুখটা মুছে নিল ও। অতঃপর অলস হাতে লাগালো প্যান্টের জিপ। মীরার নড়ার শক্তি নেই। প্রায় অচেতন। শুধু কীসের আকাঙ্ক্ষায় যেন বারবার তাকাতে চাইছে চোখ মেলে। লম্বা দুটো শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করল সম্রাট। অতঃপর আবার ঝুঁকে গেল মীরার দিকে। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে দুহাতে শক্ত করে টিপে ধরল মীরার গলা। ন*গ্ন শরীরটা ঝাঁকি খেয়ে উঠল। বিস্ফোরিত চোখে তাকাল সম্রাটের দিকে। হাতের চাপ বাড়াল সম্রাট। মীরার শ্বাসনালী দৃঢ়ভাবে রোধ হল, চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। অসহায়ের মতো দাপাতে শুরু করল মীরা। একটু শ্বাস নেওয়ার জন্যে ছটফট করল। মীরার ছটফটানীর সঙ্গে সমানতালে বাড়ল সম্রাটের হাতের চাপ। গোঁ গোঁ শব্দ বের হল মীরার মুখ দিয়ে। কিন্তু বেশিক্ষণ লড়তে পাড়ল না বিদ্ধস্ত শরীরটা। ধীরে নিথর হয়ে গেল মীরা। চিরকালের মতো।

মীরার মৃত্যু নিশ্চিত করে আবার উঠে দাঁড়াল সম্রাট। রাজ্য জয়ের ভঙ্গিতে লম্বা করে শ্বাস ফেলল। টলতে টলতে গিয়ে খুলে দিল ঘরের দরজা। সাজ্জাদসহ অপর লোকটা হুরমুর করে ভেতরে ঢুকল। বিছানায় পড়ে থাকা নগ্ন শরীরটা দেখে বলল, ' কাজ শেষ স্যার?'

সম্রাট আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ' হুঁ। বাকি কাজ সেড়ে ফেল। শরীরটা মুছে, কাবার্ড দেখে একটা জামা নিয়ে পড়িয়ে দে। তারপর বড় ওড়নাটা দিয়ে ঝুলিয়ে দে ফ্যানের সাথে। আর হ্যাঁ বেডশিটও বদলে ফেল। আশেপাশের সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলবি। আর ছেড়া জামাগুলোও সব ব্যাগে তুলে ফেল। কুইক!'

নিজের লোকেদের নির্দেশনা দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল সম্রাট। ভেতরে তার দুজন লোক একটা নিরীহ মেয়ের ধ*র্ষণ এবং খু*নকে আত্মহত্যা সাজাতে ব্যস্ত।

••••••••••••••••

বাতাসের শো শো তীক্ষ্ম আওয়াজটা যেন হঠাৎই মিলিয়ে গেছে কোথাও। নদীর কলকল শব্দও আর কানে আসছেনা। কেমন ভ্যাঁপসা গরম। স্তব্ধ, দমবন্ধকর অবস্থা। উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকাল জয়। চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে নামল। বলল, ' জীবনের সবচেয়ে বিভৎস রাত পাড় করেছিলাম আমি সেদিন। জানতাম, চাইলেও সময়মতো পৌঁছতে পারবনা। তাই শুধু বারবার, বারবার আপনাকে কল করছিলাম। এই আশায় যে আপনি আটকাবেন ঐ জানোয়ারটাকে। কিন্তু পাইনি আপনাকে। পাগলের মতো চিৎকার করেছি। জানোয়ারটার কাছে ভিক্ষা চাইছিলাম মীরার প্রাণটুকু। কিছুতেই কোন লাভ হয়নি। শেষ করে দিলেন আপনারা ওকে। আপনার বাবার কর্মচারী ছিল ওর বাবা। তারওপর পুলিশও আপনার বাবার পরিচিত এক মন্ত্রীর দখলে। সেভাবে কেউ দেখার আগেই আত্মহত্যা বলে দ্রুত সরিয়ে ফেলা হল ওর ডেইডবডি। রিপোর্ট তৈরী হল যে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে ও। ওর পরিবারের লোকগুলি অবধি ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারল না কীভাবে কী হল। টাকা, ক্ষমতা আর খানিকটা গলার জোরের অভাবে কিছু করতেও পারল না। ওকে শেষবারের মতো দেখার সুযোগটাও আমি আর পাইনি।'

এইটুকু বলে থামল জয়। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল, 'মীরা খুব বেশি সরল ছিল ম্যাডাম। সাধারণত আমরা যাকে বোকা বলি। বোকা ছিল আমার মীরা। আপনার সবকথা বিশ্বাস করেছিল। সত্যিমিথ্যা যাচাই না করেই আপনাকে সাহায্য করেছিল। ওতো জানতোও না কী ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের ছোট্ট একটা গুটি ছিল ও। দায়ে পরে কিংবা আপনাকে ভরসা করে শুধু সেটুকুই করেছিল যেটুকু আপনি ওকে করতে বলেছিলেন। আপনাদের এই প্রতিশোধ, টেক্কা, প্রতারণার খেলায় কোনদিক দিয়ে কোন লেনদেন ছিলোনা ওর। বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিলোনা। অথচ দেখুন, এসবের মধ্যে সবচেয়ে বড় মূল্যটা ওকেই দিতে হলো।'

দুহাতে চোখের কার্নিশটা মুছে নিলো জয়। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল প্রিয়তা তাকিয়ে আছে নদীর জলের দিকে। গালে চিকচিক করা অশ্রু শুকিয়ে গেছে। চোয়াল, চোখ কেমন অদ্ভুতভাবে শক্ত হয়ে আছে ওর। গলার পেশিগুলো অস্বাভাবিক কাঁপছে। সেই কাঁপুনির সামান্য রেশ আছে বাকি শরীরেও। নিষ্ঠুর ঐ চোখদুটোতে যেন এ মুহূর্তে বিন্দুমাত্র দয়া-মায়া-করুণার কোন অস্তিত্বে নেই। জয় এবার অসহায় গলায় বলল, ' ওর দোষটা কী ছিল ম্যাডাম? শুধু এইটুকুই যে ও জানতো আপনার বাবা কে। আপনার আসল পরিচয় কী। ব্যস, এইটুকুই! এইটুকু সত্যি জানার অপরাধে ওকে মেরে ফেললেন আপনারা! আর যদি ধরেও নেই ওকে মেরে ফেলাটা আপনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু রে-রেপ? এতো নৃশংসভাবে! কীকরে পারলেন? ওতো বন্ধু ছিলো আপনার। একবারও বুক কাঁপেনি?'

বলতে বলতে গলা অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে উঠল জয়ের। যথাসম্ভব সামলে নিয়ে বলল, ' আমি জানি আমিও ধোয়া তুলসীপাতা নই। জীবনে অনেক পাপকাজ করেছি। এখনো সেসবে যুক্ত আছি। কিন্তু তাই বলে কখনও এতোটাও নীচে নামিনি। প্রচলিত একটা কথা আছে। ডাইনীও নাকি সাতঘর ছেড়ে আঘাত করে। আপনি সেই কথাকেও ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন।'

প্রিয়তা কিছু বলছেনা। নড়ছে অবধি না। সেভাবেই তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। তবে পেশীর সেই কম্পন কমছে ধীরে ধীরে। জয় বলে চলেছে, 'যতবার ওর কথা মনে পড়ে, বুকে অসহ্য ব্যথা হয় আমার। যন্ত্রণায় মরে যেতে ইচ্ছা করে। ওর সেইরাতের প্রতিটা চিৎকার এখনো কানের শিসার মতো আঘাত করে। রাতে ঘুমোতে পারিনা আমি। ছটফট করি। ঘুমোলেই সেই বিভৎস রাতটাকে স্বপ্নে দেখি। আমাদের বিয়ে নিয়ে ওর একেকটা স্বপ্ন, আমাদের একসঙ্গে কাটানো মুহুর্তগুলো আমায় ঠিকভাবে বাঁচতে দেয়না। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে এভাবে মরতে দেখা নরকের চেয়ে কম কিছু নয় ম্যাডাম। যাকে এতোটা ভালোবেসেছি তাকে শেষ দেখাটা অবধি দেখতে পারিনি আমি। ওর পরিবার কিছু করতে পারেনি। ক্ষমতা আর টাকার কাছে অসহায় ছিল। কিন্তু আমি কীকরে ছেড়ে দেই বলুনতো? যাদের জন্যে ওকে এতোটা যন্ত্রণা পেয়ে মরতে হয়েছে তাদের কীকরে ছেড়ে দেব? ওকে হারিয়েও আমি বেঁচে আছি শুধুমাত্র আপনাদের ধ্বংস করার জন্যে। সেইজন্যই আমি এসব করেছি। আপনার সঙ্গে থেকেই আপনার ধ্বংসের রাস্তা তৈরী ঈরেছি আমি। আপনার সঙ্গে সেটাই করেছি, যেটা আপনি রুদ্র আমেরের সঙ্গে করেছেন। ঐ দুটো দলকে শেষ করার জন্যে আপনাকে ধ্বংস করাই যথেষ্ট। আর রাণী মীর্জাকে ধ্বংস করার ক্ষমতা একমাত্র রুদ্র আমেরেরই আছে।'

এতক্ষণ নদীর দিকে দৃষ্টি থাকলেও এবার মাথা নুইয়ে হাসল প্রিয়তা। বলল, ' ইচ্ছে কী করছে জানো? এক্ষুনি তোমার মাথার খুলিটা উড়িয়ে দেই। কিন্তু তোমার শেষ লাইনটা আমার পছন্দ হয়েছে। তাই ছেড়ে দিলাম। এবারের মতো।'

জয় পরিচিত প্রিয়তার এধরণের কথার সঙ্গে। তাই কোন প্রতিক্রিয়া না দিয়ে বলল, ' আপনি আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন ম্যাডাম। তাই_'

জয়কে বাক্য শেষ করতে না দিয়েই প্রিয়তা বলল, ' চলে যাও জয়। একা থাকতে দাও আমাকে। 

' এইযে বললেন একা লাগছে?'

' এখন আর লাগছেনা। চলে যাও।

জয় খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ' এভাবে এখন এখানে একা থাকাটা ঠিক হবেনা ম্যাডাম। জানি আপনার কাছে পি*স্ত*ল আছে। কিন্তু একটা পি*স্তল দিয়ে সবসময় সব পরিস্থিতির মোকাবেলা করা যায়না।'

প্রিয়তা থমথমে গলায় বলল, ' কিন্তু একটা পি*স্তল দিয়ে একজনের প্রাণ নেওয়াই যায়। তুমি যদি এইমুহূর্তে এখান থেকে না যাও তো মারা পড়বে আমার হাতে।'

' ম্যাডাম_'

' যাও জয়। আমি চাইনা আমার হাতের পরবর্তী খু*নটা তোমার হোক। যাও!'

শেষ শব্দটা অনেকটা জোরে ধমক দিয়েই বলল প্রিয়তা। আর বসে থাকার উপায় পেলো না জয়। চুপচাপ উঠে চলে গেল সেখান থেকে। একবারও তাকাল না পেছন ফিরে। জানে কোন লাভ নেই। ইচ্ছেও নেই। 

প্রিয়তা ওখানে তখন একা। জয় চলে যেতেই অস্থিরভাবে একবার চারপাশে তাকাল প্রিয়তা। কেমন বিভ্রান্ত দেখালো ওকে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে খুলে পাশে ফেলে রাখল কালো জ্যাকেকটা। গুটিয়ে রাখা পা দুটোর মধ্যে একটা পা মেলে দিলো বালুতে। ওপরটা পা গোটানোই রইল, তবে ছড়িয়ে দিল হালকা। হাত দুটো পেছনে নিয়ে শরীরের ভর ছেড়ে দিল হাতের তালুর ওপর। চোখ তুলে তাকাল আকাশের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই ধীরে ধীরে স্থিরতা এলো ওর মধ্যে। একদৃষ্টিতে আকাশের দিকেই তাকিয়ে রইল দীর্ঘ সময়। খুব মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল আকাশের একেকটা নক্ষত্রকে। নিজের নতুন গৃহ নির্মাণের আগে মানুষ যেভাবে জমি পর্যবেক্ষণ করে দেখে, ঠিক সেভাবেই। হঠাৎই রহস্যময় একটুকরো হাসি ফুটল প্রিয়তার ঠোঁটে। আবছা আলোয় বড় বেশি বিষাদময় লাগল তা। প্রিয়তা ফিসফিসিয়ে বলল, 'জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা দেওয়ার সময় চলে এসেছে রুদ্র আমের। নিজেকে প্রস্তুত করুন। আমি জানি আপনি পারবেন।'

••••••••••••••••

সূর্য মাত্রই নিজেকে অন্তরাল করেছে পঞ্চিমে। কয়েকটা মসজিদ থেকে একসঙ্গে ভেসে এলো আজানের ধ্বনি। আজ একটু তাড়াতাড়িই অফিস থেকে বেরিয়ে এলো রিপন চৌধুরী। মনটা ফুরফুরে। নতুন একটা ডিল সই হয়েছে আজ। ইদানিং কম্পানি বেশ লাভে আছে। তারওপর ডার্ক নাইটের গুপ্ত সহায়তায় এক্সট্রা মাল কামাইও হচ্ছে। সোলার সিস্টেমের পতনের পরেই যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে সে। নয়তো কদিন পরপরই বড় একটা এমাউন্ড দিতে হতো আমেরদের। সে জায়গায় ডার্ক নাইটকে শুধু একবারই দিতে হয়েছে। তার বদলে উল্টে এখন পাচ্ছে সে। যদিও জানে, বেশিদিন এমন তোষামোদ করবেনা তাকে ডার্কনাইট। স্বার্থ হাসিল হয়ে গেলে সুদে আসলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, যা তারা দিচ্ছে। কিন্তু সে নিয়ে আহামরি চিন্তা নেই রিপনের। ডার্ক নাইটের কাছেতো রুদ্র আমেরের মতো তার হোটেল কান্ডের ভিডিও নেই, যা দিয়ে তাকে ব্লাকমেইল করবে। সেবারের পর থেকে ভালোই সতর্ক থাকে সে। রেকর্ড করার সুযোগ নেই। কথাটা ভাবতে ভাবতেই আনমনে হাসল রিপন চৌধুরী। গ্যারেজটা আবছা অন্ধকার দেখে ভ্রু কোঁচকালো। সেন্সর লাইট কাজ করছেনা নাকি? কাঁধ ঝাঁকিয়ে গাড়িতে উঠে বসল রিপন। আবছা অন্ধকারে একপলক দেখল ড্রাইভিং সিটে বসা ড্রাইভারের পেছনটা। সেভাবে লক্ষ করল না। ফোনে কেয়ার টেকারকে কল করতে করতে বলল, 'বাড়ি চলো।'

কোন জবাব না দিয়েই গাড়ি স্টার্ট করল ড্রাইভার। বেড়িয়ে যাওয়ার সময়টাতে রিপন কলে বলল, 'দেখোতো গ্যারেজের সেন্সর লাইটে কী সমস্যা হয়েছে। আমি বাড়ি যাচ্ছি।'

কল কেটে আবার ফোন দেখায় মনোযোগ দিল রিপন চৌধুরী। কিছু গুরুত্বপূর্ণ পেপারসের পিডিএফ দেখছে। অনেকটা সময় পর চোখ তুলতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল সে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল। বাড়ির রাস্তা ছেড়ে ভিন্ন দিকে যাচ্ছে গাড়িটা। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, 'বাড়ি যেতে বলেছি আমি! কোথায় যাচ্ছো?'

জবাব এলোনা কোন। উল্টে বেড়ে গেল গাড়ির স্পিড। যারপরনাই অবাক হল রিপল, ' কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি। কোথায় যাচ্ছো?'

এবারেও জবাব এলোনা। এবার বিরক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘাবড়ালোও রিপন। অস্থির হয়ে বলল, 'লাইট অন করো! ভেতরের লাইট অন করো!'

গাড়ির স্পিডটা আরও বাড়ল। রিপন হতভম্ব হয়ে বলল, ' কী হচ্ছে কী? লাইট জ্বালাও!'

ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটা স্বহাস্যে বলে উঠল, 'আপনার ঐ ঝাকানাকা হোটেল ভিডিও দেখেই বুঝেছিলাম আপনি অন্ধকারে না, আলোতে খেলাধুলা করা পাবলিক। অন্ধকারে খেলতে জানলে সেযাত্রায় বেঁচে যেতেন। দাঁড়ান, জ্বালাচ্ছি।'

গাড়ির ভেতরের লাইট জ্বলল। ঘাড় ফিরিয়ে পেছন ফিরে তাকাল গাড়িচালক। চমকে উঠল রিপন চৌধুরী। তার চমকানো মুখ দেখে দেঁতো হাসল ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা যুবক। কিন্তু রিপন পৌষের শীতের ঘেমে উঠছে। একে আগেও দেখেছে সে। রুদ্র আমেরের ডান হাত। উচ্ছ্বাস! রিপন কোনমতে বলল, ' ত-তুমি এখানে! আমার ড্রাইভার কই? গাড়ি কোথাও নিয়ে যাচ্ছো? থামাও!'
 
গাড়ি থামল না। অস্থির হয়ে উঠল রিপন। বুঝলে পারল ভয়ংকর বিপদে পড়তে যাচ্ছে সে। এবং সেটা তার প্রাণনাশও হতে পারে। জীবন বাঁচানোর তাগিদটা ভীষণভাবে অনুভব করল রিপন। জীবন বাঁচাতে হবে। যেকোন মূল্যে। চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। কিন্তু গাড়ি দরজা ধাক্কা দিতেই বুঝল লক করে হয়ে আছে। আরও একবার দাঁত বের করে হাসল উচ্ছ্বাস। বলল, 'দরজা লক খালি আপনিই লক করতে পারেন ভায়া? আমিও পারি। তবে আমি কিন্তু টোটালি স্ট্রেইট ভাই। দরজা লক পেয়ে আবার আমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করবেন না। আপনারতো আবার চরিত্রের ঠিক নাই।'

উপায় না পেয়ে রিপন সঙ্গে সঙ্গে নিজের সেক্রেটারিকে কল করতে গেল। কিন্তু নাম্বার ডায়াল করার আগেই পেছন ঘুরে ফোনটা কেড়ে নিল উচ্ছ্বাস। পুনরায় গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিয়ে বলল, ' কীযে করেন চৌধুরী। কোথায় একটু কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করছি আমরা। আপনি আবার থার্ড পার্সন ডাকেন ক্যান?' হঠাৎই চমকে ওঠার ভান করে বলল, 'ঐ মিঞা আপনে আবার থ্রি*সামে আগ্রহী না-কি?'

এমন ভয়ংকর অবস্থাতেও উচ্ছ্বাসের কথায় হাসি পেয়ে গেল রিপনের। কিন্তু নিজের পরিণতির স্মরণ হতেই পুনরায় গলা শুকিয়ে এলো তার। চেঁচামেচি করে লাভ নেই সে জানে। উচ্ছ্বাসের ওপর হুট করে আক্রমণেরও উপায় নেই। হাতে পি*স্ত*ল রেখে আগেই সে বিষয়ে সতর্ক করে ফেলেছে ব্যাটা। তাই অসহায়ের মতোই বসে রইল সে। কিছু করার নেই। গাড়িটা থামল একটা কন্সট্রাকশন এড়িয়াতে। আপাতত কাজ বন্ধ। সেখানেই অর্ধনির্মিত এক বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়ি থামাল উচ্ছ্বাস। ঘাড় ফিরিয়ে রিপনকে বলল, ' কোয়ালিটি টাইমের সময় শেষ। এবার চলুন আপনার থ্রি*সামের সখ পূরণ করি।'

ততক্ষণে গাড়ির দুপাশে দুজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে। ড্যাশবোর্ডে বোতাম চেপে দরজা আনলক করল উচ্ছ্বাস। সঙ্গে সঙ্গে রিপন চৌধুরীকে গাড়ি থেকে টেনে বের করা হল। সে কিছু বোঝার আগেই তাকে নেওয়া হল বিল্ডিংয়ের ভেতরে। পেছন পেছন হেলতে দুলতে এলো উচ্ছ্বাস। ঠেলতে ঠেলতে দোতলায় নিয়ে তোলা হল রিপনকে। রিপন চৌধুরী অনুমান করে ফেলেছিল কী হচ্ছে। কিন্তু যখন আবছা অন্ধকার জায়গাটায় চেয়ারে বসা এক অবয়ব দেখতে পেল। মুহুর্তেই সবটা স্বচ্ছ কাঁচের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে। অমন সুদৃঢ় দেহের গঠন, হাতে ঝুলতে থাকা ব্রেসলেট, সাক্ষাৎ ধ্বংসের মতো অস্তিত্বের অনুভূতি এসবকিছু একসঙ্গে এই জগতে এক রুদ্র আমেরের মধ্যেই দেখা যায়। এইসব চিন্তার মাঝেই রিপনকে ঘাড় ধরে হাঁটু ভেঙে বসানো হলো। দ্রুতগতিতে পেছনমোড়া করে বেঁধে ফেলা হলো হাতদুটো। এসবের মধ্যেই উচ্ছ্বাস মশাল জ্বালিয়ে সেট করে ফেলল জায়গা মতো। রিপন হতভম্ব সামনে তাকিয়ে দেখল, তার ঠিক সামনের চেয়ারে বসে আছে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের এক যুবক। মশালের হলদে আলোয় তীক্ষ্ণ চোখদুটো আরও বেশি নিষ্ঠুর লাগছে, মুখে পুরোনো দু একটা কাঁটা দাগের সঙ্গে নতুন একটা দাগ তৈরী হয়েছে চোখের ঠিক বাঁ পাশে। এগুলো যেন আরও ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা ঢেলে দিয়েছে মুখটাতে। সরু পুরুষালি ঠোঁটের মাঝে গুজে রেখেছে এক জ্বলন্ত সিগারেট। তার দেখা জগতের সবচেয়ে সুন্দর কিন্তু নিষ্ঠুর পুরুষ। রুদ্র আমের! রিপন নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে বলল, 'আমাকে এভাবে হেনস্তা করার মানে কী আমের সাহেব?'

রুদ্র একপলক উচ্ছ্বাসের দিকে। মুচকি হেসে বলল, 'বছর দুই আগে একটা আবদার করেছিলাম আপনার কাছে? মনে আছে? আজকে সেই আবদারটাকেই আদেশ বানাতে এসেছি।'

রিপন চৌধুরী জানে রুদ্র কী বলছে। সেই ভয়ংকর বাক্যটা ভুলে যাওয়ার প্রশ্নেই ওঠেনা। তবুও মুখে বলল, 'মানে?'

' আপনার কম্পানিটা আমার চাই চৌধুরী।'

ঠিক দুই বছর আগের মতো। একই ভঙ্গিতে, একই তেজে, একই স্বরে বলল রুদ্র। সিনেমার ফ্ল্যাসব্যাকের মতোই যেন সেই দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের সামনে। ভেতরে ভেতরে ভয়ে কেঁপে উঠলেও বাহিরে দিয়ে নিজেকে দৃঢ় রাখল রিপন। শক্ত কন্ঠে বলল, ' এবারও কী দুবছর আগের সেই ভিডিও দেখিয়ে ব্লাকমেইল করবেন আমায়? সে চেষ্টা এবার করবেন না রুদ্র। কারণ পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। তখন মাফিয়া জগতে সোলার সিস্টেমের দাপট ছিল। এখন তা নেই। বরং এবার এধরণের কিছু করলে আমি অন্যভাবে আপনার বড় কোন ক্ষতি করাতে পারি।'

এবার দাঁত বের করে হাসল রুদ্র। হাসিটা ঠিক সেই প্রথমদিনের মতোই অমায়িক লাগল রিপন চৌধুরীর কাছে। রুদ্র বলল, ' এক চাল আমি বারবার দেইনা চৌধুরী। খুব বেশি বোরিং লাগে। আপনার পেছনে আবার লাগার খুব একটা ইচ্ছা ছিলোনা আমার। কিন্তু ভয়ংকর ভুল করে ফেলেছেন আপনি। বিট্রে করেছেন আমার সঙ্গে। তাও ওপেনলি। আর আমার আদালতে প্রতারণার শাস্তিতো জানেন আপনি।'

রিপন দমে যাচ্ছে। মৃত্যুভয়! যত যাই হোক রুদ্র আমের এখন এখানে তাকে খু*ন করলে কাকপক্ষীও কিছু টের পাবেনা। কিন্তু তবুও ছাড়ল না কন্ঠের দৃঢ়তা, ' তুমি যে চালই দাও। বিশেষ কোন লাভ হবেনা। কারণ আমাকে ব্লাকমেইল করে ঠেসে ধরার মতো ক্ষমতা এখন আর নেই তোমার। আমাকে কেন, নিজেকে ঠিকভাবে টেনে দাঁড় করানোর ক্ষমতাও নেই তোমার। তুমি ভেবেছিলে পাল্লা চিরকাল তোমারটাই ভারী থাকবে? আমার মতো আরও যত বিজনেসম্যানদের কাছ থেকে তুমি জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করেছো তারা সবাই মিলে বাঁশ দিয়েছে তোমাকে। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সবাই। সোলার সিস্টেমের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ওরা সবাই ডার্ক নাইট আর ব্লাক হোলের সঙ্গে জোট বেঁধেছে। পরবর্তী ডিলগুলো হ্যান্ডেলের জন্যে চুক্তিসহ অর্থও দিয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই ছিল। রাশেদ আমের এবং রুদ্র আমেরের ধ্বংস। এবং তা হয়েছে। তাই এই মুহূর্তে আমার ক্ষতি করেও তোমার কোন লাভ হবেনা। বরং ওদের আরও বেশি ক্ষেপিয়ে তুলবে তুমি।'

রুদ্র এবার ঝুঁকলো রিপনের দিকে। ঠোঁটে বক্র হাসি ফুটিয়ে বলল, ' তারা এখন কোথায় চৌধুরী? খোঁজখবর রাখেন?'

এইবার টনক নড়ল রিপন চৌধুরীর। ইদানিং বেশ কিছু ব্যবসায়ীর নিখোঁজ হওয়ার খবর শোনা যাচ্ছেনা? তারমানে কী দাঁড়ায়! রুদ্রই করাচ্ছে এসব! সে হতবাক চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র ঠোঁটের সেই বক্র হাসি বৃদ্ধি পেল। এবার আর এই হাসিটা অমায়িক ঠেকল না রিপন চৌধুরীর কাছে। বড্ড বেশি ভয়ংকর মনে হল। যেন সাক্ষাৎ শয়তান হাসছে। এবার আর কন্ঠে কোনরকম দৃঢ়টা রাখতে পারল না রিপন। তুঁতলে বলল, 'তোমার ঠিক কত টাকা লাগবে বলো আমাকে। কিন্তু প্রাণে মেরোনা।'

শব্দ করে হেসে ফেলল উচ্ছ্বাস। বলল, ' এই শালাতো সবসময়ই এক কাহিনী করছে। বাইরে দিয়ে এক্কেবারে সেগুন কাঠের ঠেঁকি কিন্তু পা দিলেই আমড়া। ছ্যাহ্। তা খোকা, হোটেল রুমের পারফরম্যান্সও কী সেইম?'

কথাটা বলে একটু ভ্রু উঁচু করল উচ্ছ্বাস। চোখ বুজে লম্বা শ্বাস ফেলল রিপন। রুদ্র সোজা হয়ে বসল। নিজের এমটি নাইট পি*স্ত*লটার সেইফটি ক্যাচ অফ করতে করতে বলল, 'আপনার কাছে কোন টাকা চাইনা আমার। আগেরবার না সই করা পেপারটায় এবার সই করে দিন। একদম ভদ্র বাচ্চার মতো।'

রিপন জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ঘাম ছুটছে দরদরিয়ে। প্রেশারটা বাড়ল নাকি? কোনমতে বলল, ' এই কম্পানি-ই আমার সব। আমি আগেই বলেছি তোমাকে রুদ্র। দিতে পারব না আমি।'

রুদ্র ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস সঙ্গেসঙ্গেই বের করল নিজের ফোনটা। একটা ভিডিও বের করে তুলে ধরল রিপনের চোখের সামনে। রিপন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরেই পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করল। গা গুলিয়ে বমি পেল তার। ভিডিওতে রুদ্র খুবই নির্মমভাবে খু*ন করছে একজনকে। লোকটাকে সে চেনে। তারমতোই একজন ব্যবসায়ী। তারইমতো প্রতারণা করেছে সে রুদ্রর সঙ্গে। ঠিক যে মুহুর্তে পশু জ*বাইয়ের মতো করে লোকটার গলায় কাটতে দেখল রুদ্রকে, পরিপূর্ণভাবে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে গেলো রিপনের। অবচেতনভাবেই প্রস্রাব করে ফেলল প্যান্টে। পুরোপুরি বিজে গেলো নিচের অংশ। তা দেখে শব্দ করেই হাসল উচ্ছ্বাস। রুদ্র গম্ভীর ভঙ্গিতেই হাত বাড়িয়ে দিল উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস বাড়িয়ে উইলের ফাইল আর কলমটা। রুদ্র ইশারা করতেই খুলে দেওয়া হল রিপন চৌধুরীর হাত। অতঃপর রুদ্র বলল, 'সই করুন।'

রিপন কম্পমান, অসহায় গলায় বলল, ' আমাকে মাফ করে দিন। দয়া করে মাফ করে দিন। আপনাদের সবরকম সহায়তা করব আমি। কিন্তু...'

বন্দুক থেকে গুলি বের হওয়ার আওয়াজ এলো। বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠল রিপন। রুদ্র আমের গুলি করেছে ঠিক তার ডান পায়ের হাঁটুতে। দু হাতে হাঁটু চেপে ধরে কাতরাতে থাকল রিপন। অসহায় চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্রর দৃষ্টি নিষ্ঠুর, ভাবাবেগহীন। কন্ঠেও সেই নিষ্ঠুরতা বজায় রেখে বলল, 'সই করুন।'

এবারের কিছু বলতে যাচ্ছিল রিপন। কিন্তু তার আগেই আরও একটা গু*লি চলল। এবার গু*লিটা লাগল রিপনের বাঁ হাতের কবজিতে। অকল্পনীয় যন্ত্রণায় চিৎকারের ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলল রিপন। রুদ্র আবারও একই গলায় বলল, 'সই করুন।'

দ্রুত হাতটা বাড়িয়ে দিল রিপন। সই করবে সে। উচ্ছ্বাস এগিয়ে এলো ফাইলটা ঠিকঠাকভাবে সেট করে ধরল রিপনের সামনে। কলমটা রিপন নিজেই ধরল। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে কোনমতে সই করে দিলো কাগজে। সঙ্গে সঙ্গেই ফাইলটা লুফে নিল উচ্ছ্বাস। গুছিয়ে রাখল নিজের কাছে। রুদ্র রিপনের চোখে চোখ রেখে বলল, ' রুদ্র আমের নামটাই বিশাল এক ভার। যেদিকেই যাক পাল্লা এমনিই ভারী হয়ে যায়। আর রইল বাকি সোলার সিস্টেম। রুদ্র আমেরের অস্তিত্ব সোলার সিস্টেম থেকে নয়, বরং রুদ্র আমের ছিল বলেই সোলার সিস্টেমের অস্তিত্ব ছিল।'

রিপন চৌধুরী যন্ত্রণায় উন্মাদের মতো কাতরাচ্ছে। চোখের জলে ভিজে গেছে গোটা মুখটাই। রুদ্র যেন ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে দেখল রিপনের অবস্থা। দেখতে দেখতেই বলল, 'কুকুর দুটো কোথায়?' 

উচ্ছ্বাস সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ' নিচে। বড় খাঁচাটাতেই আছে। শুধু আজকের রাতটার জন্যেই এনেছি। তোর কথায়। কাল থেকে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি।'

সেই ভয়ংকর হাসিটা আরও একবার দেখা গেল রুদ্র আমেরের ঠোঁটে। বিস্ফোরিত চোখে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইল রিপন চৌধুরী।

————————————————

সন্ধ্যার পর শওকত মীর্জার অফিসে মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে ডার্ক নাইট এবং ব্লাকহোলের। পরবর্তী ডেলিভারির প্লান ডায়াগ্রাম আজই বানানো হবে। প্রত্যেকেই যথেষ্ট সিরিয়াস এবার। কেননা এবারের এই ডেলিভারি সাকসেসের ওপর ডিপেন্ড করছে ওদের টিকে থাকা। নয়তো সব শেষ হয়ে যাবে। সবদিক দিয়ে পিষে ধরা হবে ওদের। কোনভাবেই হয়তো টিকে থাকা যাবেনা আর। প্রিয়তা আজ নির্দিষ্ট সময়ের বেশ অনেকটা সময় আগে এসে বসে আছে মিটিং রুমে। চেয়ারে হেলান দিয়ে পা দুটো তুলে দিয়েছে টেবিলের ওপর। একটা সিগারেটে জ্বালিয়ে টেনে যাচ্ছে আনমনে। সামনে দামি অ‍্যাশট্রে থাকতেও ছাইগুলো ঝেড়ে ফেলছে ফ্লোরে। মিটিংরুমে ঢুকে প্রিয়তাকে দেখে ভ্রু কোঁচকালো শান মীর্জা। এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, 'চেক করা হয়েছিল? রুমের কোথাও কোন ডিভাইস আছে?'

প্রিয়তা তাকাল না শানের দিকে। মুখভর্তি ধোয়া ছেড়ে বলল, 'একটু আগেই করে গেছে। নেই।'

' সারাদিন কোথায় ছিলি আজ?'

 'জাহান্নামে। যাবে নাকি সঙ্গে?'

' ত্যাড়ামিটা ছাড়বিনা না?'

' চাইলেই কী সব ছাড়া যায়? তুমি পেরেছো ছাড়তে?'

খানিকক্ষণ চুপ থাকল শান। অতঃপর খানিকটা উদাস গলায় বলল, ' পেরেছিলাম বোধহয়।'

মৃদু হাসল প্রিয়তা সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বলল, ' ওটাকে ছাড়া বলেনা। ইউজ করে ছেড়ে দেওয়া বলে। স্বার্থসিদ্ধি!'

কথা বাড়াল না শান। কপাল কুঁচকে বসে রইল চুপচাপ। সংলাপে খুব একটা বনিবনা কোনকালেই হয়না ওদের। রাণীকে সিগারেট টানতে দেখে ওর নিজেরও ক্রেভিংস হল। কিন্তু পকেট হাতিয়ে পেলোনা কোন প্যাকেট। আনেনি আজ। না তাকিয়েই শানের মনস্থিতি বুঝে ফেলল প্রিয়তা। অলস হাতে ছুড়ে ছিল সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার। ভ্রুদয় কুঁচকে রেখেই সিগারেট জ্বালাল শান। আর কিছু না বলে চুপচাপ সিগারেট ফুঁকতে থাকল ভাইবোন। হঠাৎই প্রিয়তা বলে বসল, 'তোমার সুমনা মীর্জাকে মনে পড়ে ভাইয়া?'

শান সিগারেট টানতে গিয়েও থেমে গেল, 'নিজের মাকে নাম ধরে ডাকছিস?'

' মা বলে ডাকার ইচ্ছে তোমার আছে?'

আবার চুপ করে রইল শান। কিছুক্ষণের মধ্যেই একে একে মিটিং রুমে প্রবেশ করল শওকত মীর্জা, পলাশ মীর্জা, করিম তাজওয়ার। সবশেষে এলো সম্রাট। সম্রাটকে দেখামাত্র চেয়ারে হেলান দিল প্রিয়তা। সরু চোখে তাকিয়ে রইল অপলক। পা দুটো চেয়ার থেকে নামিয়ে ফেলল ধীরে ধীরে। সকলে উপস্থিত হওয়ার পরপরই আলোচনা শুরু করে শওকত মীর্জা বলল, ' প্রথম কথা ডেলিভারীর ডেইটটা কবে হওয়া উচিৎ বলে মনে হচ্ছে?'

সম্রাট সঙ্গে সঙ্গে বলল, 'দুদিনের মধ্যেই। অতোটা সময় নেই আমাদের হাতে। জানুয়ারি মাস চলে এসেছে। পরবর্তী দশদিনের মধ্যেই দুটো ডিলিং সাড়তে হবে। সেটা যদি না হয় তাহলে আর কোনভাবেই ক্লাইন্টদের হাতে রাখা যাবেনা। আর আফ্রিকার ঐ জংলিগুলো ভয়ংকর ওয়াইল্ড। টাকা ঠিকঠাক পেলেও পরবর্তীতে ডিল করার সময় হাজারটা নখরা করবে বাইন**গুলো।'

শান বলল, ' কথাটা কিন্তু ঠিক। পরবর্তী ডিলের ডেইট দুদিনের মধ্যেই করা উচিত। যদি কোনভাবে আগের বারের মতোই কোন ব্লান্ডার হয়, ব্যপারটা বিকভারের কোন উপায় খোঁজার জন্যে যেন মিনিমান সময়টুকু যাতে পাই।'

করিম তাজওয়ার বলল, ' তোমার মনে হয় পরের ডিলটাতেও যদি রুদ্র কোন গন্ডগোল করতে সফল হয় তাহলে আর রিকভারির কোন উপায় আছে?'

পলাশ বলল, ' ওটা বাই এনি চান্স। যদি হয়ে যায়, হাতপা গুটিয়েতো বসে থাকব না।'

উত্তরে কিছু বলতেই যাচ্ছিল করিম। কিন্তু শওকত তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ' ডেলিভারিতে ঝামেলা হলে কী হবে সেই চিন্তা এখন বাদ দাও। এবারও কোনভাবে ঝামেলা হয়ে গেলে পরবর্তী পরিকল্পনা এমনিও খুব ভয়ংকর করতে হবে। আগেরবারের চেয়েও ভয়ংকর। কিন্তু এখন আলোচ্য বিষয় ভিন্ন। কোনভাবেই যাতে কোন ঝামেলা না হয় সেকারণেই এখন এখানে বসেছি আমরা। তারজন্যে সবার আগে এখন ডিসাইড করতে হবে ডেইট। দুদিন পর। পরশু দিনটা ফিক্সড করলে কেমন হয়?'

কথাটা শেষ করে প্রিয়তার দিকে তাকাল শওকত। বলল, 'তোমার কী মত রাণী?'

প্রিয়তা আনমনে কী যেন ভাবছিল। শওকতের প্রশ্নে ঝট করে তাকাল। হালকা নড়ে বলল, ' পরিকল্পনা এক্সিকিউশনের জন্যে একটাদিন সময় প্রয়োজন। আর ডেলিভারিটাও যত দ্রুত সম্ভব করে ফেলা উচিত। সে হিসেবে পরশুই ঠিক আছে। এবারের মালের টাকাগুলো সত্যিই ভীষণ দরকার। কারণ আমার পক্ষে হুসাইন আলীকে আর ম্যানেজ করা সম্ভব হবেনা।'

সম্রাট বলল, ' আগেরবার রুদ্র কীকরে আমাদের লোকেশন জেনে ফেলেছিল সেটা কিন্তু একটা প্রশ্ন। তাই এবার সেবিষয়ে আরও ভালোভাবে মনোযোগ দিতে হবে।'

পলাশ জানাল, ' এই রুমে কোন ডিভাইস নেই। সেটা নিশ্চিত।'

শওকত মীর্জা বলল, ' সেটা যথেষ্ট নয়।'

করিম জানাল, ' জানি। তাই আমি ঠিক করেছি এমুহূর্তে ব্লাকহোলের কেউ সিক্রেট পাসটা জানবেনা। জানব শুধুমাত্র আমরা একয়জন। স্পটে আমাদের মধ্যেতো কেউ থাকবেই।'

পলাশ সম্মত হল, ' ডার্ক নাইটের ক্ষেত্রেও তাই হবে।'

শান বলল, ' লোকেশনের ব্যপারটাও মাথায় রাখতে হবে আমাদের। ডেলিভারীতে যারাই থাকবে তারা কেউ স্পটে পৌঁছনোর আগে না জানে কোথায় যাচ্ছে।'

সম্রাট মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ' আলাদা আলাদা স্পটে গ্রুপওয়াইজ একসাথে ডাকা হবে ওদের। এরপর সেইম লোকেশনে। সেরকম হলে কেউ ফলো করে কিছু করতে পারবেনা। গুলিয়ে যাবে।'

শওকত বলল, ' আর মাল চেঞ্জিংয়ের পর গাড়ি চেঞ্জিং এর ব্যপারটা?'

প্রিয়তা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, ' আগের মতোই থাকবে। তবে কোথায় কোথায় গাড়ি বদল হবে, সেটা গাড়ির ড্রাইভার জানবে অন দ্য স্পট। ব্লু টুথে কানেক্টেড থাকব আমরা। আমাদের নির্দেশনা ছাড়া গাড়ি থামবেনা। আর নাতো ড্রাইভার জানবে কবে কখন এসব হবে। চেকপোস্ট ট্যাকেলের ব্যপারটা সেইমই থাকবে। এখানে নতুন করে চেঞ্জ করার কিছু নেই।'

শওকত মীর্জা বলল, ' আরতো কোন লূপহোল নেই। তাহলে সে অনুযায়ী ডায়াগ্রাম তৈরী করে ফেলো।'

সকলে সমস্ত পরিকল্পনার সঙ্গে সম্মত হওয়ার পর ডায়াগ্রাম প্রস্তুত করা শুরু হল। পুনরায় অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভাবছিল প্রিয়তা। হঠাৎ বলে বলল, ' বাবা?'

চমকে তাকাল শওকত। হঠাৎ এভাবে ডেকে ওঠায় অবাক হয়েছে বেশ। বলল, ' বলো?'

' হোম মিনিস্টারের তোমাকে টাকা দেওয়ার কথা কখন যেন বলেছিল?'

প্রিয়তার এহেন প্রশ্নে আরও অবাক হল শওকত। সকলেই তাকিয়ে আছে। তবুও বলল, ' ইলেকশনের সময়।'

প্রিয়তা 'চ্যাহ্' আওয়াজ কর বলল, ' সেসব না। এইসব ডিলিংয়ের জন্যে। দেওয়ার কথা ছিল না?'

শওকত গম্ভীর হয়ে বললেন, ' ছিল। কিন্তু গতবারের ব্লান্ডারটার পর ঝামেলা হয়ে গেছে। এবারের ডেলিভারিটা সফল হলে নেওয়া যাবে। ততদিনে সে চলে আসবে? কিন্তু কেন?'

প্রিয়তা চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ' তোমাকেতো আমি বলেই রেখেছিলাম। টাকাটা রিসিভ করতে আমি যাব।'

' বলেছিলে। কিন্তু তোমার যাওয়া কী ঠিক হবে? ঐ মিটিংটা একদমই সিক্রেট হবে। শুধুমাত্র ওনার আর আমার থাকার কথা। আমার বদলে তুমি গেলেও তাই হবে। সঙ্গে জয় বা তনুজা কাউকেই নিতে পারবেনা। আর ওনার সঙ্গেও কেউ থাকবেনা।'

' থাকার দরকারও নেই।'

' তবুও...'

' আমিই যাচ্ছি বাবা। সেটাই ফাইনাল।'

বাপ-মেয়ের কথার মাঝে নাক গলালোনা কেউ। অনুমতি পেতেই একজন এসে চা আর স্যাকস দিয়ে গেল সবার জন্যে। খেতে খেতে তেমন কোন কথা হচ্ছিল না। যে যার কাজে ব্যস্ত ছিল। নীরব ঘরটাতে হঠাৎই আরেকটা বো*মা ফাটিয়ে প্রিয়তা বলে উঠল, ' সম্রাট আর আমার বিয়ের বিষয়টা নিয়ে কী ভাবছো তোমরা।'

চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বিষম খেল করিম তাজওয়ার। শওকত আর শান দুজনেই ঝট করে তাকাল প্রিয়তার দিকে। পলাশের মুখ হা হয়ে গেছে ততক্ষণে। আর সম্রাটতো পারেনা নিজের গালে থাপ্পড় দিয়ে স্বপ্ন ভাঙাতে। সবাইকে এভাবে তাকাতে দেখে ভ্রু কোচকালো প্রিয়তা। বিস্কিটে কামড় বসিয়ে বলল, ' এমনভাবে তাকাচ্ছো যেন খুব নতুন কথা শুনলে? এনগেইজমেন্টতো হয়েই আছে। বিয়ে হবেনা?'

শান নিজেকে সামলে বলল, ' হঠাৎ এভাবে বললিতো তাই।'

প্রিয়তা বলল, ' যেটার জন্যে দুই চিরশত্রু দল এক হলো সেটা না হলে হয়? আফটার অল সম্রাট লাভস্ মি আ লট। ডোন্ট ইউ?'

শেষ দুটো শব্দ সম্রাটের দিকে তাকিয়ে বলল প্রিয়তা। সম্রাট চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে ছিল প্রিয়তার দিকে। মুচকি একটু হেসে বলল, ' অফ কোর্স আই ডু।'

উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা, ' তাহলে সেই ব্যবস্থাও করো ধীরে ধীরে। শুধু কাজ নিয়ে ভাবলে হবে? আমি আসছি। আমের ভিলায় ফিরতে হবে আমাকে।'

সম্রাট বলল, ' এখনো ওখানে কেন থাকব আমায় বলবে?'

প্রিয়তা নিজের পার্স তুলে বলল, ' অতি সুখে। সুখ শেষ হলে বেরিয়ে আসব।'

আর দেরী না করে রুম ত্যাগ করল প্রিয়তা। সম্রাট বোকা চোখে দেখল প্রিয়তার চলে যাওয়া। প্রিয়তা নিজে আবার বিয়ের কথা বলেছে ব্যপারটা হজম হচ্ছেনা ওর। খুশি আর সংশয় দুটোরই মিশেল অনুভূতি হচ্ছে মনে। যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকেই হতবাক করিম বলল, ' আপনার মেয়ের হয়েছেটা কী শওকত? অসুখ টসুখ বাঁধিয়েছে নাকি?'

শওকত মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করে বললেন, ' বাজে বকবেন নাতো। কাজের কথায় আসি। এই ডেলিভারি ঠিকঠাক না হলে কিন্তু আমাদের সত্যিই ভয়ংকর কিছু করতে হবে। প্লান বি এর চেয়েও ভয়ংকর।'

কথাটা বলে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিল শওকত। কিন্তু মনে মনে জানে, মেয়ে তার ভয়ংকর হয়ে উঠছে। আজকাল মানসিকভাবে ভীষণ অস্থির লাগে তার রাণীকে। এমন অস্থিরতা সে দেখেছিল রাণীর মধ্যে। বোর্ডিং থেকে ফিরে আসার পর। সেই অস্থিরতা শান্ত হয়েছিল ওর নিজেরই মায়ের রক্তে। এবার কার? কার রক্তে শান্ত হবে রাণী?

••••••••••••••

অসম্পূর্ণ বিশাল অন্ধকার ঘরটাতে চার পাঁচটা মশালের হলদেটে আলো। বড় একটা লোহার খাঁচার মধ্যে বিকৃত আওয়াজে ঘেউ ঘেউ করছে প্রেসা ক্যানারিও। বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ ক্ষুধার্ত দুটো। খাঁচার ঠিক সামনেই রিপন চৌধুরীকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক। দড়ি দিয়ে বাঁধা রিপন চৌধুরী সর্বশক্তি দিয়ে মোচড়াচ্ছে, আকুতি মিনতি করছে। হাতেপায়ে ধরে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছে। খানিক বাদে বাদে বিস্ফোরিত চোখে তাকচ্ছে স্প্যানিশ এই ভয়ংকর কুকুরদুটোর দিকে। কিন্তু পাথুরে হৃদয়ের সেই রুদ্র আমের যেন আজ আবার সাক্ষাৎ বসে আছে ওখানে। নির্বিকারভাবে চেয়ারের ওপর পায়ে পা তুলে। রুদ্র গম্ভীর গলায় বলল, 'প্রতারণার শাস্তি আমি মাফ করতে পারিনা চৌধুরী। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করি। তোমার সময় চলে এসেছে।'

রিপন কাতর গলায় বলল, 'রুদ্র আমার বউ বাচ্চা আছে। মেয়েটা ছোট। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। ভুল হয়ে গেছে আমার। শেষবারের মতো ক্ষমা করে দাও। ভুল করেছি আমি।'

রুদ্র জবাব দিলোনা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উচ্ছ্বাস হাতের ইশারা করতেই খাঁচার ভেতর ছুড়ে মারা হল রিপন চৌধুরীকে। বন্ধ করে দেওয়া হল খাঁচার দরজা। সেকেন্ড কয়েক স্তব্ধ রইল সবকিছু। রিপন চৌধুরী বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখলেন কুকুরগুলো 'ঘেউ ঘেউ' থামিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চোরটে হিংস্র চোখ জ্বলে উঠল যেন। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল রিপন। শরীর জমে গেল তার। হঠাৎই কুকুরদুটো ঝাপিয়ে পরল তার ওপর। বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠল রিপন। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। চোখ সরিয়ে ফেলল উচ্ছ্বাস। রিপনের মর্মান্তিক আর্তনাদ আর কুকুর দুটোর হিংস্র আওয়াজে কেটে গেল অনেকটা সময়। পুরোটা সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই দৃশ্যটা দেখেছে রুদ্র। এরপর আবার স্থির হয়ে গেল সবকিছু। ক্লান্ত কুকুরদুটো নিজেদের নোংরা রক্তাক্ত মুখ দিয়ে দূরে সরে গেল। রুদ্র উঠে দাঁড়াল। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা ওর লোকেদের বলল, ' লাশটাতে ভারী পাথর বেঁধে কাপড়ে মুড়িয়ে ফেলে দিয়ে আসবি নদীতে। এখন না, মাঝরাতে যাবি।'

বলে আর দাঁড়াল না রুদ্র। রিপন চৌধুরীর ক্ষত বিক্ষত লাশটা ওখানেই ফেলে বেরিয়ে এলো রুদ্রকে নিয়ে।

•••••••••••••••

বাড্ডা অবধি পৌঁছতেই জ্যামের কারণে জিপ থামাতে হলো রুদ্রকে। রাত হয়েছে বেশ, তাও জ্যাম দেখে বিরক্ত হল। পকেট থেকে বের করে একটা সিগারেট গুজল মুখে। পাশ থেকে লাইটার দিয়ে ধরিয়ে দিল উচ্ছ্বাস। ও আগেই ধরিয়ে নিয়েছিল একটা। সিগারেটে লম্বা এক টান দিয়ে উচ্ছ্বাস বলল, ' কাহিনী কী বলতো? বউমণির সঙ্গে কী হয়েছে আবার তোর?'

রুদ্র বিকারহীনভাবে বলল, ' কী হবে?'

' সবকিছু ঠিকঠাক চলছেনা তোদের। বউমণিও আজকাল প্রায়ই বাহিরে থাকছে। তুইও কিছু বলছিস না। কেমন কোল্ড ট্রিটমেন্ট দিচ্ছিস একে অপরকে। কিছুতো একটা কাহিনী আছে যেটা তোরা কাউকে টের পেতে দিচ্ছিস না। ভয়ংকর কিছু অনুমান করছি আমি। সব ঠিক আছেতো?'

রুদ্র জবাব দিলোনা। উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বুঝল এ বিষয়ে কিছু বলবেনা রুদ্র আমের। তাই অন্যপ্রসঙ্গে এলো, 'এইসময় হঠাৎ রিপনকে মারলি ক্যান?'

রুদ্র সিগারেট মুখে গুজে রেখেই বলল, ' কারণটা তোর জানা। আমায় ডিচ করার সাহস করেছে। বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই ওর।'

' কিন্তু সেটাতো আর অনেক ব্যাবসায়ীই করেছে। তাদেরতো তুই মারিসনি।'

' কোথায় ওরা?'

' আরেহ্ ওদেরতো সরিয়ে ফেলল ব্লাক হোল আর ডার্ক নাইট। নিশ্চিত খু*ন করেছে। যাতে তোকে টাকা দিতে না পারে। ইদানিং তো ভাইরাল খবরই এই কিছু কিছু ব্যবসায়ীর এই হঠাৎ মিসিং হওয়া। তুইতো দু"একজন মেরেছিলি তাও বাকিদের ভয় দেখাতে। বাকিরাতো একটাও....'

বাক্যটা শেষ করতে নিয়েও থেমে গেল উচ্ছ্বাস। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল রুদ্রর দিকে। বাঁকা হাসল রুদ্র। ঠোঁট থেকে সিগারেটটা নামিয়ে বলল, ' আমি জানতাম আমার করা ব্যবসায়ীর লিস্টটা ওদের কাছে যাবেই যাবে। আর ওদেরকে সরিয়ে ফেলা হবে দুনিয়া থেকে। তাই আমি তাদেরই নাম লিখেছি যারা আমায় ডিচ করেছে। যাদে আমি সরাতে চাই। অথচ আমি আসলে কাদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছি সেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানতো না।'

জ্যাম ছাড়তেই জিপ আবার চলতে শুরু করল। উচ্ছ্বাস তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রুদ্র বলল, 'বিশ্বাসঘাতকতাকে আমি ঘৃণা করি উচ্ছ্বাস। সেটা সবাই জানে। ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নেই আসেনা।'

উচ্ছ্বাস হঠাৎ বলে উঠল, ' সেই বিশ্বাসঘাতকত আমি হলেও না?'

রুদ্র জবাব দিল, 'স্বয়ং আমি হলেও না।'

জবাবে কিছু বলার আগেই উচ্ছ্বাসের ফোনটা বেজে উঠল। সন্ধ্যা থেকে বন্ধই ছিল। কিছুক্ষণ আগেই অন করে রেখে দিয়েছিল পকেটে। ফোনটা বের করেই দেখল নীরবের নাম্বার। উচ্ছ্বাস ভ্রুকুটি করলে, ' হঠাৎ নীরব কল করল কেন?'

' ধরে দেখ।' 

কলটা রিসিভ করল উচ্ছ্বাস। 'হ্যালো' বলার পরপরই কেমন চুপ হয়ে গেল ও। অনড় হয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ কানে ফোন ধরে রাখল। অতঃপর থমথমে গলায় বলল, ' আসছি।'

আস্তে করে ফোনটা নামিয়ে রাখল উচ্ছ্বাস। চোখমুখ আচমকাই অদ্ভুত গম্ভীর হয়ে গেছে ওর। রুদ্র ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে বলল, ' কী হয়েছে?'

উচ্ছ্বাস চুপ থাকল কয়েক সেকেন্ড। অতঃপর রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, 'সন্ধ্যায় নাজিফার মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। স্পট ডেড! আমায় যেতে হবে।'

রাস্তায় গাড়ি আছে। তাই গাড়ির স্পিড সমান্য বাড়াল রুদ্র, 'আমিও যাচ্ছি।'

•••••••••••

রুদ্রর জীপ নাজিফাদের গাড়ির সামনে থামার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুতবেগে নামল উচ্ছ্বাস। প্রায় দৌড়ে এলো ভেতরে। রুদ্র পেছন পেছন হেঁটে এলো। বাড়ির সামনে পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল উচ্ছ্বাস। নাজমা বেগমের লাশটা বাইরে একটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছ। দেখার মতো অবস্থায় নেই। ডানে তাকাতেই দেখল থম মেরে পাথরের মতো বসে আছে নাজিফা। প্রায় ন'মাসের ভরা পেটের ওপর হাত দিয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে কেমন। যেন কোন বিকারই নেই। আশেপাশে কেমন অসহ্য করুণ গুঞ্জন। নীরব আর জ্যোতিও এসেছে। নীরব রুদ্রকে দেখে এগিয়ে এলো। রুদ্র চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ' কীভাবে হল?'

নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলল, 'সন্ধ্যায় নিজের ছেলের বাড়ি গিয়েছিলেন দেখা করতে। ফিরে আসার সময় ঘটে আঘটনটা। রাস্তা পাড় হওয়ার সময় একটা বাস এসে....। থেতলে গেছে মাথাটা।' 

রুদ্র কিছু বলল না আর। নাজিফার ওদিকে তাকিয়ে দেখল জ্যোতিকে। এতক্ষণ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল। সেমুহূর্তে ওখানে ব্যস্তপায়ে প্রবেশ করল প্রিয়তাও। চোখে বিভ্রান্তি নিয়ে চারপাশে তাকাল। রুদ্র আর প্রিয়তা ঠিক একইসঙ্গে তাকাল একে অপরের দিকে। তীক্ষ্ম এক দৃষ্টি ফেলে চোখ সরিয়ে নিল রুদ্র। 
উচ্ছ্বাস কয়েকটা শ্বাস ফেলে প্রথমে নিজেকে সামলালো। পরে ধীরপায়ে এগিয়ে গেল নাজিফার দিকে। উচ্ছ্বাসকে আসতে দেখে নাজিফার কাছ থেকে উঠে সরে দাঁড়াল জ্যোতি। উচ্ছ্বাস আস্তে করে গিয়ে বসল নাজিফার পাশে। আলতো করে কাঁধটা আকড়ে ধরে মৃদু স্বরে বলল, 'নাজিফা?

নাজিফার শরীরটা যেন ঝাঁকি খেয়ে উঠল। কেঁপে কেঁপে ফুঁপিয়ে উঠল দুবার। শুকনো চোখদুটোতে মুহুর্তেই জলভর্তি হয়ে গেল। নাজিফা বাচ্চাদের মতো তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। কোনকিছুর পরোয়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর প্রশস্ত বুকটাতে। চারপাশ কাঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইল উচ্ছ্বাসের। ভেতরের আবেগকে আড়াল করে শক্ত থাকা দায় হল উচ্ছ্বাসের। চোখ ওপরে করে নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে। আজ পুরোপুরি এতিম হয়ে গেছে নাজিফা। এইটুকু বয়সে কী ভয়ংকর যন্ত্রণাগুলো পেল মেয়েটা। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল একদম। জীবন এতো নিষ্ঠুর হতে পারে? ভাগ্য এতোটাও নির্মম হয়? এই ছোট্ট পৃথিবীর এতোবেশি বিষ কোথায় লুকিয়ে রাখে?
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp