মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৫৭ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


সূর্য মাথার উপর চড়াই হয়ে এসেছে। ভার্সিটির ক্যান্টিনের ভেতর গুনগুন শব্দে কথা বলার আওয়াজ ভেসে আসছে। ঘরজুড়ে ছড়িয়ে আছে দুপুরের আলস্য। ক্যান্টিনটি বেশ বড়, ছিমছাম। সারি সারি গোলাকার রাউন্ড টেবিল সাজানো, চারপাশে সাজিয়ে রাখা টেবিল চেয়ারগুলোয় শিক্ষার্থীদের আনাগোনা চোখে পড়ছে।

ক্যান্টিনের একপাশে বিশাল জানালা। জানালা দিয়ে স্বচ্ছ কাঁচের ওপারে দেখা যায় ক্যাম্পাসের উন্মুক্ত সবুজ চত্বর। কিছু গাছের পাতায় ঝলমলে রোদ পড়েছে, বাতাসে দুলছে তারা ধীর গতিতে। ক্যান্টিনের কোণার দিকে একদল ছাত্র গল্পে মশগুল, অন্যদিকে কেউ কেউ বই খুলে মনোযোগী হয়ে বসে আছে। কাউন্টারের দিকে ভিড় জমিয়েছে কয়েকজন।

অনন্যা ক্যান্টিনের এক কোণে বসে আছে, সামনের সবুজ রঙচটা টেবিলে রাখা খাতার পৃষ্ঠাগুলো উল্টে পাল্টে যাচ্ছে হাওয়ার ছোঁয়ায়। মাথাটা বেশ গরম হয়ে আছে ওর। নোহারা বিষয়টি খেয়াল করে অনন্যার কাঁধে হাত রেখে বললো,
"কি অনন্যা! কি নিয়ে এতো চিন্তিত হঠাৎ?"

অনন্যা মুখ তুলে বললো,
"আমার পুরো জীবন নিয়ে চিন্তিত। কোনো দিকে শান্তি নেই।"

"কি হয়েছে? খুলে বল।"
নোহারা একটু অবাকই হলো।

অনন্যা জিজ্ঞেস করলো,
"তোর আর ভ্যাম্পায়ারের মধ্যে সব ঠিক আছে? কথাবার্তা হয়?"

নোহারা মাথা নাড়িয়ে বলল,
"হ্যাঁ! ঠিকই আছে। এমনিতে দুপুরে উঠেই আমাকে ফোন দেয়। মাঝেমধ্যে মেসেজে কথা হয়। আর রাতে এক ঘন্টার মত সামনাসামনি দেখা হয়। এভাবেই চলছে।"

"ভ্যাম্পায়ারদের নিশ্চয়ই নিয়মিত রক্ত পান করতে হয় তাই না? তোর এদিকে কোনো সমস্যা হয় না?"

নোহারা অনন্যার দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,
"আসলে এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমার খুব খারাপ লাগে যখন ভাবি, সন্ধ্যা ব্রো শুধু আমার না, আরও অনেক মেয়ের সাথে মেশে, তাদের কাছাকাছি যায়। এটা ভাবলেই রাগে মাথা গরম হয়ে যায়। কিন্তু ওরও তো কিছু করার নেই, নিজেকে ঠিক রাখতে এসব করতেই হয়। তাই মুখ ফুটে কিছু বলি না, সব মেনে নিই। রাগ উঠলে মাঝেমধ্যে একটু মারি, এই আর কি! আর ছেলেটাও ভালো, সব সহ্য করে নেয়।"

শেষের কথাগুলো বলার সময় নোহারার চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠল। অনন্যা হেসে বললো,
"তাহলে তো ভালোই চলছে সবটা।"

"হ্যাঁ, এবার তোর কী সমস্যা সেটা বল!"

অনন্যা মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,
"আসলে স্যার আমার মাথাটা খারাপ করে ফেলছে। ওনার জন্য আমি মাকে না করে দিলাম, বলে দিলাম যাবো না। অবশ্য মা বাবা কেউই আপত্তি করেনি। সবটা মেনে নিয়েছে। কিন্তু সেসব কোনো ব্যাপার না। আমি মাকে বড় মুখ করে বলেছি, উনি আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। আমি উনার সাথে থাকতে চাই। অথচ বাসায় ফিরে জানতে পারলাম, উনার আগেও কয়েকবার বিয়ে হয়েছে! আর শুধু তাই নয়, উনার এক বান্ধবীও আছে, যাকে প্রায় সবসময় উনার আশেপাশে দেখা যায়। এসব দেখে দেখে আমি অতিষ্ঠ হয়ে গেছি।"

নোহারা চমকে উঠে বললো,
"স্যারের আগেও বিয়ে হয়েছে? কি বলছিস এসব!"

"হু! আমিও তো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ভাবতেই কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে।"

"ইশশ! তুই দেখি আমার থেকেও কষ্টে আছিস।"

অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নোহারা বললো,
"কিন্তু কৌশিক স্যারের চোখে আমি তোর জন্য অন্যরকম একটা চাওয়া দেখেছি। আমার মনে হচ্ছে তোর উনাকে খুঁটিয়ে দেখা উচিত।"

অনন্যা মন খারাপ করে বললো,
"আমার আর চলছে না। মন চাইছে সব ছেড়ে দেই।"

"শোন! কয়েকদিন লোকটার উপর রাগ দেখা। বা কথায় পাত্তা দিস না। তাহলে বেশি বেশি তোর কাছে আসবে।"

"কাছে আসলেই বা কী? উনার যে এতগুলো বউ আছে!"

নোহারা শান্ত গলায় বললো,
"সবারই একটা না একটা পাস্ট থাকে। তোরও তো আগে আরণ্যক ছিল। আরণ্যক ভাইয়াকে তো স্যার মেনে নিয়েছে, তাই না? তাহলে উনার পাস্টকে মেনে নিতে তোর এত সমস্যা হচ্ছে কেন?"

অনন্যা মুখ ফুলিয়ে বললো,
"আমার একজন ছিল, আর উনার অনেক জন! দুই জায়গায় বিশাল তফাৎ আছে। আর আমার আর আরণ্যক ভাইয়ার সম্পর্কটা ছিল অন্যরকম, বন্ধুত্বটাই বেশি ছিল। কিন্তু উনি? উনি তো বিয়ে করেছেন! বিয়ের পর কত কিছু হয়, চিন্তা কর!"

নোহারাও বুঝলো, অনন্যার রাগ আর মন খারাপের কারণ অমূলক নয়। সবকিছুরই একটা সীমা থাকে, আর অনন্যার এই অনুভূতিগুলো একেবারে যথার্থ জায়গায় আছে।

নোহারা অনন্যাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কিছু বলতে চাইলো। তার আগেই অনন্যা বললো,
"থাক! বাদ দে। তুই আমার ব্যথা বুঝবি না।"

অনন্যা খাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। ক্যান্টিনের বাইরে পা ফেলতেই নোহারাও তার পিছু নিলো। হঠাৎ করেই সামনে পড়ে গেলো আরণ্যক ভাইয়া, সঙ্গে তার কয়েকজন বন্ধু। তারা অনন্যার দিকে কেমন যেন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল। অনন্যা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। পাশ কাটিয়ে দ্রুত চলে যেতে চাইল। এই মানুষগুলোই তো কয়েকদিন আগে তাকে রুম বন্দি করে রেখেছিল! অনন্যা তাদের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায়নি, তাই দ্রুত কেটে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু বাঁধ সাধলো আরণ্যক। সে এক পা এগিয়ে এসে অনন্যার পথ আটকালো। অনন্যার পা থেমে গেলো, সঙ্গে নোহারারও।

অনন্যা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। যে ছেলেটা আগে ওকে দেখলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিত, না দেখার ভান করতো, সেই ছেলেটাই আজ সবার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে! আগের ভাবনাটা আর নেই আরণ্যকের মধ্যে।
কিন্তু এখন পরিবর্তন হয়ে কোনো লাভ হলো না।

আরণ্যক সরাসরি বললো,
"আমার বন্ধুরা আর কখনো তোকে নিয়ে খারাপ কিছু করবে না। ওরা স্যরি বলতে এসেছে।"

আরণ্যকের কথায় আশপাশে থাকা সবাই চমকে উঠলো। অনন্যা ধীরে ধীরে ঘুরে তাকালো। আরণ্যকের বন্ধুরা তখনও তার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে তীক্ষ্ণ তেজ দেখতে পাচ্ছে অনন্যা।

স্পর্শ বিরক্তির সহকারে বললো,
"আমরা কেন স্যরি বলবো? আমরা কি কোনো ভুল করেছি? ভুল তো ও করেছে, তোকে ঘুরিয়েছে।"

আরণ্যক শক্ত গলায় অনন্যার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
"সবাই স্যরি বলবে। কোনো একজনও বাদ যাবে না!"

অনন্যা নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
"আমার স্যরির প্রয়োজন নেই।"

নোহারা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলো,
"কেন? তুই স্যরি নিবি না কেন? এই সাঙ্গপাঙ্গগুলো তোকে যা করেছে, ভুলে গেছিস? আমরা চাইলে পুলিশ কেস করতে পারতাম, করিনি তো! যাই হোক, আপনারা স্যরি বলুন আমার বান্ধবীকে।"

কারো মুখ থেকে আওয়াজ আসলো না। চারপাশে চাপা অস্বস্তি ভেসে বেড়াচ্ছে। সকলেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরণ্যককে দেখে যাচ্ছে। আরণ্যক আবারও কঠোর স্বরে বললো,
"সবাই স্যরি বলবে!"

বাধ্য হয়েই সবাই একসঙ্গে সংক্ষিপ্তভাবে স্যরি বললো। তারপর একসাথে ক্যান্টিনে প্রবেশ করলো।

অনন্যা আর নোহারাও চলে যেতে নিচ্ছিল, কিন্তু আরণ্যকের কণ্ঠে আবারো অনন্যার ডাক ভেসে এলো।

পা থামিয়ে অনন্যা ঘুরে তাকালো। চোখ প্রথমেই গিয়ে আটকালো আরণ্যকের মুখে! সুদর্শন চেহারায় এলোমেলো দাঁড়িগুলো বড় হয়ে গেছে, চুলগুলোও অগোছালো। অনন্যার হঠাৎ মনে হলো, এসব তার জন্যই বড় হয়ে আছে, সময়ের সাথে সাথে জমে থাকা অভিমান আর ক্লান্তির মতো। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে বলে ফেলতে, 
"ভালো লাগছে না! দাঁড়িগুলো কেটে ফেলো। চুলগুলো ঠিক করো।"

কিন্তু বলে না অনন্যা।সে জানে, কিছু বললেই ছেলেটা ধরে নেবে, অনন্যা এখনো তার কথা ভাবে। তার খুঁটিনাটি খেয়াল রাখে। এসব ভুল বোঝাবুঝির ঝামেলায় পড়তে চায় না সে। তাই চুপ করে থাকে, চোখ নামিয়ে নেয়, যেন কিছুই মনে হয়নি, কিছুই বদলায়নি। সব ঠিক আগের মতো। বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

আরণ্যক নিজের ব্যাগ সামনে নিয়ে চেইন খুললো। একটা নোট খাতা বের করে অনন্যার হাতে দিয়ে বললো,
"আমার আগের সেমিস্টারের খাতা। কাজে লাগবে হয়তোবা।"

নোহারা অনন্যার হাত থেকে নোটখাতা ছিনিয়ে নিয়ে হেসে বললো,
"ওয়াও! কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং! থ্যাংকস ভাইয়া। এতো এতো পড়া মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল। এটা দরকার ছিল।"

আরণ্যক একটু হেসে অনন্যার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

"থ্যাংকস বলার দরকার নেই। শুধু সম্পর্কটা প্রথম দিনের মতো করলেই আমি খুশি হয়ে যাবো।"

অনন্যা কিছু সময় চুপ করে থাকলো, তারপর মাথা নেড়ে বললো,
"জ্বি ভাইয়া! আমরা আগের মতই বন্ধু।"

আরণ্যক ঝটপট বললো,
"তাহলে কিছু না বুঝলেই আমাকে আস্ক করবি। মনে থাকবে?"

অনন্যা আবারও মাথা নাড়লো। আরণ্যক হঠাৎ থামলো। তারপর আচমকা আবার ডাকলো,
"অনন্যা!"

অনন্যা বিস্ময়ে তাকালো তার দিকে। আরণ্যক কিছু বললো না, শুধু মুচকি হাসলো। সেই হাসির মাঝে কী ছিল। স্মৃতি, ব্যথা, নাকি কিছু অজানা অনুভূতি? অনন্যা ঠিক বুঝতে পারলো না। সে শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

********

আজ নাকি সুন্দরতম রাত! আকাশে ভরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নক্ষত্র, তারার ঝিলমিল আলো ছড়িয়ে পড়েছে নিঃশব্দ শহরের প্রতিটি কোণায়। এই রাত ভেনোরার জন্য এক মহাসুযোগ! অনন্যাকে পরীক্ষা করার সুযোগ। মেয়েটার মধ্যে ভেনোরা এমন কিছু অনুভব করেছে, যা সাধারণ নয়, বরং অতি রহস্যময়। কৌশিকও প্রথম দিন তা কিছুটা টের পেয়েছিল, সন্দেহজনক মনে হয়েছিল। এজন্যই তো বিশেষভাবে অনন্যাকে এই বাড়িতে জায়গা দিয়েছিল সে। প্রথম দিন থেকেই ভেনোরার অপেক্ষা করছিল সে। নাহলে অনন্যা এতো দিন ধরে বেঁচে থাকত না। কৌশিক প্রথম দিন ই অনন্যাকে তার জীবনের শেষ দিনের মুখোমুখি হতে বাধ্য করতো। ওর শক্তি শোষণ করে মেরে ফেলতো। 

নিক প্রথম যেদিন অনন্যাকে দেখেছিল, বলেছিলো,
"মেয়েটা তো বেশ ইন্টারেস্টিং! ক্যান আই টেস্ট হার?"

কৌশিক তখন রেগে বলেছিল,
--- সি ইজ মাই গার্ল! এন্ড আই গট হার! তাই ওর ব্যাপারে যা করার, আমি করবো। অন্য কেউ এতে নাক গলানোর চেষ্টা না করলে খুশি হবো ।

এর অর্থ কৌশিক অনন্যাকে প্রথম থেকেই শেষ করার পরিকল্পনা করেছিল। কৌশিক বুঝতে পারছিল না, এই মেয়েটা কী অন্যদের মতো সাধারণ নাকি অন্যকিছু। নদীর সেই রাতে, অনন্যার চারপাশে গঠিত হয়েছিল এক অদ্ভুত গোলাকার বলয়! স্বচ্ছ, দীপ্তিময়, এক অদৃশ্য শক্তি অনন্যাকে ঘিরে রেখেছিল সেদিন। এতেই বোঝা যাচ্ছিল কোনো শক্তি তাকে নদীতে ডুবে যাওয়া হতে রক্ষা করছিলো। তাকে সেদিন বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিল। কৌশিক যদি নাও আসতো অনন্যার কিছু হতো না সেদিন।

সেজন্য কৌশিক আর এগোতে পারেনি। সে অপেক্ষা করেছিল ভেনোরার জন্য। ভেবেছিল, ভেনোরা এলে সবকিছু পরিষ্কার হবে, তার মনে জমে থাকা প্রশ্নের উত্তর মিলবে। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, ভেনোরার অপেক্ষার চেয়ে বেশি, কৌশিক নিজেই অনন্যার মধ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। সে জানে না কেন, কীভাবে, কিন্তু মেয়েটা তাকে এক অদ্ভুত মোহে জড়িয়ে ফেলেছে। ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে তার লুকায়িত অন্তরে জায়গা খুঁজে নিয়েছিল। শরীরের শীতলতা হ্রাস করে উষ্ণতা অনুভব করিয়েছিল, ঘুমে হারিয়ে যেতে‌ সাহায্য করেছিল।

অনন্যাকে একদিন না দেখলে দম বন্ধ হয়ে আসে কৌশিকের। একদিন না ছুঁতে পারলে শরীরটা কেমন শূন্য শূন্য লাগে। এই মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত আসক্তি তাকে পাগল করে তুলেছে। অনন্যা কি তা জানা জরুরী ছিল।কিন্তু কৌশিক আচমকা এসব দিকে লক্ষ্য করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তার কাছে অনন্যা শুধুই অনন্যাই! সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ এক মেয়ে, যে তার নিত্যদিনের ভালো লাগার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনন্যার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে কৌশিকের ভালো লাগে। ওর প্রতিটি অভিব্যক্তি, ক্ষণিকের হাসি, এমনকি নিরবতা পর্যন্ত কৌশিককে টেনে নিয়ে যায় এক অন্যরকম নেশায়।

অনন্যা আসলে কী? ভেনোরার মতে অনন্যার দেহে অতি বিশুদ্ধ আত্মা বসবাস করছে। এখন অনন্যার সংজ্ঞা খুঁজতেই প্রথমে তাকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হতে হবে। কৌশিক অনেকক্ষণ আগে আইসক্রিম দিয়ে গিয়েছিল। এখন আবার এসে দেখে, অনন্যা পড়ার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। ঘরের নরম আলোয় ওর মুখটা কেমন শান্ত দেখাচ্ছে। সে ধীরে হাতে অনন্যার মাথায় স্পর্শ করলো। অনন্যা নড়েচড়ে উঠতেই কৌশিক দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। চুপ করে তাকিয়ে রইল, তারপর দৃষ্টি গেল টেবিলের একপাশে রাখা বাটির দিকে।

আইসক্রিম পুরোপুরি গলে গেছে। কৌশিক ভ্রু কুঁচকে বাটি হাতে নিলো, খেয়েছে নাকি এভাবেই রয়ে গেছে, বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু গলে যাওয়া আইসক্রিম দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না।

ঠিক তখনই অনন্যা উঠে বসল। চুলগুলো এলোমেলোভাবে ঠিক করলো। চোখ আধবোজা, মুখে ক্লান্তি ভরপুর। 
কৌশিকের দিকে ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"আপনি এখনো এখানে?"

সত্যিই তো, সে কেন এখনো দাঁড়িয়ে আছে? কী বলবে বুঝতে না পেরে অপ্রস্তুতভাবে চামচটা তুলে মুখে পুরে ফেললো। ঠান্ডা, গলে যাওয়া আইসক্রিমটা মুখে ছড়িয়ে পড়তেই দ্রুত হেসে বললো,
"আমি এটা খেতে এসেছিলাম।"

অনন্যা চোখ আধবোজা রেখেই হাত নাড়িয়ে বললো,
"ভালো করেছেন। আমি এমনিতেও খাইনি।"

কৌশিক হতাশ হলো। অনন্যা ফোন খুলে পড়ায় মনোযোগ দিলো। কিন্তু আইসক্রিম খাওয়ার কিছুক্ষণ পর কৌশিকের মাথায় প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিল। মনে হচ্ছিল তার মস্তিষ্কটা ফেটে যাচ্ছে, শরীরটা রসিয়ে রসিয়ে কাটছে কেউ। স্টিলের বাটিটা কৌশিকের হাত থেকে পড়ে ঝনঝন শব্দে গড়িয়ে গেল মেঝেতে। সে কপাল চেপে ধরে ছটফট করতে লাগলো, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো। মনে পড়লো আইসক্রিম এ ঘুমের ওষুধ ছিল যার কারণে তার শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

অনন্যার রক্ত হিম হয়ে গেল। স্যারের এমন অবস্থা দেখে সে পিলে চমকে উঠলো! কী করবে বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ তার চোখ গেল কৌশিকের ফ্যাকাশে, কষ্টে কুঁচকানো মুখের দিকে। স্যারের চোখের মণি হঠাৎই তীব্র নীল আলোতে ধপ করে জ্বলে উঠলো। শীতল আতঙ্কের শিহরণ বয়ে গেল অনন্যার শিরদাঁড়া বেয়ে। কৌশিক মাথা থেকে হাত সরিয়ে অনন্যার দিকে তাকালো। অনন্যা ঢোক গিললো। আশেপাশে তাকালো। কৌশিক সামনে এগোতে এগোতে আচমকাই হাত বাড়িয়ে অনন্যার কাঁধ চেপে ধরলো। অনন্যা মুখ তুলে কয়েক পল স্যারের দিকে তাকালো। কি হিংস্র মুখখানা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে অনন্যা হঠাৎ শক্তি সঞ্চয় করে স্যারকে খুব জোরে ধাক্কা দিলো।
কৌশিক ছিটকে দরজায় গিয়ে ধাক্কা খেলো। ধপ করে নিচে বসে পড়লো। কিছু মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকলো, তারপর ধীরে ধীরে মাথা তুললো।

সেই একই দৃষ্টি! সেই একই হিংস্রতা! অনন্যার হৃদস্পন্দন বেপরোয়া হয়ে উঠলো।

অনন্যার কপাল ঘেমে উঠেছে। প্রচন্ড চিন্তা করতে করতে কৌশিক স্যারের সেদিনের কথা মনে পড়লো। স্যার বলেছিলো,

যদি দ্বিতীয়বার এমন হয় দূরে চলে যেতেই পারো অথবা তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমাকে থামাতে পারো।

ঘরটা নিস্তব্ধ। কেবল কৌশিকের দ্রুত শ্বাসের শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে চারপাশে, মনে হচ্ছে ক্ষুধার্ত কোনো বাঘ আটকে পড়েছে খাঁচায়। অনন্যা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো। কৌশিকের সামনে বসলো চুপটি করে। স্যারের কাঁপতে থাকা শরীরের দিকে তাকিয়ে একটু থমকালো, তারপর সাহস করে তার গালে হাত রাখলো। তাপ ছড়িয়ে পড়লো আঙুলে। কৌশিক বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু অনন্যা স্যারের কপালে আলতো করে চুমু খেলো। কৌশিক আরও ছটফট করলো। নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইছে সে। কিন্তু অনন্যা স্যারের মাথা ধরে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়লো না। অনন্যার শরীরের উষ্ণতা মিশে গেলো কৌশিকের ভেতরে। ধীরে ধীরে কমতে লাগলো স্যারের ছটফটানি। নিশ্বাস ভারী হলেও আগের মতো বিক্ষিপ্ত নয়।

একসময় কৌশিক থেমে গেলো। চুপচাপ অনন্যার কাঁধে মাথা রাখলো, দরজার বাইরে তাকিয়ে রইলো স্থির দৃষ্টিতে। কৌশিকের চোখের মণি তখনো নীল, তবে আলোটা একটু ফিকে হয়েছে।

*********

ভেনোরা বাথরুমে গিয়েছিল। দীর্ঘক্ষণ ধরে নিজেকে ফ্রেশ করলো। মুখে, হাতে, শরীরে একের পর এক প্রসাধনী ব্যবহার করছিল। এতো কিছুতে সময় তো লাগবেই! প্রায় এক ঘণ্টা পর সে বের হলো। বের হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, রাত এখনও শেষ হয়নি। লারা আর তামং নিচে কথা বলছে, তাদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। কিন্তু ভেনোরা তাতে কান দিলো না। তার মনোযোগ এখন অন্য জায়গায়, কিয়ানের দিকে! সে কি তার কাজ করতে পেরেছে?

এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরছিল ভেনোরার। কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে এসে অনন্যার রুমের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো ভেনোরা। ভেতরে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো তার। কৌশিক আর অনন্যা একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে দুজনেই।

কিন্তু সবচেয়ে অবাক করার বিষয় কৌশিকও ঘুমিয়েছে!
ভেনোরার চোখ কুঁচকে এলো। কিয়ান কি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে? এটা তো অসম্ভব! ওর তো ঘুমানোর কথা না!

ভেনোরা আস্তে করে কৌশিকের কাঁধে কয়েকবার ধাক্কা দিলো। কিছুক্ষণ পর কৌশিক ঢুলুঢুলু চোখে ভেনোরার দিকে চাইল।

ভেনোরা কটমট করে তাকিয়ে বললো,
"ওঠো।"
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp