মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৬০ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


ছোট এক তলার দালান!দালানের ভেতরে প্রবেশ করতেই একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে এসে হুড়মুড় করছে। কেমন একটা স্যাঁতসেঁতে, ধুলো জমা, আবার মৃদু ধরণের মশলার গন্ধও মিশে আছে তার সঙ্গে। অনন্যা সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ওড়নাটা নাকে চেপে ধরলো।

চারপাশে চোখ বোলাতেই বোঝা গেলো, পুরো হলরুমটা কমলা রঙের আবরণে মোড়ানো। আলো-আঁধারির মিশেলে একটা অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বিলাসবহুল, অভিজাত কোনো বাড়ির মতোই দেখাচ্ছে, অথচ দালানটি একতলা হওয়ায় প্রথম দর্শনে তেমন কিছু মনে হয়নি অনন্যার। কিন্তু এবার ভালোভাবে তাকাতেই বুঝতে পারলো, এটা কোনো সাধারণ বাড়ি নয়। প্রতিটি কোণায় কোণায় ছড়িয়ে আছে পুরোনো দিনের চিহ্ন, বৃহৎ ইতিহাসের ভার বইছে এই ভবন।

দেয়ালের গায়ে ঝুলছে ধুলো ধরা ছবি, কিছু চামড়ার বাঁধাই করা বই সাজানো রয়েছে শোকেসে। অনন্যা হেঁটে হেঁটে দেখতে লাগলো সম্পূর্ণ ড্রয়িং রুমটা। শোকেসে সাজানো চামড়ার বাঁধাই করা বইগুলোর দিকে চোখ পড়তেই তার কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। এগুলো কি স্রেফ সংগ্রহ, নাকি অন্য কিছু ভাবালো অনন্যাকে! সে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটার পর একটা বই দেখতে লাগলো। বেশ কয়েকটি বইয়ের অনেকগুলো করে কপি রাখা হয়েছে। সাত-আটটা বই আছে, যার প্রতিটিরই এমন অগণিত সংস্করণ সাজানো। কৌতূহল চাপতে না পেরে অনন্যা একটা বই তুলে নিলো। বইটির বিষয়বস্তু ছিল সমুদ্রের নতুন জীববৈচিত্র্য নিয়ে। সে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখলো, ইংরেজি ভাষায় নানা তথ্য রয়েছে। এক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বইটা যথাস্থানে ফিরিয়ে রাখলো।

তারপর যখন বুকশেলফের সামনে দিয়ে হাঁটছিল, তখনই একটা নাম দেখে থমকে গেল অনন্যা! "Kian Hart"। অনন্যার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। কিয়ান হার্ট এটা তো কৌশিক স্যারের বিদেশি নাম! সে দ্রুত বইটা হাতে তুললো। বইয়ের নাম "The Tales of Prince" লেখক হিসেবে কিয়ান হার্টের নামই লেখা। বিস্ময়ে জমে যাওয়া অনন্যার হাত দুটো অল্প কাঁপলো। সে আরেকটা বই হাতে নিলো, সেখানেও লেখক হিসেবে একই নাম।

অনন্যা শেলফের প্রতিটি স্তর খুঁজে দেখলো, বইগুলো হাতড়িয়ে দেখলো। কিন্তু "The Tales of Prince" বইটির আরেকটি কপি কোথাও খুঁজে পেলো না! তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো। তাহলে এই বইটির আর কোনো কপি বের হয় নি? অনন্যা ধারণা করলো, সম্ভবত এই বইটি বিক্রি করা হয়নি। অনেকক্ষণ ধরে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে অনন্যা সামনে স্থাপন করে রাখা সোফায় বসে পড়লো।

এখানে রাখা প্রতিটি বইই কিয়ান হার্টের লেখা এবং প্রতিটিরই প্রচুর কপি রয়েছে। কিন্তু "The Tales of Prince" বইটির মাত্র একটি কপি! কেন? এটা কি ইচ্ছে করেই গোপন রাখা হয়েছে? নাকি এই বইয়ের ভেতর এমন কিছু আছে, যা অন্যদের থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে? অনন্যা বই খুললো। একদম সাদামাটা একটা বই। উপরের কভারটা পার্পেল রঙের। সোনালী অক্ষরে লেখা বইয়ের নাম। 

তিন পাতা উল্টিয়ে সর্বপ্রথম দেখা যাবে তিনটি লাইন,
"A story that was never told.
A truth that was never admitted.
A life that no one understood."

অনন্যা এই তিনটি লাইন বারবার পড়তে থাকলো। কতবার পড়েছে, তার হিসেব নেই। মনে হচ্ছিল, শব্দগুলোর ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনো অদৃশ্য ইঙ্গিত, কোনো গভীর সত্য যা বোঝা দরকার। অনন্যা পরের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ফেললো। ঠিক তখনই, শীতল বাতাস চিরে ভেসে এলো একটা বিকট চিৎকার! আচমকা চিৎকার শুনে অনন্যার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। আওয়াজটা কৌশিক স্যারের বলে মনে হলো!

অনন্যা দ্রুত চারপাশে চোখ ফেরালো। এই দালানে প্রবেশ করতে গিয়ে তাকে প্রচণ্ড সতর্ক থাকতে হয়েছে। সামনে-পেছনে পাহারারত সিকিউরিটি গার্ডদের চোখ এড়িয়ে আসার জন্য অনেক কৌশল নিতে হয়েছে। জঙ্গলের পথে হাঁটতে গিয়ে খুঁজতে হয়েছে এমন কিছু, যা তার ঢোকার পথকে সহজ করবে। ভাগ্যিস মাটিতে পড়ে থাকা গাছের মোটা গোড়াটা পেয়ে গিয়েছিল সে, সেটাই কাজে লাগিয়েছে।

গার্ডদের নজর এড়িয়ে নিঃশব্দে বেড়ার পাশের দেয়ালে সেটাকে হেলান দিয়ে রেখেছিল। হাতে ধরা শক্ত কাঠের টুকরোটা যখন দেয়ালের পাশে রাখছিল, তখন ধারালো গুঁড়োর অংশে হাত কেটে গিয়েছিল অনন্যার। রক্ত ঝরে পড়লেও থেমে থাকেনি সে। নিঃশব্দে কষ্ট করে লাফ দিয়ে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, যদিও তাতে সামান্য শব্দ হয়েছিল। তাই সাথে সাথেই অনন্যা ছায়ার মতো পিছলে গিয়ে এক কোণে লুকিয়ে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছিল, কেউ টের পায়নি। লুকিয়ে থেকে লাভ ই হয়েছে। পেছন ফিরে পেয়ে গিয়েছিল পেছনের ঢোকার আরেকটি পথ।

কিন্তু সেই চিৎকার?চিৎকারটা এখনো অনন্যার কানের মধ্যে বাজছে। রুমটা ঠিক কোথায়, বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু শব্দটা আসছে ভেতরের দিক থেকে, তা স্পষ্টই বুঝতে পারলো অনন্যা।সে ধীরে ধীরে পায়ে হেঁটে সামনের করিডোরে এগোলো। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে, হাতের তালু ঘামতে শুরু করেছে। প্রতিটি পা ফেলার সময় মনে হচ্ছে পেছন থেকে কেউ বুঝি ধরে ফেলবে।

দালানটা ভেতর থেকে অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। এখানে-ওখানে পুরোনো আসবাবপত্র রাখা, দেয়ালে ঝুলছে বিবর্ণ পর্দা। আলো কম থাকায় সবকিছুই রহস্যময় লাগছে। কৌশিক স্যার তো নিজেই একজন রহস্যময়! তার সাথে জড়িত সবকিছুই নিশ্চয়ই রহস্যময় হবে। অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারো হাঁটা ধরলো।
হাঁটতে হাঁটতে একটা দরজার সামনে দাঁড়ালো, যেখান থেকে কিছুক্ষণ আগেই চিৎকারের শব্দ এসেছিল। দরজার নিচ দিয়ে ফাঁকা অংশ দিয়ে মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে। অনন্যার গলা শুকিয়ে গেল। ভেতরে সত্যিই কী কৌশিক স্যার আছেন? ভাবলো অনন্যা।

অনন্যা নিঃশব্দে দরজার হাতলে হাত রাখলো। আঙুলের মাথায় ঠাণ্ডা ধাতব স্পর্শ অনুভূত হলো। গভীর শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে চেপে ধরলো হাতলটা, সামান্য ঠেলে দিলো দরজাটা। একটা চাপা কড়কড়ে শব্দ হলো, দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরের দৃশ্য চোখে পড়লো। রুমটা একদম অন্ধকার। শুধু মাঝখান থেকে ঝুলে থাকা লম্বা একটা বাল্ব মৃদু আলো ছড়াচ্ছে, আর সেটা আস্তে আস্তে দুলছে। আলো-আঁধারির মাঝে একটা বাঁকানো বেড দেখা গেলো। তার ওপর শুয়ে আছে একজন।

ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার কাঁপতে থাকা শরীর স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর বিকট চিৎকার বেরিয়ে আসছে তার মুখ থেকে। গা থেকে ধোঁয়ার মতো কিছু উঠছে! কালচে, ভারী ধোঁয়া। অনন্যার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো। লোকটার শরীরের অর্ধেক অংশ সাদা তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো। পিঠজুড়ে লেপে দেওয়া হয়েছে সবুজ ভেষজ পদার্থ, কিছুটা শুকিয়ে খসখসে হয়ে গেছে, কিছু অংশ এখনো ভিজে। মনে হচ্ছে কোনো যন্ত্রণা থেকে তাকে মুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে তাকে। ঠিক তখনই সামনে দেখা গেলো ভেনোরাকে। অনন্যা চোখ বড় করে তাকালো। ভেনোরা এখানে! এর অর্থ কী এই লোকটা কৌশিক স্যার? অনন্যা ভাবতে পারলো না। ভেনোরা ধীর পায়ে এগিয়ে এল, হাতে ধরা একটা বাটি। গাঢ় সবুজ কিছু একটা তাতে রয়েছে। সে নির্ভুল হাতে লোকটার পিঠের ক্ষতস্থানে তা লেপে দিতে লাগলো।
লোকটা ধীর কণ্ঠে বললো,
"আমি অসাড় হয়ে যাচ্ছি। আর সহ্য করা যাচ্ছে না, ভেনোরাআ!"

অনন্যার শরীর হিম হয়ে গেলো। কণ্ঠ শুনেই নিশ্চিত হয়ে গেলো ইনি কৌশিক স্যার! অনন্যার আঙুলগুলো দরজার হাতলে শক্ত হয়ে চেপে রইলো। সে নিঃশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে।

ভেনোরা মৃদু হেসে বললো,
"কাম অন, কিয়ান। ইউ আর আ মনস্টার। এতটুকু ব্যথা তো সহ্য করাই যায় বলো? আর আজকের দিনটাই। আজকে রাতেই তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। এক সপ্তাহ যাবত সহ‌্য করেছ তার জন্য ও ধন্যবাদ।"

অনন্যা দরজার হাতল ছেড়ে দিলো। শরীরটা যেন নিজের নিয়ন্ত্রণেই নেই। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।
কৌশিক স্যার একজন মনস্টার? পায়ের নিচে অবস্থানরত মেঝে নরম হয়ে আসছে, দম আটকে আসছে তার। সে হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হেঁটে যেতে লাগলো। একদম শূন্য চোখে, বেখেয়ালে। এই সময়ে
দেয়ালের ছায়াগুলোও কেমন যেন দীর্ঘ হয়ে উঠছে, ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। অনন্যা হাঁটতে হাঁটতে পাশের একটা ঘরে ঢুকে গেলো। পা থামলো না তার, কেবল কপালে হাত রাখলো সে। ভেতরটা কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছে। স্যারের আসল‌ রূপের কথা জানতে পেরে তার কী করা উচিত আসলে? এই মুহূর্তে সে কিছু বুঝতে পারছে না, কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না।

কতক্ষণ ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো খেয়াল নেই অনন্যার। চোখে বারবার ভাসছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। বুকের ভেতর ধকধক শব্দ হচ্ছে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।আচমকা অন্ধকার রুমের বাল্ব শব্দ করে জ্বলে উঠলো, জ্বলে উঠলো বললে ভুল হবে কেউ জ্বালিয়ে দিয়েছে। বাল্ব জ্বলতেই দেখা গেলো সম্পূর্ণ নগ্ন রুম। ঘরটা একেবারে ফাঁকা, কোথাও কোনো আসবাব নেই। ধূসর দেয়াল আর ধুলো জমে থাকা মেঝে। আর সেই শূন্যতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ভেনোরা। অনন্যার মুখ হালকা ফাঁকা হয়ে গেলো। ভেনোরা হাসতে লাগলো, খুব জোরে হাসছে সে। তার হাসির প্রতিধ্বনি চারপাশের দেয়ালে গুঁড়িয়ে পড়ছে, মনে হচ্ছে পুরো ঘরটাই তার কণ্ঠে কেঁপে উঠছে।অনন্যা একদম স্থির হয়ে গেলো।

ভেনোরা ধীর পায়ে এগিয়ে এলো, একেবারে সামনে এসে বললো,
"ওয়েলকাম, অনন্যা। ওয়েলকাম। তোমার অপেক্ষায়ই ছিলাম।"

"কী বলতে চাচ্ছো?"
অনন্যা চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো।

ভেনোরা একটু ঝুঁকে এলো। তার কণ্ঠে রহস্যময় ঠান্ডা সুর,
"কিয়ান কে জানতে এসেছ, তাই না?"

অনন্যা কিছু বলার আগেই সে ফিসফিস করে বললো,
"ও একটা মনস্টার। ওর থেকে যত দূরে থাকবে, ততই ভালো থাকবে।"

অনন্যার ভ্রু কুঁচকে গেলো।
"তুমি কী বলছ? আমি কেন ওনার থেকে দূরে থাকবো?"

ভেনোরা এবার আরও কাছে এসে অনন্যার কাঁধে হাত রাখলো।
"কিয়ানের কাছে থাকা মানে নিজের মৃত্যুর দিন গোনা শুরু করা। এখন ওর চিকিৎসা চলছে। ঠিক হয়ে গেলে আগের মতো চলাফেরা করতে পারবে... কিন্তু সমস্যা হলো, ও যার তার শক্তি শুষে নিতে পারে। একবার যদি মাথায় জেদ চাপে, সামনে কে আছে তা দেখবে না!"

তার ঠান্ডা কণ্ঠ কানের কাছে ফিসফিস করে উঠলো,
"তাই সাবধান, অনন্যা। যত পারো, দূরে সরে যাও।"

অনন্যা বিরক্ত হয়ে বলল,
"আমি ওনার সাথে কথা বলতে চাই। আমি আপনার কোনো কথা শুনব না।"

ভেনোরা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলো, তারপর হেসে উঠলো,
"তুমি বড্ড জেদি, অনন্যা। কিন্তু কিয়ান এখন যে অবস্থায় আছে, তাতে কারও সাথে কথা বলার পরিস্থিতিতে নেই। তাই চুপচাপ নিজের রাস্তায় হাঁটা দাও।"

ভেনোরা অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আবারো বললো,
"আমি চাইলেই তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি। কিন্তু কিয়ানের স্ত্রী বলে কিছু বলছি না।"

অনন্যার শরীর মুহূর্তেই জমে গেল। স্ত্রী? হ্যাঁ, সে তো কৌশিক স্যারের স্ত্রী। এই সত্যটাই তো তাকে এখানে এনেছে। তাহলে কি এত সহজে ফিরে যাবে? স্যারকে এভাবে একা ফেলে রেখে চলে যাবে? অসম্ভব! মনস্টার হোক বা অন্য কিছু, কৌশিক স্যারকে বোঝানোর দায়িত্ব তারই। ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা উচিত। আর সে দায়িত্ব থেকে সে পিছু হটবে না।

অনন্যার চোখ কঠোর হয়ে উঠলো, দাঁত চেপে দৃঢ় স্বরে বলল,
"আমি স্যারের সাথে কথা বলব। আপনার কথায় আমার কোনো বিশ্বাস নেই।"

ভেনোরা ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকালো।
"আর ইউ শিওর, অনন্যা?"

অনন্যা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
"অফকোর্স।"

ভেনোরা মুচকি হাসলো। পিছন ফিরে হাঁটতে থাকলো। দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
"অবশ্যই কথা বলবে। তার আগে এই রুম থেকে বেরিয়ে দেখাও।"

অনন্যার ভ্রু কুঁচকে উঠল। ঠিক তখনই দরজাটা বিকট শব্দে বন্ধ হয়ে গেল। সে তৎক্ষণাৎ দরজার দিকে দৌড় দিলো, উন্মত্তের মতো ধাক্কা দিতে লাগল, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। দরজা নড়ছে না, একটুও না! শ্বাস ভারী হয়ে এল তার। কিন্তু অবাক কান্ড! পেছনে ঘুরতেই গা শিউরে উঠল অনন্যার। এই তো একটু আগে যেখানে অন্ধকার দেয়াল ঘেরা ঘর ছিল, এখন সেখানে সবুজ গাছপালা দুলছে হাওয়ায়! মনে হচ্ছে চোখের পলকে তার চারপাশটা পরিবর্তন হয়ে গেলো।

দূরে নদীর কলকল ধ্বনি কানে ভাসছে। উপরে তাকাতেই বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেল। খোলা আকাশ!
এটা কীভাবে সম্ভব? কীভাবে এত দ্রুত চারপাশ বদলে গেল? অনন্যা স্তম্ভিত হয়ে কয়েক কদম এগোল। মনে হচ্ছিল স্বপ্নের ভেতরে ঢুকে পড়েছে! ঠিক তখনই একটা ছায়া আকাশের ওপর নেমে এল। সে মাথা তুলে চেয়ে রইল।একটা বিশাল উড়ন্ত প্রাণী চক্কর কাটছে তার মাথার ওপর! পাখি? না, এটা কোনো সাধারণ পাখি নয়!
এত বড় ডানা। এত ভয়ানক লাল চোখ! চোখ দুটো আগুনে জ্বলছে! অনন্যার মনে হলো, এই লাল চোখ জোড়া তার সমস্ত অস্তিত্ব গিলে ফেলবে। হঠাৎ প্রাণীটা নিচে নেমে এলো, অনন্যার দিকে সোজা আক্রমণ করতে তেড়ে আসলো। চিন্তা করতে না করতেই আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়লো! তার ভয়ঙ্কর ঝাপটায় অনন্যা দূরে ছিটকে গেলো, সজোরে গিয়ে ধাক্কা খেলো একটা গাছে।পিঠের মধ্যে ঝনঝন করে উঠল ব্যথা। শরীরের সব শক্তি মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে গেল, কিন্তু শ্বাস ফেলার সময় পেলো না অনন্যা। পাখিটা আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে!
এবার আর সময় নেই। নিচে পড়ে থাকা একটা মোটা গাছের ডাল দ্রুত তুলে নিলো অনন্যা। নিজের সামনের দিকে তুলে ধরল প্রতিরক্ষার জন্য। চোখ বন্ধ করে হাত নাড়ালো শক্ত হাতে! এত বিশাল, এত ধূর্ত প্রাণীটার সামনে এই সামান্য একটা ডাল কি পারবে তাকে বাঁচাতে?

হয়তো না, হয়তো এই শেষ মুহূর্ত! কিন্তু ঠিক তখনই পাখিটার বিকট চিৎকারে অনন্যার চোখ খুলে গেলো!প্রাণীটা কয়েক হাত দূরে মাটিতে পড়ে কাঁপছে! আর সেকেন্ডের মধ্যেই কিছুই নেই! পাখিটা অদৃশ্য হয়ে গেছে!
অনন্যা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো কিন্তু অদ্ভুত পাখির কান্ড কারখানা যেতে না যেতেই শুরু হলো আরেক কাহিনী।

**********

রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। কৌশিক উঠে বসলো। শরীরের নিচের অংশে তোয়ালে পেঁচানো, চোখের সামনে দুটো তরুণ ছটফট করছে। তারা মুক্তি পেতে চাইছে, চেঁচাতে চাইছে। কিন্তু কিছুই পারছে না।
মুখ শক্ত করে বাঁধা। কৌশিক ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো।
ঠিক তখনই দরজা ঠেলে ঢুকলো ভেনোরা।

ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে এগিয়ে আসলো সে। 
"তোমার আজকের খাবার।" মৃদু স্বরে বললো ভেনোরা

"একদম তাজা যুবক নিয়ে এসেছি!"

কৌশিক হাসলো। তার চোখদ্বয় জ্বলে উঠলো এক অদ্ভুত আলোতে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো, দুটো শরীর থরথর করে কাঁপছে তার সামনে। কৌশিক প্রথম জনের মুখের বাঁধন খুলে ফেললো। ছেলেটা ছাড়া পেয়েই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। কৌশিকতার নীল তপ্ত আগুনে জ্বলতে থাকা চোখ নিয়ে ব্যথাতুর কণ্ঠে বললো,
"আমাকে বাঁচতে হলে তোমাদের যে মরতেই হবে।"

কৌশিক তার কাঁধে হাত রেখে শক্তি শোষণ করতে লাগলো। ছেলেটা চিৎকার চেঁচামেচি করা থামলো না , এমনকি কৌশিকের পায়ে ধরে মাফ চাওয়ার চেষ্টা ও করলো কিন্তু লাভ হলো না ‌। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়লো তার শরীর। কৌশিক ঠেলে ফেলে দিলো ছেলেটাকে। তারপর পাশের ছেলেটার মুখের বাঁধন খুললো কৌশিক। এই ছেলেটার আর্তনাদ বাতাস কাঁপিয়ে তুলছিল রুমের।

কিন্তু কৌশিকের জন্য সেটি কেবলই একটি নিষ্ফল প্রতিরোধ। সে থামলো না। শরীর আগুনের মতো জ্বলছে,
চোখে এক বিভীষিকাময় নেশা যেখানে চাহিদা কেবল আরও শক্তি, আরও জীবন। ছেলেটা হাতজোড় করে কেঁদে উঠলো।

"ভাই! আমাকে ছেড়ে দিন।আমার বাসায় শুধু একটা বোন আছে, আর কেউ নেই।প্লিজ, এরকম করবেন না!"

কিন্তু কৌশিক শুনলো না। সে আরও এগিয়ে গেল,
তার হাত ছেলেটার কাঁধে রাখা মাত্রই এক শীতল অনুভূতি শরীর ঘিরে ধরলো। তারপর ধীরে ধীরে ছেলেটার শরীর নিস্তেজ হতে লাগলো। তার চোখ ফাঁকা হয়ে গেল,হাত শক্ত হয়ে আস্তে আস্তে ঝুলে পড়তে লাগলো। সেই মূহুর্তেই একজনের চিৎকার শোনা গেলো সে ছুটে আসলো রুমটিতে। ভেনোরাও ঘুরে তাকালো। মেয়েটি দৌড়ে এসে কৌশিককে সেই অবস্থাতেই জড়িয়ে ধরলো। কৌশিক থেমে গেলো। স্থির হয়ে গেল তার শক্তি শোষণের কার্যক্রম। ছেলেটি অর্ধেক শক্তি হারিয়ে শ্বাস নিচ্ছে বসে বসে। চোখের সামনে দেখতে পেলো এক নারীকে যার শব্দে, যার কথা বলাতে, যার জড়িয়ে ধরাতে, যার ধরে রাখাতে কৌশিকের মতো একজন মনস্টারের চাহিদা ধীরে ধীরে লোপ পেতে যাচ্ছে।
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp