অন্তর্নিহিত কালকূট - পর্ব ১১০ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


রুদ্র চোখে অবিশ্বাস নিয়ে একবার প্রিয়তাকে দেখল, আরেকবার নিজের হাতে ধরা এম-টি-নাইন পিস্তলটা। এই কয়েক সেকেন্ডে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কতটা বিভৎস ছিল তা উপলব্ধি করতে পেরে হৃদয় ছলকে উঠল যেন।
আরেকটু হলেই প্রিয়তার বুকে গুলি চালাতে যাচ্ছিল ও। যে বুকে মাথা গুঁজে রুদ্র শান্তির নিঃশ্বাস নিতো, সে বুকটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতো ওর ধারালো বুলেট! সেইফটি ক্যাচ অন হওয়ার ছোট্ট শব্দে হুঁশ ফিরল রুদ্রর। ক্ষীপ্র চোখে তাকাল প্রিয়তার দিকে। ততক্ষণে প্রিয়তা নামিয়ে ফেলেছে পি*স্ত*ল। চোখে তখনও বিস্ময়। রুদ্র প্রিয়তার দিকে কঠোর দৃষ্টি রেখেই সেইফটি ক্যাচ অন করে পিস্তল নামাল। না তাকিয়েই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রঞ্জুকে উদ্দেশ্য করে বলল, ' বাইরে যা। যা বলার পরে বলব।'

রুদ্রর চোখে যেন আগুন জ্বলছে। সেই রাগের আভাস পেয়ে ভেতর ভেতর কেঁপে উঠল রঞ্জু। প্রিয়তার প্রতি ও অসন্তুষ্ট। ক্ষোভ আছে। ঘৃণা করার চেষ্টাও করে নিরন্তর। কিন্তু সামান্য এই দুর্বলতাটুকু কোনভাবেই কমাতে পারেনা যেন। রঞ্জু থতমত খেয়ে বলল, ' ভাই, একটু ঠান্ডা হন। আমি কইতাছিলাম কী...'

রুদ্র ক্ষেপে গিয়ে বলল, ' তর কিছু কওন লাগব না। বাইর হ! নাইলে এহন তরও খুলি উড়ামু আমি।'

রুদ্রর ঘর কাঁপানো ধমক আর প্রমিত বাংলার নির্মম হত্যা দেখে আর কিছু বলার সাহস পেলোনা রঞ্জু। মাথা নিচু করে ভেজা বেড়ালের মতো বেরিয়ে এলো ফ্ল্যাটটা থেকে।

রঞ্জু বের হতের প্রিয়তার দিকে তেড়ে গেল রুদ্র। হাতের কবজি ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, ' আর এক সেকেন্ড পরে লাইট জ্বললে কী হতো জানো? সব জায়গায় এরকম ভুতের মতো আবির্ভূত হওয়ার মানেটা কী?'

প্রিয়তা তাকিয়ে দেখল রুদ্রর গলায় ওর দেবে যাওয়া নখের ক্ষত। বা চোখের এক ইঞ্চি দূরেও আঘাতের চিহ্ন। পিস্তলের বাটটা ওখানেই লেগেছিল বোধ হয়। মনোযোগ দিয়ে ক্ষতগুলো দেখতে দেখতে প্রিয়তা বলল, ' আড়ালে আবডালে লোকে আমাকে পিশাচিনী ডাকে। ভুতেরই একটা ডিপার্টমেন্ট।'

কথাটা বলে রুদ্রর চোখের দিকে তাকাল প্রিয়তা। চিৎকার করে ডাকল, ' রঞ্জু!'

হুরমুর করে দরজা খুলে আবার ভেতরে এলো রঞ্জু। ভীত চোখে তাকাল দুজনের দিকে। দুজনকে দেখামাত্র স্বস্তির একটা শ্বাস ফেলল। রুদ্র ভ্রুদয় কুঁচকে বলল, ' তুই যাসনি?'

মুখ কাচুমাচু করে মাথা নুইয়ে ফেলল রঞ্জু। অনেকটা ইতস্তত করে বলল, ' দুইজনেই যেমনে একজন আরেকজনের দিকে ব*ন্দুক ধইরা রাখছিলেন। যদি খুনাখুনি হইয়া যায়?'

রুদ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই প্রিয়তা বলল, ' একটা ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসো।' পকেটে হাত দিয়ে একটা চাবি বের করল প্রিয়তা। না তাকিয়েই অভ্রান্ত লক্ষ্যে চাবিটা রঞ্জুর দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, ' ফার্মেসি একটু দূরে। নিচে আমার বাইক আছে। কালো রঙের। ওটা নিয়ে যাও।'

' কোথাও যেতে হবেনা। সোজা বাড়ি যা।' প্রিয়তার দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে বলল রুদ্র।

ঘাড়ত্যাড়ার মতো করে প্রিয়তা বলল, ' যাও রঞ্জু।'

' আমি বারণ করেছি।'

' আমি যেতে বলেছি।'

বর-বউয়ের মধ্যে ঠিক কার নির্দেশ শুনবে তা ঠিক করতে বেশি ভাবতে হয়নি রঞ্জুকে। প্রিয়তার শরীরের ক্ষত নিয়ে রঞ্জুর কতটা চিন্তা আছে ও নিজেও জানেনা। কিন্তু রুদ্রর ক্ষত নিয়ে ও নিঃসন্দেহে চিন্তিত। তাই কোনকিছু না ভেবেই ছুটল ফার্স্ট এইড বক্স কিনতে।

রঞ্জু যাওয়ার পরপরই পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেল ঘরটা। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল দুজন। অতঃপর ধীরেসুস্থে নিজেদের জায়গামতো রেখে দিল নিজেদের অভেদ্য অংশ, অর্থাৎ পিস্তল। রুদ্র গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল, 'এখানে কী করছো?'

প্রিয়তা ততক্ষণে ধাতস্থ করে নিয়েছে নিজেকে। রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলল, ' আমারও একই প্রশ্ন।'

' ঘরটা আমার।'

' গোটা আপনিটাই আমার।'

ভ্রু কোঁচকালো রুদ্র। ছেড়ে দিল প্রিয়তার হাত। কিছু না বলেই অন্ধকার ঘরটার দিকে পা বাড়াল। প্রিয়তা জানে এখন সোজা বারান্দায় গিয়ে বসবে তার স্বামী। ঐ বারান্দা ওদের গভীর প্রেমের অন্যতম সাক্ষী। প্রিয়তা আপাতত গেলোনা সেদিকে। বড় সোফাটায় নিজের গা এলিয়ে চোখ বুজে ফেলল। রঞ্জুর জন্যে অপেক্ষা করছে ও।

রুদ্রর সারাটাদিন ভালো যায়নি। দলের কাজে এধরণের চ্যালেঞ্জ, পরিকল্পনার মোকাবেলা ও আগেও বহুবার করেছে। এবং খুবই চতুরতার সাথে সফলও হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা সাজিয়ে খেলা পাল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে ওর সুনাম ব্যাপক। কিন্তু এবার! এবার ওর প্রতিটা পরিকল্পনা, প্রতিটা প্রত্যাহ্বান সেই মানুষটার বিরুদ্ধে যাকে ও ভালোবেসেছে। যার চোখের মায়ার চিরকাল নিজের সব যন্ত্রণা ভুলে এসেছে, তার চোখেই ধুলো দেওয়ার যন্ত্রণা যে কতটা নির্মম; তা অন্যকেউ অনুমানও করতে পারবে না। সেই নির্মম যন্ত্রণা কী প্রিয়তা কখনও উপলব্ধি করেছে। কথাটা ভেবেও হাসি পেল রুদ্রর। কীকরে উপলব্ধি করবে? মেয়েটাতো কোনদিনও ওকে ভালোই বাসেনি। ভালোবাসলে কাউকে এতো নিষ্ঠুরভাবে ঠকানো যায়না।
শরীরের ক্ষতগুলোর যন্ত্রণা ছাপিয়ে গেল রুদ্রর বুকব্যথা। এই বারান্দা, এই ফ্লোর। কতরাত প্রিয়তাকে বুকে নিয়ে পাড় করে দিয়েছিল এখানে। আলতো সোহাগে ভরিয়ে দিয়েছিল মেয়েটাকে। কত সুন্দর স্বপ্ন সাজিয়েছিল নিজেদের নিয়ে। স্বপ্ন! রুদ্রর আবারও মনে পড়ল সেই রাত। যে রাতে প্রিয়তা এসেছিল রুদ্রর জীবনে। ঠিক স্বপ্নের মতো। প্রথমবারের মতো কিছু আকৃষ্ট করেছিল রুদ্রকে। ঐ গভীর হরিণী সুন্দর চোখ। সেই জঙ্গলে কাটানো একেকটা মুহূর্ত। যা কোনদিন কেউ পারেনি, ভীত অসহায় সেই চোখজোড়া তা পেরেছিল। দুর্বল করে দিয়েছিল রুদ্র আমেরকে। মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছিল। এরপর এই বনানীর ফ্ল্যাট। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে একে অপরের কাছে আসা। সেই প্রথম স্পর্শ! এরপরইতো হল সেই অসাধ্য সাধন। রাশেদ আমেরের তৈরী অভেদ্য সেই বলয়কে ভেদ করে প্রবেশ করল এক মারণ অনুভূতি। মারণই বটে। মেরেইতো ফেলেছে রুদ্রকে। ওদের সেই জাকজমকপূর্ণ বিয়ে। টানা দুবছরের আদর, ভালোবাসা, শিহরণ, স্বপ্ন দিয়ে পরিপূর্ণ সংসার। কী অসম্ভব সুখ। সারাদিন পর মেয়েটাকে বুকে জড়ালেই কী প্রবল শীতলতা ছেঁয়ে যেতো রুদ্রর শরীরজুড়ে। রাজা-রাণীর সংসারে এক রাজপুত্রের স্বপ্ন ছিল। এরপর! এরপর সব স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত করল একের পর এক নির্মম ঘটনা। সেই আকাশসম দুঃখের মাঝে রাজপুত্র নামক স্বপ্ন ধরা দিচ্ছিল ঠিকই। কিন্তু নির্মমভাবে তাও পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। এরপর সেই দুঃস্বপ্ন যেন আর কাটলোইনা।
কতটা ভয়ংকর ছিল সেই মুহূর্তগুলো যখন প্রিয়তার সত্যিটা একটু একটু করে সামনে আসছিল রুদ্রর। রুদ্রর বুকে তখন সেকী অসম্ভব চাপ। সেই চাপ প্রগাঢ় হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। যখন প্রিয়তার সম্পূর্ণ সত্যিটা ওর জানা হল, বৈঠকঘরে বসে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছিল ও। কেউ শুনলে বলবে এক ফোঁটা অশ্রু! কী আর আহামরি কষ্ট পেয়েছে তবে? কিন্তু কেউ জানবেনা, বুঝবেও না। রুদ্রর চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জ্বল বের হলেও, হৃদয় থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় র*ক্ত ঝড়ছে সেই রাত থেকেই। সময়ের সঙ্গে সেই র*ক্তপাত কমেনি বরং বাড়ছে সমানতালে। সে কী অসহ্য যন্ত্রণা। রুদ্র কাঁদতে পারেনা, চিৎকার করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেনা। অথচ পৃথিবীর ভয়ংকরতম যন্ত্রণা বুকে পুষে দিব্যি শ্বাস নিয়ে বেরাচ্ছে সে। আয়রন হার্ট রুদ্র আমেরের লৌহ সমান সেই হৃদয়কে এভাবে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়ার মতো অনুভূতিকেতো মারণই বলা চলে। আর যেদিন প্রিয়তার রাণী মীর্জা রূপ রুদ্র স্বয়ং দেখল। দুঃস্বপ্ন যেন সেদিন তার সবচেয়ে ভয়ংকর রূপটাই নিল। প্রিয়তা সেই র*ক্তস্নান করা বিভৎস রূপ! চোখ বুজে ফেলল রুদ্র। আর কিছু ভাবতে পারল না। এই অসহ্য ছটফটানী, নিদারুণ কষ্টকে একটু নিজের মতো বুঝে নিতেই এসেছিল এই ফ্ল্যাটটাতে। মারণ অনুভূতিগুলো তার বিষাক্ত কামড়গুলোতো বসিয়েছিল এখানেই। অথচ এখানেও সেই অনুভূতি! সেই নারী! সেই যন্ত্রণা! নিজের প্রাণের চেয়েও প্রিয় মানুষটাকে আজ আবার আঘাত করেছে সে। পরিস্থিতি, ন্যায় বলছে ওর কষ্ট পাওয়া উচিত নয়। বরং আনন্দের সঙ্গে আঘাতে আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেওয়া উচিত ঐ ছলনাময়ীকে। বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি ওর যেই তীব্র ঘৃণা, সেই ঘৃণার সম্পূর্ণটা ঢেলে দিতে চায় এই বিশ্বাসঘাতিনী নারীর ওপর। কিন্তু চেষ্টা করেও রুদ্র পারেনা। উল্টে নিজের ওপরেই তীব্র ঘৃণা জন্মায় ওর। নিজের পিতা এবং সন্তানের খুনিকে ঘৃণা করতে না পারার অপরাধে, নিজের বোনের সর্বনাশের কলকাঠি যার হাতে ছিল তাকে ঘৃণা করতে না পারার অপরাধে। ঐ মেয়েটাকে রুদ্র আজও ভালোবাসে! এক বিশ্বাসঘাতিনী, ছলনাময়ীকে রুদ্র ভালোবাসে। ইশ! কী জঘন্য সত্য! কী জঘন্য! রুদ্র মানতে পারলনা সেই সত্যকে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সজোরে ঘুষি বসালো পাশের দেয়ালটাতে। ভেতর থেকে কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসতে গিয়েও আসলোনা। রুদ্রর মনে হল পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ বোধহয় কেঁদে ফেলা। এরচেয়ে কঠিন আর কিছু নেই। কিছুই না।
ঠিক তখনই বারান্দায় এসে দাঁড়াল প্রিয়তা। বাইরের থেকে আসা আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল ওকে। হাতে একটা বক্স। তারমানে রঞ্জু ফার্স্ট এইড বক্স দিয়ে গেছে ওকে। রুদ্র না তাকিয়েই থমথমে গলায় বলল, 'গেট আউট ফ্রম হিয়ার।'

প্রিয়তা যেন শুনতেই পায়নি। নিজের মতো বসে পড়ল ঠিক রুদ্রর পাশে। নিজের মতো বক্সটা খুলতে খুলতে বলল, 'ভেবেছিলামতো সারারাত এখানেই থাকব। কিন্তু আপনি এসে হাজির হলেন। সবসময় আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দেন আপনি।'

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকাল প্রিয়তার দিকে, ' সব পরিকল্পনা? আমার জানামতে তোমার শুরুর দিকের কোন পরিকল্পনাই বিফলে যায়নি।'

প্রিয়তা রহস্যভরা চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে। কিছু না বলে মৃদু হাসল কেবল। তুলোয় ঔষধ লাগিয়ে রুদ্রর দিকে বাড়াতে নিলেই খপ করে হাতটা ধরে ফেলল রুদ্র। ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে বলল, ' এখন তোমার কোন নাটক দেখার ধৈর্য্য নেই আমার, যাও।'

প্রিয়তা শুনলো না। এগিয়ে এসে সবার আগে তুলো ছোঁয়ালো চোখের বাঁ পাশের ক্ষততে। আলতো করে ফুঁক দিল। মুখভঙ্গিতে মনে হল যেন ওর ক্ষততে ঔষধ পড়ছে। নরম গলায় বলল, ' এসে লাইটটা জ্বালালে কী হতো? আরেকটু দেরী হলে গু*লি চালিয়ে দিতাম আমি। কী অবস্থা করেছি দেখেছেন?'

রুদ্র তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। মনে পড়ল, অনেক মিশন, আচমকা আক্রমণ ইত্যাদিতে মাঝেমাঝেই আহত হয়ে ফিরতো রুদ্র। প্রিয়তা ঠিক এভাবেই যত্ন সহকারে ঔষধ লাগিয়ে দিতো। চেহারায় ঠিক একই যন্ত্রণা ফুটে উঠতো। একদিন খুবই গুরুত্বর আহত হয়ে ফিরল রুদ্র। মুখে ছোট দু একটা পুরোনো দাগের সঙ্গে যুক্ত হল আরেকটা দাগ। সেদিনও চেহারায় একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে রুদ্রর সব ক্ষততে ঔষধ লাগাচ্ছিল প্রিয়তা। ঘনঘন ফুঁক দিচ্ছিল। মুখের ঐ ক্ষতটাতে ঔষধ লাগাতে গিয়েতো কেঁদেই ফেলল। প্রিয়তার মুখভঙ্গি দেখে এমনিতেই নিজেকে শক্ত রাখছিল রুদ্র। এমন ভাব করছিল যেন বিন্দুমাত্র জ্বালা হচ্ছেনা ওর। কিন্তু তাও আদুরে বউটাকে কেঁদে ফেলতে দেখে হতাশ হতে হয়েছিল ওকে। নিজের ডান হাতটা প্রিয়তার বাঁ গালে রেখে বলেছিল, 'কী হয়েছে? কাঁদছো কেন? আমি একবারও বলেছি আমার ব্যথা লাগছে?'

প্রিয়তা কাঁদোকাঁদো গলায় বলেছে, ' না বললে আমি বুঝবোনা? কতটা গভীরে কেটেছে!'

রুদ্র মুচকি হেসে প্রিয়তার অশ্রু মুছে বলেছিল ' এগুলো আমার জন্যে খুবই স্বাভাবিক প্রিয়। এরচেয়েও ভয়ংকর ব্যথা পেয়ে পেয়েই বড় হয়েছি আমি। ভবিষ্যতেও পাব। আমার এসবের অভ্যেস আছে। তাই তুমি যতটা ভাবছো ততটা কষ্ট আমার হচ্ছেনা। তার অর্ধেকও হচ্ছেনা।'

মাথা এগিয়ে রুদ্রর কপালে আলতো করে চুমু খেয়েছিল প্রিয়তা। ফিসফিসিয়ে বলেছিল, ' আপনার সমস্ত ক্ষতর ব্যথাগুলো শুধু আমার হোক।'

অথচ জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষত আর ব্যথা দুটোই সেই প্রিয়তাই দিলো ওকে। ঠকবাজ মেয়েটা কী বিন্দুমাত্র অনুভব করেছে সেই ব্যথা? 
গলার ক্ষততে ঔষধ পড়তেই জ্বালা করে উঠল রুদ্রর। তাকিয়ে দেখল কম্পমান হাতে সেখানে ঔষধ লাগাচ্ছে প্রিয়তা। অথচ এটা ওরই নখের আঘাত! রুদ্র বলল, 'যার ভেতরটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছো তার ওপরের এই সামান্য ক্ষত তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে রাণী মীর্জা? তোমার অভিনয় দক্ষতার সীমাটা ঠিক কোন জায়গায়, জানার আগ্রহ হচ্ছে আমার।' 

হাত থেমে গেল প্রিয়তার। একপলক রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ' রাশেদ আমের আর রুদ্র আমেরের চোখে যখন ধুলো দিতে পেরেছি, তখন অভিনয় দক্ষতা সীমা অনেক দূর অবধিই হবে। কী বলেন?'

রুদ্র দেখল প্রিয়তার ঠোঁটের কোণে ওর দেওয়া ক্ষতটা জ্বলজ্বল করছে। বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল ওর। বেহায়া সেই ভালোবাসা না চাইতেও উতলে উঠল। কিন্তু তখনই মানসপটে ভেসে উঠল নিজের বাবা, সন্তান, বোন, ইকবালের ছবি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল রুদ্র। দুর্বল হবেনা। এই মিথ্যে ভালোবাসার জ্বালে রুদ্র ক্ষতবিক্ষত হবে, কিন্তু দুর্বল হবেনা আর। কোনভাবেই না। ফার্স্ট এইড বক্সটা নিজের দিকে টেনে নিল রুদ্র। নির্বিকারভাবে তুলোয় ঔষধ নিতে নিতে বলল, ' চোটতো তোমারও লেগেছে।'

প্রিয়তা কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল কেবল। রুদ্র তুলোটা আলতো করে লাগালো প্রিয়তার ঠোঁটের কোণে। চোখ বুজে ফেলল প্রিয়তা। যেন কোন অমৃতের ছোঁয়া পেয়েছে।
হঠাৎই খুব নিষ্ঠুরভাবে তুলোটা চেপে ধরল রুদ্র। প্রিয়তা ব্যথায় গুঙ্গিয়ে উঠল। ঝট করে তাকাল রুদ্রর দিকে। মোহনীয় চোখদুটোয় অবিশ্বাস। রুদ্রর বিকারহীনভাবে তাকিয়ে। প্রিয়তা সরে আসতে চাইলে অপরহাতে ওর ঘাড়টা চেপে ধরল রুদ্র। আরও রুক্ষভাবে চেপে ধরল তুলোটা। জ্বালায় কুঁচকে গেল প্রিয়তার মুখ। রুদ্র গম্ভীর গলায় বলল, 'কষ্ট হচ্ছে?'

প্রিয়তা নড়াচড়া থামিয়ে দিল। তবে চোখের বিস্ময় তখনও কাটেনি। রুদ্র আরও জোরে তুলোটা ঘষে দিয়ে বলল, 'এরচেয়েও বেশি কষ্ট হয় আমার, যখন তোমার এই মিথ্যে ভালোবাসাটা দেখি। তোমার নাটক, ছলনা, প্রতারণার কথা মনে করি। হ্যাঁ রাণী! তোমার এই আলগা প্রেম, ভালোবাসা, যত্ন এখন আমাকে ক্ষততে পড়া এই ঔষধের মতোই যন্ত্রণা দেয়। আমার কষ্টগুলো হাজারগুন বেড়ে যায়।'

প্রিয়তার চেহারা বাকি প্রতিক্রিয়াও মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। নির্বিকারভাবে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। রুদ্র মুখ ঘুরিয়ে নিল। ঝাড়া দিয়ে ছেড়ে দিল প্রিয়তাকে। বলল, ' যাও এখান থেকে। নয়তো যেকোন মুহূর্তে খু*ন হয়ে যাবে আমার হাতে।'

প্রিয়তা আবার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, ' একথা এর আগেও বহুবার বলেছেন আপনি। পারেননি আমায় খু*ন করতে। আপনার হৃদয়ে এখনো এতোটা শক্তি জন্মায়নি রুদ্র। আমায় খু*ন করার মতো শক্তি এখনো আপনার হাতে নেই। আপনি আমাকে ভালোবাসেন।' 

কথাগুলো যেন কাঁটা ঘায়ে নুন ছেটালো। সেভাবেই জ্বলেপুড়ে গেল রুদ্র। রুদ্র প্রিয়তাকে ভালোবাসে! এতোকিছুর পরেও রুদ্র প্রিয়তাকেই ভালোবাসে। ছিঃ! সর্বস্ব যেন তিক্ততায় বিষিয়ে গেল ওর। কোন এক গুপ্ত বিষ নীল করে দিল যেন। এতোদিনের ধরে রাখা সব ধৈর্য্য, নির্বিকারতা, দৃঢ়তার বাঁধ ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেল এক ঝটকায়। বিকৃত এক আওয়াজে চিৎকার করে উঠল রুদ্র। সজোরে দুহাতে দুটো কিল বসাল। প্রিয়তা চমকে উঠল। বিস্ফরিত চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে। ঝট করে উঠে দাঁড়াল রুদ্র। উদ্ভ্রান্তের মতো রুমটা পার করে বসার ঘরে গিয়ে পৌঁছল। উত্তেজনায় অস্থির হয়ে গেছে ও। হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুড়ে মারছে।

প্রিয়তা ওখানেই 'থ' মেরে বসে ছিল কিছুক্ষণ। ভাঙচুরের আওয়াজে হুশ ফেরে ওর। কোনমতে উঠে ছুট লাগায় সেদিকে। প্রিয়তা ড্রয়িং রুমে পৌঁছতে পৌছাতে ওর ঠিক সামনে প্রচণ্ড শব্দে আছড়ে পড়ে টিবিটা। হ্যাঁ, রুদ্র টিবিটা খুলে আছাড় মেরেছে ফ্লোরে। প্রিয়তা থমকে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল রুদ্রর দিকে। সেখানেই থামলনা রুদ্র। টি-টেবিলটা ধরে সজোরে উল্টে দিল। কাঁচের পৃষ্টটা বিকট শব্দে ভেঙে চূড়মার হয়ে গেল। তবুও যেন স্বস্তি নেই। উন্মাদের মতো চারপাশে কিছু একটা খুঁজতে থাকল রুদ্র। প্রিয়তা এগিয়ে ধরার চেষ্টা করল রুদ্রকে। নাম ধরে ডেকে ডেকে শান্ত করতে চাইল কোনভাবে। শান্ততো হলোইনা, উল্টে আরও অশান্ত হয়ে উঠল রুদ্র। প্রায় ধাক্কা দিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলল প্রিয়তাকে। হাতের কাছে যা পেল তাই ছুড়ে ফেলতে শুরু করল, আঘাত করতে শুরু করল নিজেকে। খানিক বাদেবাদে আর্তনাদের মতো চিৎকার করতে শুরু করল।
প্রিয়তা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকল পাথরের মতো। রুদ্রর এমন রূপ আগে কখনও দেখেনি ও। বদ্ধ উন্মাদ লাগছে ওকে। মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিদ্ধস্ত। দীর্ঘদিনের বাঁধ ভেঙ্গে পড়া কোন প্রলয় যেন আজ রুদ্র। মিনিটখানেক ঘরটাতে যেন স্বয়ং বিধ্বংস ঘটে গেল। 
অন্যদিকে এগুতে গিয়ে ভাঙা কাঁচের ওপর পা ফেলতে যাচ্ছিল রুদ্র। প্রিয়তার পিলে চমকে উঠল। দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা দিল রুদ্রকে। টাল সামলাতে ব্যর্থ হয়ে দুজনেই সোফার ওপর গিয়ে পড়ল। কাজটা করতে গিয়ে কখন প্রিয়তার পায়ের কোণে কাঁচ ফুটেছে টেরই পায়নি ও। 

সোফার সঙ্গে রুদ্রর দুবাহু কোনমতে চেপে ধরল প্রিয়তা। কোনমতে বলল, ' শান্ত হন। প্লিজ শান্ত হন।'

রুদ্রর তীক্ষ্ম চোখজোড়া লাল হয়ে গেছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎই অনেকটা নেশাগ্রস্তের মতো তাকাল ও প্রিয়তার দিকে। মনে পড়ে গেল দু-বছর আগের সেই রাতের কথা। যেদিন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় প্রথমবার প্রিয়তাকে নিজের মনের অনুভূতি জানিয়েছিল রুদ্র। প্রথমবার প্রেমের স্পর্শ দিয়েছিল ওকে।
প্রিয়তাও চোখে বিভ্রম নিয়ে তাকাল রুদ্রর চোখে। ও নিজেও রুদ্রর চোখে আজ সেইরাতের পাগলামো, অসহায়ত্ত্ব দেখতে পাচ্ছে। প্রিয়তা কিছু বলবে তার আগেই রুদ্র ওর গালে হাত রেখে বলল, ' কেনো করলে এটা? আমারে মারার জন্যে আর কিছু ছিলোনা? অনুভূতিটাই বেছে নিলে?'

প্রিয়তা স্থির হয়ে গেল। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। রুদ্রও তাকিয়ে আছে, প্রিয়তার চোখে। রুদ্র তার অপর হাতটাও রাখল প্রিয়তার গালে। বলল, ' তোমার এই চোখদুটো আমার কতপ্রিয় ছিল তুমি জানো? এই চোখের দিকে তাকালে আমি সবকিছু ভুলে যেতাম। কিন্তু আজ! আজ এই চোখদুটো আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। ভেতর থেকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। শেষ করে দিচ্ছে আমাকে। এই চোখদুটো আমায় ব্যঙ্গ করে বলছে, তুমি হেরে গেছো রুদ্র আমের। অপরাজেয় রুদ্র আমের জগত সুন্দর দুটো চোখের কাছে হেরে গেছে। খুব নিষ্ঠুরভাবে হেরে গেছে।'

প্রিয়তা তখনও সেভাবেই তাকিয়ে আছে। রুদ্র ছেড়ে দিল প্রিয়তাকে। উঁবু হয়ে দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরল। কিন্তু প্রিয়তা নড়তে পারল না, আগের মতোই স্থির হয়ে বসে রইল। ভেতর থেকে যেন জমে গেছে ও। 
সময় কতটা পার হল তার হিসেব দুজনের কারোরই রইল না। কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল ঘরটা। পিনপতন নীরবতা। হঠাৎই আবার প্রিয়তার দিকে ঘুরে তাকাল রুদ্র। মুহুর্তের মধ্যে ঝট করে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। একদম শক্ত করে চেপে ধরল নিজের মাঝে। কতদিন পর রুদ্র প্রিয়তাকে নিজে থেকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু প্রিয়তা দম যেন আরও বন্ধ হয়ে এলো। হাঁসফাঁস করতে শুরু করল ও। রুদ্র অস্থির গলায় বলল, 'একবার বলো আমি যা ভেবেছি, যা দেখেছি, যা বুঝেছি সব মিথ্যে, ভ্রম। আমি বিশ্বাস করে নেব। বিশ্বাস কর, আমি বিশ্বাস করে নেব। আমার হাতে আসা সব প্রমাণ, চোখে দেখা সব সত্যি, ইকবাল ভাইয়ের সেই ম্যাসেজ; সবকিছু অস্বীকার করে দেব আমি। সবকিছু ভুল, মিথ্যে, বানোয়াট মেনে নেব। শুধু তোমার কথাটাকেই সত্য ধরে নেব আমি। শুধু তুমি নিজের মুখে একবার বলো সব মিথ্যে। কোন প্রমাণ, কোন সাক্ষী দরকার নেই আমার। মেনে নেব আমি তোমার কথা। তুমি নিজে শুধু একবার বলো প্লিজ। প্লিজ!'

সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়ে গরম তরলের উপস্থিতি টের পেল প্রিয়তা। গা ছেড়ে দিল ও। কিছু বলার, কিছু করার বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট রইলনা শরীরে। প্রিয়তাকে ছেড়ে সোজা ওর মুখের দিকে তাকাল রুদ্র। ভেজা, লালচে চোখদুটোতে কাতর মিনতি, নিরন্তর কেঁপে চলেছে সরু পুরুষালি ঠোঁটজোড়া। 
প্রিয়তা থ হয়ে গেল। চোখে চরম অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। এটা ওর রুদ্র না! রুদ্র আমের এমন হতেই পারেনা। রুদ্র আমের দৃঢ়, শক্ত, প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। যার প্রতিটা পদক্ষেপ পূর্বকল্পিত, সুপরিকল্পিত হয়। যুক্তি, বাস্তবতা যার মস্তিষ্কে সদা সজাগ থাকে। এমন অযৌক্তিক, আবেগি, ছেলেমানুষী কথা রুদ্র আমের বলতে পারেনা। বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণকারী রুদ্র আমের এক বিশ্বাসঘাতিনীর সামনে এমন আকুতি জানাতেই পারেনা। কবে হল ভঙ্গ হল এই নিয়ম? সেদিন, যেদিন পরিকল্পনা ছাড়া প্রথম কোন পদক্ষেপ নিয়েছিল রুদ্র। দুর্বলতা প্রদর্শন করেছিল মোহনীয় ঐ চোখদুটোর প্রতি। ভালোবেসেছিল প্রিয়তাকে। এই ধ্বংসকারী ভালোবাসা কী ভয়ংকরভাবে নিঃস্ব করে দিয়েছে ওর প্রিয় মানুষটাকে। ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না পেল প্রিয়তার। চোখে অশ্রু এসে জমা হল। সমস্ত শরীর জ্বলতে শুরু করল। রুদ্র অসহায় গলায় বলল, 'প্লিজ। একবার বলো সব মিথ্যে।'

সমস্ত সত্যি জেনেও কোন অনাকাঙ্ক্ষিত বোকামিতেই প্রিয়তার দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে রইল রুদ্র। কিন্তু প্রিয়তা আরও একবার নিরাশ করল ওকে। উত্তর দিলোনা। শুধু চোখভর্তি জল নিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকল রুদ্রর দিকে। সেই নীরবতা যেন চিৎকার করে জানিয়ে দিল, কিচ্ছু মিথ্যা না। সবকিছুই সত্যি। আকাশে থাকা ঐ চাঁদ, সূর্যের মতো অনস্বীকার্য সত্যি। ক্ষণিকের জন্যে গভীর আবেগে পড়া রুদ্র আমেরের যেন হুঁশ এলো মুহূর্তেই। স্বব্যক্তিত্ব্যে ফিরতে সময় লাগল না ওর। যতটা আদরে প্রিয়তাকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ধরেছিল, ততটাই নিষ্ঠুরভাবে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিল ওকে। চোখে ফুটে ওঠা সেই কাতরতা মুহুর্তের মধ্যেই তীক্ষ্ম হিংস্রতার রূপ নিল। খপ করে চেপে ধরল প্রিয়তার গলা। সোফার সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরে ফ্যাঁসফ্যাঁসে বলল, ' সবাই বলে সব ক্ষমতাশীলদের জীবনেই কোন একটা গুরুত্বর ভুল থাকে, যা তাদের পতনের কারণ হয়। তুমি শুধু আমার জীবনের সেই ভুল নও, অভিশাপ। আমার জীবনের সমস্ত পাপের মধ্যে সবচেয়ে বড় যদি কোন পাপ হয়ে থাকে, সেটা হল তোমার এই চোখের ছলনায় পড়ে যাওয়া। তোমাকে ভালোবাসা। যেই ভালোবাসা আমায় নিঃস্ব করে দিয়েছে। ইউ আর দ্য বিগেস্ট কার্শ অফ মাই লাইফ।'

শ্বাস নিতে পারছেনা প্রিয়তা। গাল ফুলে আসছে, চোখ লাল হয়ে আসছে। অথচ বিন্দুমাত্র বিকার নেই ওর মাঝে। চোখে জমে থাকা সেই জল নিয়ে তাকিয়েই আছে রুদ্রর দিকে। রুদ্র একই গলায় বলল, ' তোমার প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই আমার রাণী। ঘৃণা করি আমি তোমায়।'

হালকা একটু কেঁপে উঠল প্রিয়তা। কিন্তু মুখটা তখনও বিকারহীন। রুদ্র ছেড়ে দিল প্রিয়তাকে। উঁঠে দাঁড়িয়ে উল্টো ঘুরে বলল, ' আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাও প্রিয়তা। সহ্য হচ্ছেনা তোমাকে আমার। হয়তো খুন করব না, কিন্তু আঘাত করতে হাত আটকাবে না আমার। ধৈর্যের পরীক্ষা নিওনা।'

প্রিয়তা যেন ঘোরে আছে। গভীর ঘোর। সেই ঘোরে থেকেই কোনমতে উঠে দাঁড়াল। হাত-পা কাঁপছে আজ ওর। অনেকবছর পর। আস্তে আস্তে বাইরের দিকে হাঁটা দিল প্রিয়তা। নিচে পড়ে থাকা কাঁচ, ভাঙা অংশে লেগে পায়ের কয়েক জায়গা কেঁটে গেল। কিন্তু প্রিয়তার গতিতে, চলনে কোন পরিবর্তন হলোনা। একইভাবে হেঁটে বেরিয়ে এলো বনানীর সেই ফ্ল্যাট থেকে। এতোকিছুর মাঝে রুদ্র একবারও ঘুরে দেখল না। জানল না, আজ ও স্বয়ং কারো শেষের সূচনা ঘটিয়ে দিয়েছে। সে মানুষটা ওর ভীষণ প্রিয়।

মধ্যরাত্রি। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। ওভার স্পিডে বাইক চালাচ্ছে প্রিয়তা। কালো জ্যাকেট, কালো জিন্স, কালো হেলমেট! কুয়াশার কারণে হেলমেটের সামনের গ্লাস উঠিয়ে দিয়েছে। ফলেষঠান্ডা, তীক্ষ্ম বাতাসে চোখ জ্বালা করছে ওর। খানিক বাদে বাদে টপটপ করে পানি পড়ছে। তবুও স্পিড কমাচ্ছেনা প্রিয়তা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে বাইকের স্পিড। নিজেকে টর্চার করার এতো ভালো মাধ্যম ছাড়া যায় নাকি? 

***********

মৈনট ঘাট। ঢাকার ব্যস্ত শহর থেকে অনেক দূরে শান্ত এক ঘাট। অনেকসময় সমুদ্রসৈকতের অনুভূতি দেয় জায়গাটা। দীর্ঘক্ষণ বাইক চালিয়ে এখানে এসেছে প্রিয়তা। কেন? জানা নেই ওর। রাত এখন প্রায় শেষের দিকে। আবছা অন্ধকারে চিকচিক করতে থাকা বালুর ওপর বসে আছে ও। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পদ্মা নদীর ঢেউগুলোর দিকে। অন্ধকারে কালচে নীলরঙা ঢেউগুলো অসম্ভব সুন্দর লাগছে। হাতে থাকা হুইস্কির বোতলটাতে থেকে থেকে চুমুক দিচ্ছে ও। ঠান্ডা শীতল বাতাসের তালে তালে উড়ছে চুলগুলো। চারপাশের অপূর্ব এই সৌন্দর্যের দিকে মন নেই প্রিয়তার। ও দেখছে এই রাতটাকে। যা সমস্ত হিসেব পাল্টে দিয়েছে। ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ইচ্ছের মৃত্যু ঘটেছে আজ। তবে বাকি খেলাটার কী হবে? কীভাবে এগোবে ও? সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়েও পারল না। মন-মস্তিষ্ক জুড়ে আজ কেবল এক শ্যামপুরুষের চিন্তা। পৃথিবীতে ঐ একটা মানুষই অবশিষ্ট ছিল, যে ওকে অসম্ভব ভালোবাসতো। সেই ভালোবাসাটাও ওর জীবনে ক্ষণিকের জন্যেই এসেছিল। নাহ্। উচ্ছ্বাস, কুহু, নীরব, জ্যোতি ওরাওতো ভালোবাসে ওকে। খুব ভালোবাসে। কিন্তু ওর সত্যিটা জানার পর সে ভালোবাসাটা কী আর থাকবে? কখনই না। ভালোবাসাকে ধরে রাখার ক্ষমতা নেই ওর। আগেও কখনও পারেনি। এবারতো প্রাণপনে চেষ্টা করেও পারল না।
বিশাল এই পৃথিবীতে নিজেকে ভীষণ একা মনে হল আজ ওর। নিজের করা ভুলগুলো আকাশের ঐ চাঁদটার মতোই জ্বলজ্বল করছে মানসপটে। রুদ্র নামক মানুষটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে ও। সবটা বোধহয় অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু কীভাবে? কোন উপায় ছিল কী? থাকলে প্রিয়তা কেন দেখতে পেলোনা? প্রাণপণে চেষ্টা করেও কেন পারল না দুদিকটা সামলাতে। লক্ষ্যের এতো কাছে এসে এভাবে সব গুলিয়ে গেল কেন?

হঠাৎই পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেল প্রিয়তা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ঝাকড়া চুলের একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আবছা আলোয় জয়কে চিনতে অসুবিধা হলোনা ওর। পুনরায় চোখ নদীর ঢেউয়ের দিকে দিয়ে বলল, 'তুমি এখানে?'

জয় এগিয়ে এলো খানিকটা, ' স্যার পাঠিয়েছেন। আপনি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কল করেছিল। খোঁজ নিতে বলেছিল আপনি কোথায়, কী করছেন। আর ঢাকায় এলে আপনি প্রায় এখানে আসতেন। তাই গেস করেছিলাম এখানেই থাকবেন।'

' তোমার স্যারের হঠাৎ আমার জন্যে চিন্তা হল কেন? যাকে ঘৃণা করে, তার প্রতি কনসার্নড হওয়ার মানে আছে?'

' ব্যপারটা যে কনসার্ন সেটা আপনাকে কে বলল? হঠাৎ কোথায় গিয়ে কী পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন, সেটা জানার জন্যেওতো পাঠাতে পারে।'

ঠোঁটে বাকিয়ে হাসল প্রিয়তা। লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, 'পয়েন্ট!'

বলে আবার আগের মতোই তাকিয়ে রইল নদীর পানিতে। কিছুক্ষণ প্রিয়তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল জয়। বেশ খানিকক্ষণ ইতস্তত করার পর বলল, 'আপনার বোধ হয় একটু ট্রিটমেন্ট আর রেস্ট দরকার ম্যাডাম। আপনার ঠোঁটের কোণে ব্লা*ড জমে আছে এখনো। পায়ের অবস্থাও ভালো না।'

প্রিয়তা যেন শুনতে পায়নি জয়ের কথা। জয়ের মধ্যেও অস্থিরতা বাড়ল। রুদ্র শুধু নজর রাখতে বলেছিল। কিন্তু এখানে আসার পর প্রিয়তাকে এভাবে দেখে কোন এক দৈব আকর্ষণেই যেন চলে এসেছে এতোটা কাছে। এখন কী করবে বুঝতে পারছেনা ও। হঠাৎ প্রিয়তা নরম গলায় বলে উঠল, 'আমার পাশে একটু বসবে জয়? একা লাগছে খুব।'

জয় চকিতে চাইল। শরীর কেমন শিরশির করে উঠল ওর। অজান্তেই সামনে বসে থাকা মেয়েটার জন্যে চিনচিন করে উঠল বুকের ভেতরটা। কোন দ্বিধা নেই এখন ওর মাঝে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ও। আস্তেধীরে বসল প্রিয়তার পাশে। কিছু বলল না। শীতল শো শো বাতাসটা বেড়ে চলেছে সময়ের সঙ্গে। অদ্ভুত মোহনীয় দেখাচ্ছে পদ্মার একেকটা ঢেউ। প্রিয়তা সেই ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল, 'তোমার আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার কথা মনে আছে জয়?'

ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে জয় বলল, ' হ্যাঁ, ব্রিটেনে। তখন শান স্যারের হয়ে কাজ করতাম আমি ওখানে। একটা ক্লাবে গিয়েছিলেন আপনি আর শান স্যার। ঐদিন অনেক বেশি নেশা করে ফেলেছিলেন আপনি। শান স্যারও ড্রাংক ছিল। কিন্তু আপনার অবস্থা আর বেশি খারাপ ছিল। শান স্যারের কথায় আমিই আপনাকে ওখানকার একটা রুমে নিয়ে গিয়েছিলাম।'

' ড্রাংক অবস্থায় ঐদিন তোমার সঙ্গে অনেক কথা বলেছিলাম আমি। এমন অনেক কথা বলেছিলাম যা আমি কাউকে বলিনি। আমার ছোটবেলা, মায়ে খুন সব গড়গড় করে সব উগলে দিয়েছিলাম। শুধু তাইনা, তারপরের দিন থেকেই তোমাকে নিজের সহকারি হিসেবে চেয়ে নিয়েছিলাম। কেন জানো?'

জয় তাকাল প্রিয়তার দিকে। প্রশ্নটা ওর মনেও জেগেছিল বহুবার। উত্তর পায়নি। প্রিয়তা খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ' কারণ ঐদিন রাতে আমার প্রতি তোমার ব্যবহার মুগ্ধ করেছিল আমাকে। ড্রাংক ছিলাম আমি। চাইলেই খারাপভাবে ছুঁতে পারতে, একটু হলেও সুযোগ নিতে পারতে। প্রাণের ভয়ে করোনি কথাটা গ্রহণযোগ্য হতো, যদি আমি মেয়ে না হতাম। কথায় আছেনা, একটা মেয়ে খুব ভালোভাবে টের পায় কে তাকে কীভাবে স্পর্শ করছে। শুধু তাইনা, আমাকে ওখানে একা রেখে চলে আসোনি তুমি। দায়িত্ব নিয়ে বসে ছিলে আমার পাশে। পাহারা দিয়েছো। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলে আমার প্রতিটা কথা। অনেকবছর পর নিঃসংকোচে মনখুলে কথা বলেছিলাম সেদিন আমি। ভালো লেগেছিল তোমাকে।'

চোখ সরিয়ে নিল জয়। অদ্ভুত লাগছে ওর। প্রিয়তা একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, 'এরপর যখন তুমি আমার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলে। আস্তে আস্তে ভীষণ ভরসার একজন মানুষ হয়ে গিয়েছিলে তুমি আমার। খুবই বিশ্বস্ত একজন। সেকারণেই সোলারে সিস্টেমে তোমাকে কিচ্ছু না করে থাকতে বলেছিলাম আমি। বিকজ আই কুডেন্ট অ্যাফড টু লুস ইউ। আমি কখনও বলিনি, কিন্তু তুমিও জানো তোমাকে আমি সবসময়ই আমার ভাই মনে করেছি।'

এবার খুব ধীরেধীরে প্রিয়তার দিকে তাকাল জয়। আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জলে চিকচিক করছে প্রিয়তার গাল। কাঁদছে মেয়েটা! আরও কিছুক্ষণ কেবল নদীর কলকল শব্দ আর বাতাসের শো শো ধ্বনিই শোনা গেল। হঠাৎ করেই জয় বলল, 'খুব বিশ্বস্ত মানুষ যখন বিশ্বাস ভাঙে তখন খুব কষ্ট হয়, তাইনা ম্যাডাম? আপনিতো শুধু ভাই মনে করতেন আমায়। অথচ আমার বিশ্বাসঘাতকতাই আপনাকে আঘাত করেছে। তাহলে ভাবুন, যে আপনাকে ভালোবেসেছিল, বিয়ে করেছিল, টানা দু-বছর সংসার করেছিল, তার কেমন লাগছে। আপনার দেওয়া প্রতিটা আঘাত তাকে ঠিক কতটা কষ্ট দিয়েছে। কতটা নিষ্ঠুরভাবে ভেঙেছে তাকে।'

দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রিয়তা। আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল, 'তোমার স্যারের কষ্ট দেখেযে তুমি ঘোল পাল্টাওনি সেটা আমি জানি। কাহিনী অন্যকিছু।'

মুচকি একটু হাসল জয়। নিজেও আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ' মনে আছে সেদিন আপনাকে কী বলেছিলাম আমি? যেদিন আপনাকে দেখে আমার করুণা হবে, সেদিন বলব আমি কেন এসব করেছি। সত্যি বলছি ম্যাডাম, কারণটা জানা নেই। তবে আজ সত্যিই আমার করুণা হচ্ছে আপনাকে দেখে।'

প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের এক টুকরো হাসি দিল। কিছু বলল না। কিন্তু জয় বলে উঠল, ' মীরাকে মনে আছে ম্যাডাম?'

প্রিয়তা চমকে উঠল। ঝট করে তাকাল জয়ের দিকে। প্রিয়তার প্রতিক্রিয়া দেখে বিষাদময় হাসি দিল জয়। বলল, 'যাক, ওকে ভোলেননি তাহলে।'

প্রিয়তা চোখে বিস্ময় আর প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে জয়ের দিকে। জয় বলল, ' এটাই ভাবছেনতো হঠাৎ ঐ মরে যাওয়া মেয়েটার কথা কেন বলছি? তাও এতোগুলোদিন পর। ঐ মরে যাওয়া মেয়েটাকে আমি ভালোবাসতাম ম্যাডাম। ভীষণ ভালোবাসতাম।'

ভ্রুজোড়া কুঁচকে উঠল প্রিয়তার। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। অতঃপর অবাক কন্ঠে বলল, 'এসব কবে হল?'

জয় ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল, ' ব্রিটেন থেকে ফেরার কিছুদিন পর থেকে আপনার সঙ্গে প্রায়ই দেখতাম ওকে। প্রথম দেখাতেই ভীষণ ভালোলেগেছিল আমার। ওর গোলগাল মুখের ঐ অদ্ভুত শীতলতা খুব গভীরভাবে টানছিল। তখনও কিছু বলিনি ওকে। ওর নামটা জেনেছিলাম শুধু। ফেসবুকে সার্চ দিতেই পেয়ে গিয়েছিলাম। সেখানেই কথা হতো আমাদের। ও তখনও জানতোনা আমিই সেই ছেলে যাকে ও আপনার সঙ্গে দেখেছিল। অনেক পরে বলেছিলাম সেটাহ খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল ও। আমাকে ও আপনার বডিগার্ড হিসেবেই জানতো। কারণ এসব বিষয়ে খুব বেশি বিস্তারিত জানা ছিলোনা ওর। ভয়ে ছিল, আপনি জেনে গেলে বিপদ হবে। কিন্তু আমি আশ্বস্ত করেছিলাম কিচ্ছু হবেনা। এরপর নাম্বার আদানপ্রদান, ফোনালাপ। মাঝেমাঝে দেখাও করেছি। তবে খুব কম। যত দিন গেল ততবেশি মায়ায় জড়িয়ে গেলাম ওর। কবে এতোটা ভালোবেসে ফেললাম বুঝতেই পারিনি। একদিন বলেই ফেললাম মনের কথা। শোনামাত্র ফোন কেটে দিয়েছিল পাগলিটা। সরল ছিলোতো। কথায় কথায় ভয় পেয়ে যেতো। আমার কল রিসিভ করাও বন্ধ করে দিল। কিন্তু এদিকে আমিও ছিলাম নাছোড়বান্দা। মেসেজের পর মেসেজ করে গেলাম ওকে। কিন্তু উত্তর পাইনি। শেষমেশ একদিন বাইরেই পাকরাও করলাম ওকে। দুহাত ধরে মনে সব কথা বলে দিলাম। ভিতু মেয়েটা বোধহয় সেদিন সব ভয় গিলে ফেলেছিল। হুট করেই জড়িয়ে ধরল আমায়। এরপর, বুঝতেই পারছেন। তবে বেশিদিন কাছাকাছি প্রেম করার সুযোগ হলোনা আমাদের। আপনি আমায় ঢাকা পাঠিয়ে দিলেন, সোলার সিস্টেমে। আমাদেরও দেখা করা বন্ধ হল। কিন্তু ফোনে নিয়মিত কথা হতো। স্যার কোন কাজে কখনও চট্টগ্রাম পাঠালে দেখাও করতাম। আপনার আর স্যারের বিয়ের অনুষ্ঠানে কয়েকবার ইশারায় কথা বলেছি, লুকিয়ে দেখা করেছি। আপনার বিয়ের প্রথম রাতেও একটা নিরিবিলি জায়গায় অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম আমরা। পরেরদিন এজন্যই এতক্ষণ ঘুমিয়েছিল ও। এরপরও এভাবেই চলছিল। তবে ভালো চলছিল। ভেবেছিলাম এসব ঝামেলা মিটে গেলেই বিয়ে করব ওকে। নিজের একটা সংসার সাজাব।'

বিস্ময়ে থ হয়ে গেছে প্রিয়তা। এতোকিছু ঘটে গিয়েছিল এরমাঝে! সারা শরীরে কেমন ঝিম ধরছে প্রিয়তার। হিসেব অনেকটাই মিলছে ওর। জয় বলে চলল, ' অথচ তার ঠিক ছয়মাস পরেই ওই সাধারণ, সরল মেয়েটাকে খুন করিয়েছেন আপনি। মেয়েটাকে শুধু খুনই করা হয়নি। খু*ন করার আগে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য যন্ত্রণাটা দেওয়া হয়েছিল ওকে। রে- রে*প করা হয়েছিল।'

প্রিয়তা দ্বিতীয়বার চমকাল। এবারের চমকটা বেশি ভয়ংকর ছিল। বিষাদভর্তি চোখে প্রিয়তার দিকে তাকাল জয়। অশ্রু জমে আছে সেখানে। নদীর দিকে সেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে গেল ও। মনে করল সেই বিভৎস রাতটার কথা-

••••••••••••••••

বর্ষার সময়। সন্ধ্যা থেকেই ভারী বর্ষণ হচ্ছিলো সেদিন। তখন মাঝরাত। জয় ফোনে কথা বলছিল মীরার সঙ্গে। বৃষ্টির সময় প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যকার প্রেমভাব আরও বেশি জেগে ওঠে। ওদের মধ্যেও তাই হচ্ছিলো। তারওপর বিদ্যুৎ ছিলোনা মীরার ফ্ল্যাটটাতে। একটা বড় মোম জ্বালিয়ে রেখেছে ও। বেশ কয়েকঘন্টার প্রেমালাপের পর হঠাৎ করেই মীরা বলল, ' এভাবে আর কতদিন জয়?'

' কীভাবে?'

' এইযে এতো দূরে, এতো অনিশ্চয়তার মাঝে। তুমি আদোও আমায় বিয়ে করবেতো?'

' তোমার কেন মনে হল আমি তোমাকে বিয়ে করব না?'

মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ' জানি না। মাঝেমাঝে মন কু'ডাকে। যেমন এখন ডাকছে, হঠাৎ করেই। মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা হবেনা।'

জয় শাসনের সুরে বলেছিল, ' এভাবে বলেনা। এমন কিছুই হবেনা। একটু ধৈর্য্য ধরো, খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করব আমি তোমাকে।'

' সত্যি?'

' সত্যি।'

মৃদু হাসল মীরা। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ' একটু লাইনে থাকো। আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি। বেশি দেরী হলে কল কেটে দিও।'

'হুম।'

ফোনটা বালিশের নিচে রেখে টর্চটা নিয়ে ওয়াশরুমে গেল মীরা। বেশ অনেকটা সময় পর ওয়াশরুম থেকে বের হল ও। তখনও জয়ের কথাই ভাবছিল। ঠোঁটে ছিল মুচকি হাসি। কিন্তু সামনে তাকাতেই পিলে চমকে উঠল মেয়েটার। এই মধ্যরাতে তিনজন যুবককে নিজের রুমে দেখে আত্মা শুকিয়ে গেল ওর। মীরা এমনিতেই সহজে ভয় পেয়ে যাওয়া মেয়ে। এমন দৃশ্য জমিয়ে দিল ওকে। এরা কীভাবে ভেতরে ঢুকল, কী করতে ঢুকল সেসব অনেক পরের প্রশ্ন। কোন সৎ উদ্দেশ্যে ওরা আসেনি তা নিশ্চিত। তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে আসতে নিলেই নিঃশ্বাস আটকে এলো মীরার। দৌড়ে ওয়াশরুমে ফিরে গিয়ে দরজাটা লাগাতে নিলেই লোকটা দ্রুতবেগে এসে মাঝপথেই একহাত‍ে আটকে রাখল দরজা। দুহাতের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেও দরজাটা লাগাতে পারল না মীরা। অসহায়ের মতো কেঁদে ফেলল। অন্যহাত দিয়ে মীরার বাহু চেপে ধরল আগন্তুক। সে আর কেউ নয়, সম্রাট তাজওয়ার। সম্রাট টেনে সেখান থেকে বের করে আনল মীরাকে। এবার মীরা চেঁচাতে শুরু করল, 'কারা আপনারা? এখানে কী করছেন? ছাড়েন আমাকে। ছাড়েন!'

জয় ফোনের ওপাশ থেকে শুনতে পেল মীরার চিৎকার। অস্থির হয়ে উঠল ও। ভালোবাসার মানুষটা কোন বিভৎস বিপদে পড়েছে বুঝতে পেরেই কলিজা মোচড় দিল। লাউড স্পিকারে দিল ফোনটা। চেঁচিয়ে বলে উঠল, 'মীরা! শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? মীরা? কী হয়েছে? কারা এসেছে? মীরা!'

কিন্তু ওদিকে কারো মনোযোগ নেই। ততক্ষণে বড় একটা ওড়না নিয়ে এসেছে সম্রাটের একজন লোক। সাজ্জাদ। সে বলল, 'ভাই যা করার তাড়াতাড়ি করে চলে যেতে হবে। কেউ চলে আসলে বিপদ।'

মীরা ভীত চোখে এদিক-ওদিক তাকাল। ভয়ে সর্বাঙ্গ অসার হয়ে আসছে ওর। ও আরও জোরে চিৎকার করে বলল, 'কী করবেন আপনারা? কে আপনি। বাঁচাও!'

সম্রাট মুচড়ে ধরল মীরার চুলগুলো, ' চুপ থাক! নইলে গলা কে*টে ফেলব।' অতঃপর সাজ্জাদ দিকে তাকিয়ে বলল, ' বাহিরে ঠাডাপড়া বৃষ্টি। এই মেয়ে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করলেও কেউ টের পাবেনা।'

সম্রাটের গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে নেশায় বুদ হয়ে আছে সে। ফোনের ওপাশ থেকে সম্রাটের গলা চিনতে অসুবিধা হলোনা জয়ের। থেমে গেল ও। প্রিয়তার সঙ্গে বহুবার দেখেছে সম্রাটকে। গলাও শুনেছে অসংখ্যবার। ঘামতে শুরু করল এবার ও। হিসেবে মিলাতে সময় লাগলনা। প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, 'সম্রাট ভাই! সম্রাট ভাই ওকে ছেড়ে দেন। ও কাউকে কিছু বলবেনা। ওর এতো সাহস নেই। প্লিজ শুধুশুধু ওর কোন ক্ষতি করবেন না। ও এসবের মধ্যে নেই। বিশ্বাস করুন।'

কিন্তু সেসব কিছুই কানে আসছেনা সম্রাট বা অন্যকারো। ভয়ে, চিন্তায় মীরারও মাথায় নেই জয় লাইনে থাকতে পারে। ও ছটফট করছে সম্রাটের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে। সাজ্জাদ বলল, 'কিন্তু ভাই। সময় নষ্ট করাটা কী ঠিক হইব?'

সম্রাট বলল, 'তোরা বাইরে গিয়ে দাঁড়া।' এরপর মীরার দিকে তাকাল। নেশাগ্রস্ত চোখে লালসা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মীরার থুতনি হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল, 'এতোদূর কষ্ট করে আসছি। কিছু উসুল না করে চলে যাব? ন্যাহ্। লস হয়ে যাবে। এমন লস আবার আমি করিনা।'

সাজ্জাদ এবং আরেক সঙ্গী স্পষ্ট বুঝল কী বোঝাচ্ছে সম্রাট। মীরার শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল ও, ' না না প্লিজ। ছেড়ে দিন আমাকে। প্লিজ আমার যা আছে নিয়ে যান। কিন্তু এমন করবেন না, প্লিজ।'

সপাটে একটা চড় পরল মীরার গালে। সম্রাট দাঁতে দাঁত চেপে বলল, 'মুখ বন্ধ রাখ শালি। নাহলে জাহান্নাম দেখিয়ে আনব।'

ফোনের ওপাশে জয় যেন উন্মাদ হয়ে উঠল। গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে শুরু করল, কাঁদতে শুরু করল। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করল ও। অনুরোধ করল, 'সম্রাট ভাই না না, ভাই এমন কইরন না। ছেড়ে দেন ওকে। ভাই আপনা পায়ে পরি, না।'

এদিকে তার কিছুই শুনতে পেলোনা ওরা। সাজ্জাদ ইতস্তত করে বলল, ' ভাই মানে_'

সম্রাট ভ্রুকুটি করে তাকাল দুজনের দিকে। বিরক্তি নিয়ে বলল, ' শেয়ার লাগব? এইসব ক্ষেত্রে শেয়ার দেইনা আমি। বের হ।'

অগত্যা মাথা নুইয়ে বেরিয়ে গেল দুজন। মীরাকে টেনে নিয়ে বিছানায় ছুড়ে ফেলল সম্রাট। মীরা হাত জোর করে আকুতি-মিনতি শুরু করল, ' প্লিজ আমার সাথে এমন করবেন না। ছেড়ে দেন আমায়। আল্লাহর দোহাই লাগে ছেড়ে দেন।'

সম্রাট কানেই তুলছেনা সেসব। নিজের শার্ট খুলতে ব্যস্ত সে। সে সুযোগে নেমে আসতে চাচ্ছিল মীরা। কিন্তু পারল না। বিছানার সঙ্গে তাকে চেপে ধরল সম্রাট। ঠাটিয়ে দুগালে দুটো চর মেরে বলল, 'একদম চুপ থাক মাদার চোদ। যতো বেশি ডিসটার্ভ করবি ততবেশি যন্ত্রণা দেব। চুপ!'

বলে আর অপেক্ষা করল না। মীরার গলায় থেকে ওড়নাটা টেনে খুলে ফেলল জানোয়ারটা। এরপর বাকিটা সময় যেন কোন জলজ্যান্ত বিভিষিকা। জানোয়ারের মতোই মীরাকে খুবলে খাওয়া শুরু করল সম্রাট। মীরা দয়া ভিক্ষা চাইল, প্রাণপনে ছটফট করল, চিৎকার করল। কিন্তু কোনকিছুই স্পর্শ করল না পশুটাকে। উত্তেজনার চরমে থাকা সম্রাট কেবল সর্বশক্তি দিয়ে কেবল নিজের বাসনা মেটাতে ব্যস্ত থাকল। মীরার একেকটা আর্তনাদে শুধু ঐ ঘর কাঁপছিল না। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল এপাশে থাকা জয়। কী অসহ্য, দমবন্ধকর যন্ত্রণা। পাগলের মতো কেবল চিৎকার করছিল ছেলেটা। থেকে থেকে আঘাত করছিল নিজেকে। একটু পরপর কল করছিল রাণীর সেই নাম্বারে। যে নাম্বারে ও যোগাযোগ রাখতো। কিন্তু সেটাও বন্ধ। একপর্যায়ে সব ধৈর্য হারিয়ে ফেলে ও। গলা ফাঁটিয়ে গালাগালি দেয়, হুমকি দেয়। কিন্তু সবই নিরর্থক। নেশায় বুঁদ থাকা সম্রাট আর যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা মীরা কেউই শুনতে পায়না সে শব্দ। অসহায় হয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পরে জয়। ওপাশ থেকে আসা মীরার একেকটা যন্ত্রণাময় আর্তনাদে মরে যেতে ইচ্ছে করে ওর। কান চেপে ধরে। হাত কামড়ে ধরে। জোরে জোরে মাথা ঠোকে খাটের পায়ার সঙ্গে। বিকট শব্দে আর্তনাদ করে ওঠে। অসহায়, অপারগের মতো শুনে যায় প্রিয় মানুষটার সতীত্ব হরণের একেকটা আর্তনাদ।
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp