ইশতেহার কৌশিক স্যার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছেন। কেউ বলছে, তিনি গুরুতর সমস্যায় ভুগছেন, আবার কেউ বলছে, তিনি হয়তো আর ফিরবেন না। স্যারের বেশভূষা নিয়ে শুরু থেকেই ফিসফাস চলত। প্রচণ্ড গরমেও ভারী পোশাকে থাকতেন তিনি। দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম লাগলেও, কেন যেন সেটা স্বাভাবিক মনে হতো না। তার চলাফেরা, তার চোখের গভীরতা, তার নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি! সবকিছুই একরকম সন্দেহ জাগাতো। সবার সামনে তিনি ছিলেন জ্ঞানের আধার, কিন্তু তার অনুপস্থিতিতেও সেই রহস্যের গুঞ্জন থামেনি। বরং আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়েছে।সবচেয়ে অস্থির দেখাচ্ছে রূপালী ম্যামকে। তিনি বারবার নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, করিডোরে পায়চারি করছেন, কৌশিক স্যারের খোঁজ নিচ্ছেন। এমনকি তার নির্ধারিত ক্লাসরুমেও গিয়ে উঁকি মেরে এসেছেন কয়েকবার। রূপালী ম্যামের এই অস্বাভাবিক ব্যস্ততা দেখে অনেকেই সন্দেহ করছে যে তিনি হয়তো কৌশিক স্যারের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কেউ ফিসফিস করে বলছে, "উনি তো একদম পাগল হয়ে গেছেন স্যারের জন্য!" এই গুঞ্জন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। ফিসফিসানি এতটাই বেড়েছে যে, অনন্যার কানে এসেও বাজতে শুরু করেছে। এবং সত্যি বলতে, ব্যাপারটা তার মোটেও ভালো লাগছে না।
পরীক্ষা শেষে অনন্যা মাঠের কোণে থাকা বেড়ার উপর নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। মূলত নোহারার অপেক্ষায়, কিন্তু ভাবনাগুলো অন্যদিকে ঘুরছে। পরীক্ষা শেষ হলেও মনের ভার কমেনি। সামনে আরেকটা টিউশনিতে ঢুকতে হবে, সেটাও মাথার ভেতর চলতে থাকা চিন্তার স্রোতে যোগ হয়েছে। নোহারা আগের দিন এক পরিচিতকে ঠিক করে দিয়েছিল, যাতে অনন্যার টিউশনির ব্যবস্থা সহজ হয়ে যায়। তবে এই টিউশনিটা নেওয়ার পেছনে কারণ আছে! অবশ্যই সেটা হলো কৌশিক স্যারের জন্য রিং কিনতে হবে। একবার ভেবেছিল, এসব বাদ দেবে। কিন্তু সেদিন স্যারের অবস্থা দেখে বুকটা হঠাৎই কেঁপে উঠেছিল অনন্যার। স্যারের ভয়ংকর অবস্থা দেখে মনে পড়ে গিয়েছিলো উনি তো মানুষ না। অনন্যা আসার আগে উনার জীবনে কি কি হয়েছে কিছুই জানে না সে। অনন্যার সেদিন হুট করেই মনে হচ্ছিল কৌশিক স্যারের সাথে থাকা প্রয়োজন, তাকে সামলানো প্রয়োজন।
শেষ পর্যন্ত সবকিছু ভুলে কৌশিক স্যারের বর্তমানটাকে মেনে নিয়েছে অনন্যা। যদিও ওইদিনের পর স্যারের সাথে আর কথা হয়নি, খুঁজেও পাওয়া যায়নি তাকে। ইউনিভার্সিটি থেকে লিভ নেওয়ার সাথে সাথে মনে হচ্ছে তিনি নিজের বাসা থেকেও হারিয়ে গেছেন। শুধু ভেনোরাকে মাঝে মাঝে দেখা যায়। ভেনোরা বাসার মধ্যেই থাকে আবার হুট করে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। ভেনোরাকে ইদানিং বেশ সন্দেহজনক মনে হয় অনন্যার কাছে। পরীক্ষার কারণে এতো দিন এসব দিকে অতোটা খেয়াল দিতে পারেনি অনন্যা। কিন্তু আজ দেখতেই হবে এই ভেনোরা প্রতিদিন কোথায় উধাও হয়ে যায়। সামনের সরু রাস্তা দিয়ে নোহারা হেঁটে আসছে। মুখটা ফুলে আছে মেয়ের।নিঘার্ত পরীক্ষায় সব দিতে পারেনি। সব এন্সার করতে না পারলে নোহারা এমন মুখ ফুলিয়ে রাখে। অনন্যা হেসে ফেললো। উঠে দাঁড়ালো। নোহারার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। নোহারা এগিয়ে আসতেই বললো,
"চল! তোকে আজ খাওয়াবো।"
"কি ব্যাঙের পরীক্ষা দিলাম। প্রশ্নও কি করছে! ছে! বেডায় মনে হয় বউয়ের লগে ঝগড়া কইরা প্রশ্ন করতে বইছে। নাহলে এসব গাধা মার্কা প্রশ্ন কে করে, ভাই?"
অনন্যা নোহারার কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দিয়ে বললো,
"বেডি! আমার ও অতো ভালো হয় নাই। পরীক্ষা শেষ এখন চিল করবি। এসব বাদ দে। টেনশন পরীক্ষার রেজাল্ট যেদিন দিবে ওইদিনই করা যাবে। বুঝছোস?"
নোহারা নিজের কাঁধ হতে অনন্যার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে রাগী গলায় বললো,
"তুই ঢং করিস না। সব সময় বলিস পরীক্ষা খারাপ হয়েছে কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট তো ভালই আসে তোর।"
" আহা! আমার যেটা ভালো হয় সেটা তো বলি। যেটা খারাপ হয় সেটাতে বলি খারাপ হয়েছে।"
"না না। তুই সবসময় বলিস ভালো হয়নি। কিন্তু পরে দেখা যায় তুই ভালো করিস।"
অনন্যা বিরক্ত হয়ে গেলো। নোহারার পিঠে চাপড় মেরে বললো,
"ঠিক আছে যা বাসায় যা।"
অনন্যা হেঁটে চলে যাচ্ছিলো। নোহারা তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
"এখন এসব বললে তো হবে না। খাওয়ার কথা বলেছিস না খেয়ে তো আমি যাবোই না।"
অনন্যা কিছু বললো না। মুখে তার মৃদু হাসি। ভার্সিটির পাশের রেস্টুরেন্টেই বসেছে দুজনে। খাবার আসতে আসতে ঢের দেরি। নোহারা ফোনের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলো,
"দুই দিন বন্ধ। কি করবি? কোনো প্ল্যান আছে?"
অনন্যা গালে হাত দিয়ে চিন্তিত গলায় বললো,
"উমম! এখনো কিছু ভাবি নি। কিন্তু ঘুম ঠিক মতো হয়নি সারা মাস না পড়ে পরীক্ষার আগে দিন পড়লে যা হয় আর কি। তাই ভাবছি বাসায় গিয়ে আগে ঘুম দিব।"
নোহারা ফিচেল হাসি হেসে বললো,
"হ্যাঁ, ঘুমা তুই। আমি ভাবছি আজকে, কালকে পার্ট টাইম থেকে ছুটি নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসবো। তুই আসলে আসতে পারিস।"
"আসতে পারতাম। কিন্তু তোর বয়ফ্রেন্ড থাকবে নিশ্চয়ই?"
অনন্যা চোখ তুলে তাকালো।
নোহারা দাঁতের বত্রিশ পাটি বের করে মাথা নাড়লো। ছোট চুলগুলো হালকা নাড়িয়ে বললো,
"হ্যাঁ! সন্ধ্যা ভাইয়াকে আগেই বুক করে নিয়েছি আমি। কয়েকদিন আগে রাগ করেছিলাম জানিস? কিন্তু লোকটা এতো পাগল আমার বাসায় এসে পড়েছে।"
অনন্যা প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে তাকালো। নোহারা সেদিনের ঘটনা ব্যক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
সেদিন নিকের সাথে কথা বলে নোহারা বাসায় এসে পড়েছিল। নিকের অবস্থা কেমন বা কী হয়েছে একবার ফিরেও দেখেনি সে। সবকিছু কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। মনে হচ্ছিল একটা অন্য দুনিয়ায় আছে সে, যে দুনিয়ায় সন্ধ্যা ব্রোর সাথে দেখা হয়েছিল নোহারার। নিকোলাই ভেস্পার শুধুমাত্র একটা ভ্রম। যা সত্যি নয়, নিছক কল্পনা। কল্পনা কী? কল্পনা এই যে যা নেই তাই তৈরি করার নাম, যা হয়না তা চোখের সামনে গড়ে তোলার নাম, যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই, তাদেরকে জীবনের একটা অধ্যায় বানানোর নাম কল্পনা। সন্ধ্যা ব্রোকেও নোহারার মনে হয় নিছক কল্পনা সে। যাকে বাস্তব জীবনে আনা সম্ভব নয়, যার সাথে সম্পূর্ণ জীবন কাটানো সম্ভব নয়, যে থাকে হৃদয়ের এক কোণে। কল্পনাকে একসময় ভুলে যেতে হয়। হয়তোবা এই নিকোলাই ভেস্পার নামক মানুষরূপী ভ্যাম্পায়ারটিকেও নোহারার ভুলে যেতে হবে।
নোহারা তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করতে গিয়েছিল, কিন্তু কেউ পেছন থেকে টেনে ধরলো। সে বিস্ময়ে এক মুহূর্ত থমকে গেল। দরজাটা বন্ধ করার জন্য চাপ দিলেও ব্যর্থ হলো। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর হাল ছেড়ে দিলো। দরজাটা আস্তে করে খুলে গেল।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীল-কালো মেশানো চুলের নিকোলাই ভেস্পার। মাথায় টুপি, চোখে পরিচিত সেই গভীরতা। নোহারা ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলো, এই সময়ে কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা হবে। এমনিতেই ব্যাচেলর মেয়ে একা দেখলেই আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষেরা কথা বলতে ছাড়ে না। তার মধ্যে যদি সাথে ছেলে দেখে তাহলে তো এলাহি কাণ্ড হয়ে দাঁড়াবে। নোহারা গলায় ভয় ঢাকতে ফিসফিসিয়ে বললো,
"এখানে কী করছো? কেউ দেখলে সমস্যা হবে!"
নিকের চোখে তখন সিরিয়াসনেস ভাব। সে স্পষ্ট গলায় বললো,
"তোমার জন্য এসেছি।"
নোহারা দ্রুত পেছাতে গিয়েও থেমে গেলো। কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
"শোনো, সন্ধ্যা ভাইয়া! এটা মজা করার সময় না। এটা বাংলাদেশ। পরিচিতি ছাড়া কেউ কারো রুমে আসতে পারে না।"
নিক কাছে এসে দরজার সামনের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
"আমার সাথে তোমার অনেক গভীর সম্পর্ক। তাই আমি আসতেই পারি।"
"না কোনো সম্পর্ক নেই। একটু আগেই তো আমি বললাম...!"
নোহারাকে কিছু বলতে না দিয়ে নিক ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলো। ফ্ল্যাটে ঢুকতেই দেখা গেলো রুমে কেউ নেই। নিক বললো,
"বাহ! কেউ তো নেই।"
নোহারা ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করলো, চারপাশটা সতর্ক চোখে খুঁজে দেখলো। ঘরটা নিস্তব্ধ, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও পারলো না, কারণ পরক্ষণেই কারো সাথে ধাক্কা খেলো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো, নিক।
নিক একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
"আমাদের সুন্দর একটা ঘর হবে, ঠিক আছে, লিটিল গার্ল?"
নোহারা যেন বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা খেলো। একদম স্থির হয়ে গেলো। কিছু বলার চেষ্টা করেও আটকে গেলো কণ্ঠ।
নিক এবার আরেকটু গভীর স্বরে বললো,
"আমি চলে গেলে তুমি খুশি থাকবে? তাহলে তাই হোক। আমি যদি নিজের যৌবন হারিয়ে বৃদ্ধ হয়ে যাই, তুমি আমাকে ভালোবাসবে? নাকি আমার রূপ-সৌন্দর্যকেই ভালোবাসো? যদি তাই হয়, তাহলে দূরেই থাকো। কিন্তু যদি আমার অন্তরকে ভালোবাসো!" (নিক এক পা সামনে এগিয়ে এলো) "তাহলে যেও না। কিছু সময় থাকি না আমরা?"
নোহারা কিছু বললো না, উল্টো ঘুরে নিকের চোখের দিকে তাকালো আর তাকিয়ে রইলো। গভীর, অন্ধকারে ডুবে থাকা চোখ দুটো হাজারো গল্পের সাক্ষী, শত শত বছরের ক্লান্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
নিক ধীরে ধীরে নোহারার গাল ছুঁয়ে বললো,
"মানুষের জীবন খুবই সামান্য, লিটিল গার্ল। আমার জীবন তেমন নয়। তাই যতটুকু সম্ভব একসাথে থাকলে কী হয়?"
নিকের গলায় ক্লান্তির আভাস, কিন্তু নিকের চোখ! একরকম আকুতি প্রকাশ করছে।
"আচ্ছা, বিয়ে করলাম নাহয়। কিন্তু আমাদের বিয়ে মানে বোঝো? হয়তো তোমার শেষ, নয়তো আমার শেষ।"
নোহারার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো, কিন্তু মুখ খুললো না সে।
"আমার শেষ মানে কী জানো? কারো সাথে প্রতিদিন থাকা মানে আমার জীবনসীমা দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। আর তোমার শেষ মানে? আমাদের বিয়ে হলেও প্রতিদিন তোমাকে সময় দিতে পারবো না। তুমি তখন কষ্ট পাবে। তারপর মাঝেমধ্যে মাথা খারাপ হয়ে গেলে তোমাকে মেরেও ফেলতে পারি।"
নিক থামলো, তারপর নোহারার চিবুকটা আলতো করে ছুঁয়ে বললো,
"এই জন্য এসব বিয়ের কথা মুখেও আনবে না, প্লিজ। আমরা চাইলেই তো এই সময়টা সুন্দর করে কাটাতে পারি। কেন বারবার বাধা আনো তুমি?"
নোহারা বললো,
"আমার খুব কষ্ট হয়।"
নিক আচমকাই নোহারাকে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত করে নোহারাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে বললো,
" কষ্ট হলে বলবে। আমি তোমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরবো।"
নোহারার কর্ণে নিকের হৃৎপিণ্ডের লাব ডাব শব্দটা বারবার ভেসে আসছে। সে ধীরে ধীরে শব্দটা কানে নিয়ে বললো,
"আর যদি কখনো আমার বিয়ে হয়ে যায়?"
"ভুলে যাবে আমাকে।"
নোহারা দ্রুত বললো,
"ভুলে যাওয়া এতো সহজ নয়। তোমার জন্য সহজ হতে পারে কিন্তু আমার জন্য তা নয়।"
নিক চিন্তিত গলায় বললো,
"আমিও এতো দ্রুত কাউকে ভুলতে পারি না, মিস!"
"তাহলে?"
"তোমাকেও আমার মতো বানিয়ে দিবো।"
নোহারা তৎক্ষণাৎ সরে উপরে তাকালো। নিক মৃদু হেসে বললো,
"হ্যাঁ! তোমাকেও আমি ভ্যাম্পায়ার বানিয়ে দেবো। ওকে?"
"কিন্তু...!"
"তাহলে দু জন একসাথে থাকতে পারবো। আর আমরা চাইলেই অনেক দিন পর পর রক্ত পান পান করতে পারবো। ওইটা কোনো সমস্যা হবে না।"
নোহারা ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
"এসব কি আজেবাজে কথা বলছো? আমি আর ভ্যাম্পায়ার?"
"হুম! এটা আমাদের জন্য খুবই ভালো একটা ডিসিশন হবে। কোনো মানুষকে যদি আমি ভ্যাম্পায়ার বানাতে পারি তাহলে অনেক দিন যাবত রক্ত পান না করেও আমি ঠিক থাকবো। আর তুমি পাবে সুস্থ জীবন। প্রায় পঁচিশ বছরের মতো রোগশোক ছাড়াই সুস্থ ভাবে জীবন কাটাতে পারবে।"
নোহারা বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
"তোমরা বেঁচে থাকার জন্য এতো মরিয়া থাকো কেনো? আমাদের তো মনে হয় মারা গেলেই মানুষ বেঁচে যায়। সামনের কতো শত প্রতিকূলতা কাটাতে হয় না। অথচ যারা বেঁচে যায় তারাই কষ্টে থাকে। সময়ের ধাপে ধাপে অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হয়। নিচে পড়ে যেতে হয়, হারতে হয়, আবার উপরে উঠার চেষ্টা করতে হয়। এসব সবসময় তো ভালো লাগে না।"
নিক হেসে বললো,
"আমাদের মতো ভিন্ন প্রাণীদের মধ্যে এক ধরনের বেঁচে থাকার অদম্য আকাঙ্ক্ষা থাকে। আমরা শুধু টিকে থাকার জন্য বাঁচি না, আমাদের অস্তিত্বকেই অর্থপূর্ণ করতে চাই। মৃত্যু আমাদের জন্য কোনো মুক্তি নয় বরং এক অনিশ্চিত অন্ধকার। আমরা জানি না, মৃত্যুর পর কী আছে, তাই আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।"
নোহারা কিছুক্ষণ নীরব রইলো। তারপর ধীরে ধীরে বললো,
"তাহলে কি ধরে নেবো, তোমাদের ভয় মৃত্যুকে নয়, বরং অনিশ্চয়তাকে?"
নিক একটু হাসলো, চোখে তার অদ্ভুত ঝলক।
"হতে পারে। আমাদের জন্য অমরত্বই একমাত্র সত্য, আর তোমাদের জন্য সময়ের সীমাবদ্ধতা। তুমি হয়তো ভাবছো, মৃত্যু মুক্তি দেয়, কিন্তু কখনো ভেবেছো, যদি সত্যিই তোমার কাছে সীমাহীন সময় থাকতো, তাহলে তুমি কী করতে?"
নোহারা অনেকক্ষণ চিন্তা করলো। তারপর হঠাৎ বললো,
"আমি অনেক কিছু করবো। মা - বাবার জন্য গ্রামে একটা বড় বাড়ি করবো। বাড়িটা শহরের মতো হবে না। গ্রামের মতো হবে। বাবা অনেক কষ্ট করে। যার দরকার একদমই ছিল না। বারবার বলি আমার কিছু লাগবে না তাও মাসে মাসে অনেক জিনিসপত্র পাঠায়। তাদের চলে না তাও পাঠাবে। আমি উনাদের জন্য অনেক কিছু করতে চাই। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। তুমি হঠাৎ করে এসে আমার জীবনটাকে উলটপালট করে ফেলেছ তাই তোমাকে শাস্তি দিতে চাই। অনেক অনেক দিনের শাস্তি দিতে চাই তোমাকে। দুজনে মিলে একসাথে ঘুরোঘুরি করতে চাই। অনেক ঘুরোঘুরি করবো, খাবো দাবো। ইন্জয় করবো। পৃথিবীটা অনেক বড় তাই না?"
নিক হাসলো। নোহারার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
"হ্যাঁ! পৃথিবী অনেক বড়। "
*******
অনন্যা ড্রয়িং রুমে বসে ছিল। ভেনোরাকে বাইরে থেকে আসতে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো। তার সামনে গিয়ে সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করে বসলো,
"স্যার কোথায়?"
ভেনোরা চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
"আমি কীভাবে জানবো? সরো সামনে থেকে।"
"তুমি স্যারের সাথে কি করেছো? সেদিন অনেক দুর্বল ছিল স্যার। কি করেছো তুমি? সত্যি করে বলো।"
"আমি আবার কী করবো?"
ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেই ভেনোরা ধাক্কা দিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
অনন্যা থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু একটা ঠিক মিলছে না, তবু পরিষ্কার নয়। কৌশিক স্যারের কোনো খোঁজ নেই অনেকদিন, আর নিকও সন্ধ্যার পর থেকে উধাও থাকে। সে তার নিজস্ব কাজে যায় এটা অনন্যা বুঝতে পারে। কিন্তু ভেনোরা? সে বরাবরই রহস্যময়।
একটা অদ্ভুত অস্বস্তি অনন্যার গলা জাপটে ধরলো। মাথার ভেতর চিন্তাগুলো দ্রুত ছুটে চলেছে। ভেনোরা নিশ্চয়ই কিছু জানে! সে কৌশিক স্যারের বন্ধু! তাছাড়া ভেনোরা হুটহাট কোথায় যেন চলে যায়। এটা জানার জন্য ভেনোরাকে ফলো করতে হবে। মেয়েটা তো আসার পর থেকেই কৌশিক স্যারের পিছু পিছু ঘুরছে। এমনকি রুমেও থাকছে এই চিন্তা করে ভেনোরা যখন আবার রুম থেকে বাইরে বের হলো অনন্যা ওর পিছু নিলো।
সময়টা সন্ধ্যার পরের ক্ষণ চলছে। ভেনোরা দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো। কয়েক বার পেছনে তাকালো দেখার জন্য কেউ তার পিছু আসছে কিনা। কিন্তু কেউ আসছে না দেখে সে আবারো হাঁটা ধরলো। অনন্যা নিঃশব্দে গা ঢাকা দিয়েছিল। ভেনোরা বেরিয়ে যেতেই গুণে গুণে দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করলো, তারপর নড়েচড়ে উঠলো। পা টিপে এগিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো সামনের চত্বরজুড়ে সিকিউরিটি গার্ডরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে কোনো অনুভূতি নেই, যেন মূর্তি।
অনন্যা কৌশলে তাদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলো। তারা শুধুই অপরিচিত কাউকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়, কিন্তু ভেতর থেকে কেউ বের হলে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না।
ভেনোরা দ্রুত পায়ে সরু পথ বেয়ে নেমে যাচ্ছে জঙ্গলের দিকে। অনন্যা অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেই অনুসরণ করছে। মাঝে মাঝে ভেনোরা হঠাৎ থেমে পেছন ফিরে তাকাচ্ছে, তখনই অনন্যা দ্রুত গাছের আড়ালে সরে যাচ্ছে।
জঙ্গলের শেষে এসে ভেনোরা থামলো। জঙ্গলের বিপরীতে রয়েছে আরেকটা ঘন জঙ্গল। ঠিক একই রকম শুধু ওই জঙ্গলের মতো রাস্তা এতো পরিষ্কার না। অনন্যা নিঃশ্বাস চেপে ধরে পেছন পেছন এগিয়ে গেল। ভেনোরা অনেক দূর যাওয়ার পর যখন মাঝামাঝি এসে দাঁড়ালো, তখনই দৃষ্টিসীমায় এলো এক তলা একটি পুরোনো দালান।
অনন্যা হতভম্ব হয়ে গেল! এখানে বাড়ি? ভেনোরা এক মুহূর্ত দেরি না করে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল। কিন্তু এখানে সিকিউরিটির কড়াকড়ি আগের চেয়েও বেশি। প্রবেশপথের দুই পাশে দুজন গার্ড স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
অনন্যা দ্রুত পা বাড়িয়ে এগিয়ে গেল, কিন্তু দরজার কাছে যেতেই এক গার্ড হাত বাড়িয়ে পথ আটকালো।
"আপনি কোথায় যাচ্ছেন?"
"ভেতরে যে মেয়েটা ঢুকলো, সে আমার পরিচিত। ওর সাথেই এসেছি।"
অনন্যা বোঝানোর চেষ্টা করলো।
গার্ডদের চোখে সন্দেহ ফুটে উঠলো। একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দ ভাষায় কথা বললো তারা, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
"ভেতরে অনুমতি ছাড়া কেউ ঢুকতে পারে না। আপনি ফিরে যান।"
অনন্যা হতাশ চোখে দালানের দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু একটা আছে এখানে, কিন্তু সেটার নাগাল পেতে হলে নতুন পথ খুঁজতে হবে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে বিপদ হতে পারে, তাই আপাতত জোর করলো না।
ধীরে ধীরে সরে এসে দালানের পাশে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রইলো।
.
.
.
চলবে........................................................................