মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৫৮ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


"Kiyan Hart, you break my heart!"

ভেনোরা বিরক্ত চোখে কৌশিকের দিকে তাকাল। কৌশিক তখনও নিচে বসে আছে, শরীর ঝিম ধরে আছে। কৌশিক মাথা নিচু করে গভীর শ্বাস নিল, নিজেকে সামলে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। পেশিগুলো টানটান, আঙুলগুলো অল্প অল্প কাঁপছে।

ভেনোরা কৌশিকের কাছ থেকে সরে আসলো, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। রাতের নরম আলোয় ভেনোরার সিল্কের পোশাক ঝলসে উঠল কিছু মুহূর্তের জন্য। ব্রাউন চুলগুলো আলতোভাবে দুলছে। অল্প আলোয় ঢাকা ঘরটিকে এক রহস্যময় পরিবেশে পরিণত করেছে।

ভেনোরা নিঃশব্দে পা টিপে এগিয়ে গেল অনন্যার দিকে। অন্ধকারের মাঝে ছায়ার মতো গলে যাচ্ছে ভেনোরার অস্তিত্ব। 

অনন্যার একটি বিশেষ গুণ রয়েছে। যখন সে গভীর ঘুমে থাকে, তখন ওর চারপাশের কোনো কিছুই মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না। আমাদের মস্তিষ্ক আসলে এক ধরনের অ্যালার্মের মতো কাজ করে। ধরুন, আপনি যদি প্রতিদিন সকাল ৭টায় ঘুম থেকে ওঠার জন্য এলার্ম সেট করেন এবং কিছুদিন পর আপনি প্রতিদিন একই সময়ে উঠতে শুরু করেন, তবে এক সময় আপনার মস্তিষ্ক নিজেই ঠিক ওই সময়ে আপনাকে ঘুম থেকে তুলে ফেলবে, কোনো এলার্ম ছাড়াই। এমনকি আপনি হয়তো এলার্মের আগে পাঁচ মিনিট আগেই সজাগ হয়ে যাবেন। অনন্যাও ঠিক এমনই। সে যখন ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার মস্তিষ্ক নিজেই গভীর ঘুমে চলে যায় এবং সহজেই জাগ্রত হতে পারে না। অবশ্য এরকমটা করতে হলে মস্তিষ্ককে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। অনন্যার এই বিষয়টা আজ ভেনোরার কাজে লাগবে।

অনন্যা বিছানায় ঘুমে আচ্ছন্ন। ভেনোরা স্থির হয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে রইল। ভেনোরার ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠলো। তারপর ধীরে ধীরে হাত উঁচু করল ভেনোরা। চোখ বন্ধ করতেই তার সংখ্যায় পাঁচ আঙুলের ফাঁক গলে ধোঁয়া ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়তে লাগল! কালচে ধূসর সেই ধোঁয়া, নিঃশব্দ, ছায়ার মতো হালকা হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।

ভেনোরা সামনের দিকে এগিয়ে এল, ধোঁয়ার কুন্ডলি মেয়েটির সারা শরীরে ছড়িয়ে দিলো, পায়ের তলা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত। রুমের বাতাসে কিছু সময়ের মধ্যেই তীব্র কিছুর গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো।

কৌশিক চোখ তুলে বললো,
"অনন্যার যাতে কিছু না হয়।"

ভেনোরা অনন্যার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
"আমি তোমার চিন্তা করছি আর তুমি কিনা অনন্যার চিন্তা করছো?"

"আমি অনন্যার সম্পর্কে জানতে চাই না কিছু।"

ভেনোরা নিশ্চুপ হয়ে রইলো। কৌশিক ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালো। ভেনোরা তখন বিছানার পাশে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসেছে, অনন্যার ওপর ঝুঁকে গেছে। আচমকা ভেনোরা নিজের ডান হাত শক্ত করে অনন্যার বাম হাতের মুঠিতে জড়িয়ে নিলো। আঙুল দিয়ে তীব্র চাপ দিলো অনন্যার হাতের মুঠোয়।

অনন্যা ঘুমিয়ে ছিল, কিন্তু ওর চোখের পাতার নিচে অক্ষিগোলক দ্রুত নড়ছে, ছটফট করছে সে। আবার হঠাৎ ই শান্ত হয়ে পড়লো। হাত পা সোজা হয়ে আছে। অনন্যাকে দেখে মনে হচ্ছে সে গভীর কোনো অন্ধকার জগতের ভিন্ন গল্পে আটকে পড়েছে। কৌশিক এবার বাধ্য হলো উঠে দাঁড়াতে। দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে এসে ভেনোরার হাত টেনে ধরলো, শক্ত করে টান দিলো ভেনোরাকে থামানোর জন্য। কিন্তু ভেনোরা নড়লো না।
সে চোখ বন্ধ রেখেই কার্যক্রম চালিয়ে যেতে লাগলো, নিঃশ্বাস প্রচন্ড ভারী এবং শরীর শক্ত হয়ে আছে তার।

কৌশিক এবার আরো জোরে ধাক্কা দিলো, ভেনোরাকে টেনে সরাতে গিয়ে বললো,

"আমি থামতে বলেছি, ভেনোরা! থামো তুমি।"

ঠিক এক মিনিট পর, ভেনোরা হঠাৎ হাত ছেড়ে দিলো। তার হাত থেকেও কৌশিকের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে ফেললো। ভেনোরার মুখমণ্ডলে একরাশ বিস্ময় ছড়িয়ে আছে, চোখের মণিতে অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনা ঘুরঘুর করছে।

ভেনোরা ধীরে ধীরে পেছনে সরে গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। নিজেই নিজের দেখা বিষয়বস্তু হজম করতে পারছে না মনে হলো। আতংকিত অনুভব করছে সে।

কৌশিক এবার কড়া গলায় বললো,

"যাও, বেরিয়ে যাও।"

ভেনোরা কিছুক্ষণ অনড় থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে চোখ ফিরিয়ে কৌশিকের দিকে তাকালো। জোর গলায় বললো,
"অনন্যা! শী ইজ সামথিং এলস!"

কৌশিক ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
"মানে?"

ভেনোরা গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

"আমি অদ্ভুত কিছু দেখেছি, কিয়ান। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অনন্যা তোমার জন্য বিপজ্জনক।"

কৌশিক বিস্মিত হয়ে বললো,

"কি সব আজেবাজে কথা বলছো!"

ভেনোরা এক পা এগিয়ে এল, বলতে লাগলো,
"শোনো, অনন্যার ভেতরে দুটো সত্তা রয়েছে। একদিকে, অনন্যা তোমার ভালো চায়, তোমাকে ভালোবাসতে চায়, তোমার শরীরে উষ্ণতা এনে দিয়েছে, তোমাকে ঘুমোতে সাহায্য করেছে। কিন্তু অন্যদিকে, অনন্যার মধ্যেই আবার এমন কেউ আছে যে তোমার ক্ষতি করতে চায়, তোমাকে শেষ করে দিতে চায়।"

ভেনোরা থামলো কৌশিকের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলো।

তারপর গলা নিচু করে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলো,
"অবশ্যই, তুমি যার কথা ভাবছো, সেই পরিচিত শত্রু। প্রিন্সেস আরিসা নেভুনিকা।"

কৌশিক তো কিছুই বুঝতে পারছে না।

ভেনোরা ধীরে ধীরে বললো,

"একই শরীরে দুই সত্তা। অনন্যা আর আরিসা।"

কৌশিক বিরক্তের সাথে বললো,
"এটা কীভাবে সম্ভব? তোমার মাথা ঠিক নেই মনে হয়।"

"উঁহু, না। অনন্যা আমাদের মতোই সাধারণ একজন মানুষ। তবে সাধারণ হয়েও সে নিজের দেহে আরেকজনকে বহন করে চলছে, অথচ অনন্যা নিজেই তা জানে না।"

ভেনোরা এক নিশ্বাসে বলে গেল। কৌশিক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু ভেনোরা থামেনি।

"প্রিন্সেস আরিসা নেভুনিকার অভিশপ্ত আত্মা, হয়তো সে বহুদিন ধরে কোনো বিশুদ্ধ দেহ খুঁজছিল! একটি শক্তিশালী, নির্দোষ শরীর, যেখানে সে আশ্রয় নিতে পারবে। আর শেষমেশ, সে অনন্যাকে পেয়ে গেল।"

ভেনোরা গভীর দৃষ্টি মেলে অনন্যার দিকে তাকালো।

"তুমি কি অনন্যার জন্মের কোনো রহস্য জানো? বা তার জীবনে এমন কিছু ঘটেছে যা অন্যদের থেকে আলাদা?"

কৌশিক কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো, মাথার ভেতরে কোনো স্মৃতি জেগে উঠছে তার। আচমকা এগিয়ে এসে বললো,
"হ্যাঁ! কয়েকদিন আগে অনন্যার মা বলছিলেন অনন্যা জন্মের সময় মারা গিয়েছিল। তারপর কিছুক্ষণ পর সে আবার জেগে ওঠে! তার কান্নার চিৎকারে পুরো হাসপাতাল স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সবাই ধরেই নিয়েছিল, অনন্যার জীবন সেদিনই শেষ। কিন্তু তা হয়নি।"

ভেনোরা হাতে তালি বাজিয়ে বললো,
"ঠিক ধরেছি! জন্মের সময় অনন্যার দেহ ভীষণ দুর্বল ছিল, সে মরতে বসেছিল। কিন্তু প্রিন্সেস আরিসা! সে একটা আশ্রয় খুঁজছিল। অনন্যার শরীর সে নিজের করে নিলো, আর বিনিময়ে অনন্যাকে বাঁচিয়ে দিলো।"

কৌশিক কিছুক্ষণ চুপ রইলো। আচমকা রাগান্বিত গলায় বললো,
"ইজ ইট পসিবল? ওয়ান বডি টু সোউল? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এসব মনগড়া কাহিনী বলা বন্ধ করো।"

"প্রিন্সেস আরিসা বারবার তোমাকে মারতে চায় কিন্তু পারে না। পুনর্জন্ম নিয়েও লাভ হয়নি। কারণ সে তোমার শেষ তখনই করতে পারবে যখন তুমি ভুল কিছু করতে বসবে। কিন্তু প্রিন্সেস আরিসার জন্ম হওয়ার পর এই ভুবনে তোমার মারাত্মক ভুল তার চোখে পড়েনি, তাই কোনো বারই প্রিন্সেস আরিসার পুনরায় জন্মগ্রহণের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়নি। এজন্যই তিনি এখন দ্বিতীয় পথ বেছে নিয়েছে। মৃতপ্রায় দেহের মধ্যে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে আরিসা একদিক দিয়ে তোমাকে শেষ করে দিতে চায়, ধীরে ধীরে বড় কোনো সংঘর্ষের পথে ঠেলে দিতে চায় বা দিচ্ছে। আর সেটা হচ্ছে অনন্যার মাধ্যমে। হ্যাঁ অনন্যাই একমাত্র মাধ্যম যার কারণে তোমার এই পরিবর্তন হচ্ছে।"

কৌশিক কিছুক্ষণ চুপ থাকল, বিষয়টা তার মাথায় ঢুকছিলো না। ভেনোরা শান্তভাবে নিজের কথা বলে গেলো,

"অনন্যা তোমাকে ভালোবাসতে চায়, কিন্তু প্রিন্সেস আরিসা তোমাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তোমার শরীরে খারাপ প্রভাব ঢেলে দিচ্ছে। তোমাকে অনন্যার প্রতি নরম বানিয়ে ব্যবহার করছে। তাই কিয়ান, দ্বিতীয়বার এই ভুল করো না। তুমি যদি একবার এই দুনিয়ায় ক্ষতি করা শুরু করে দিয়েছো, তাহলে প্রিন্সেস আরিসা জাগ্রত হবে। আর তোমাকে শেষ করে ফেলবে। এমনকি অনন্যার থেকেও দূরে থাকতে হবে তোমার।"

কৌশিক হেসে ফেললো। হাত নাড়িয়ে বললো,
"আমি কি এই দুনিয়ার ক্ষতি করিনি? সেই কবে থেকে মানুষের শক্তি খেয়েই তো বেঁচে আছি আমি! এটা কি দুনিয়ার ক্ষতি হচ্ছে না? তাহলে তখন কেনো শেষ করলো না? আর আমার মনে হচ্ছে তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। অনন্যা কীভাবে?"

কৌশিক শেষ করতে পারলো না। ভেনোরা বললো,
"শোনো! তুমি বলেছিলে নদীর মধ্যে তুমি অনন্যার আশেপাশে গোলাকার বলয় দেখেছিলে।এটা আসলে প্রিন্সেস আরিসার তৈরি ছিল। তিনি রক্ষা বলয় সৃষ্টি করে অনন্যাকে বাঁচাতে চেয়েছেন। অনন্যা যদি মারা যায় তাহলে তিনি আর অনন্যার সাহায্যে উনার কাজ চালাতে পারবে না। যতদিন না উনি নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করছেন অনন্যার দেহেই থাকবেন তিনি। তুমি বলেছিলে অনন্যা আর্চেরি পারে না। হ্যাঁ অনন্যা আর্চেরি পারে না। পারে হচ্ছে আরিসা। হয়তো আর্চেরির ধনুক হাতে পেয়ে অনন্যার হাতে প্রিন্সেসের কন্ট্রোল এসে পড়েছিল। অনন্যা না চাইতেও প্রত্যেক বার প্রতিটি জিনিস নিখুঁতভাবে করে যাচ্ছিলো।

আমার মনে হয়, প্রিন্সেস আরিসার জিনিসপত্র যা আছে তা যদি অনন্যার হাতে চলে যায় তাহলে সে পুরোপুরি জাগ্রত হবে। আর তোমাকে শেষ করার জন্য আরো মরিয়া হয়ে উঠবে।"

কৌশিক চোখ ঘুরিয়ে অনন্যার দিকে তাকালো। কেমন নিশ্চুপ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। শ্যামলা মুখশ্রীতে আলো পড়ে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে , মিষ্টি এই চেহারার মাঝে যে একটা বিষাক্ত মানুষ লুকিয়ে আছে যে তাকে বহু বছর ধরে শেষ করতে চাইছে তা বোঝার দায় নেই। কৌশিক হেসে ফেললো। খুব জোরে হাসলো। ভেনোরা বুঝতে পারলো না কৌশিক কেনো হেসে যাচ্ছে।

কৌশিক বললো,
"আমি শেষমেশ ঠিক জায়গাতেই আটকেছি।"

ভেনোরা বিস্ময়ের সাথে উচ্চারণ করলো,
"কি বলছো?"

" বুঝলাম প্রিন্সেস আরিসা আমাকে নিজের হাত করেই ফেললো। কিন্তু বেশি সময় নিয়ে নিয়েছে সে। "

ভেনোরা এগিয়ে বললো,
"কিয়ান! এই মেয়েটাকে তুমি বাড়ি থেকে বের করে দিবে।"

কৌশিক মাথা নাড়িয়ে বললো,
"না! অনন্যা বলেছে ও আমাকে অন্ধকার থেকে আলোতে আনবে। আমি এর শেষ দেখতে চাই। দেখতে চাই কীভাবে অনন্যা অথবা আরিসা তার জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ করে।"

"তুমি এখনো সম্পূর্ণ ঠিক হওনি কৌশিক। তাই এসব ভাবনা চিন্তা বাদ দাও।"

কৌশিক ভেনোরার হাত ধরে তাকে বাইরে নিয়ে গেলো। ধীরে সুস্থে অনন্যার রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেনোরার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পর বললো,
"আমি সম্পূর্ণ ঠিক হয়ে যাবো। তুমি ঠিক করে দেবে এটা আমার বিশ্বাস! এর জন্য আমাকে কষ্ট সহ্য করতে হবে। ঠিক আছে তাও করলাম। কিন্তু লাভ কী? যদি একদিন ধ্বংসের পথেই হাঁটতে হয়। এতো এতো বছর পর আমার লুকানো হৃদয়টা অনুভব করতে বুঝে ছিলো। অনন্যার প্রতি ধীরে ধীরে ঝুঁকে যাচ্ছিলো। আর হঠাৎ ই জানলাম অনন্যাই আমার শেষ টানবে। যাকে খোঁজার জন্য আমি এবং আমরা বাংলাদেশ এসেছিলাম। সে আমার সামনেই আছে। অথচ আমি চিনতেই পারিনি। এর থেকে খুশির খবর কী হতে পারে? আমি লোভ করেছি অনেক। অতি দীর্ঘ সময় বাঁচার লোভ , অনেক অনেক জ্ঞান আহরণ করার লোভ, সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখার লোভ এর বিপরীতে মানুষ জাতিকে শেষ হতে হয়েছে। অবশ্যই এই লোভের শেষ কোথাও না কোথাও হতে হবে। তাই শেষ লোভ আরেকটা করেই ফেললাম নাহয়। ওই যে ওই মেয়েটাকে ভালোবাসার লোভ।"

কৌশিক মৃদু হেসে স্থান ত্যাগ করলো, কিন্তু ভেনোরা কৌশিকের এই হাসিতে কোনো আনন্দ অনুভব করতে পারলো না। ভেনোরার বুকের মধ্যে এক অজানা ব্যথা সূচালো ভাবে বিঁধলো, চিনচিনে শূন্যতা, যা তাকে স্তব্ধ করে দিলো। কৌশিককে সে বহু বছর ধরে চেনে, তবে আজকের পরিবর্তনটা একদম নতুনভাবে চোখে ধরা দিলো।

ভেনোরা নীরবে তাকিয়ে রইলো। কৌশিকের ধীরে ধীরে পরিবর্তন তার চোখে লাগছে। মানুষদের মতো আচরণ করা শুরু করেছে কৌশিক।যে একসময় বলতো আবেগ, ভালোবাসা সব মানুষের জন্য। আজ সেই এসব ভালোবাসায় বিশ্বাসী হয়ে পড়লো? তাহলে অনন্যা কি তাকে বদলে ফেলছে? এ প্রশ্নটা ভেনোরার মনে ঘুরতে লাগলো।

মনে হলো, কৌশিকের মধ্যে কোনো এক গহিন অন্ধকারে যে আলো ছিল, সেটা এখন ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু সেটা কি ভালো, না খারাপ? নাকি চোখের সামনে ভেসে ওঠা অনন্যা রূপী আরিসা কৌশিককে খুব দ্রুতই শেষ করে দিতে আসছে।

******

নোহারা বেঞ্চে নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিল, শূন্য মাঠের নিরবতা মাঝে মাঝে কুকুরের হালকা ডাক দিয়ে ভেঙে যাচ্ছিল। নিক নোহারার দিকে হেঁটে এসে পানির বোতল এগিয়ে দিলো। বসলো নোহারার পাশে, একদম গা ঘেঁষে। নোহারা পানির বোতল খুলে কিছুটা পানি পান করে রেখে দিলো। আবার তাকিয়ে রইলো খুব দূরে যেদিকে চোখ যায়। 
নিক আস্তে আস্তে তার গলা জড়িয়ে ধরলো,
"কী ভাবছো, লিটিল গার্ল?"

নোহারার মাথা একদম নিকের গায়ে সাথে লেগে গেছে। নোহারা চোখ বড় বড় করে ফেললো। নিজেকে ছাড়াতে চাইলো। কিন্তু নিক ছাড়লো না। নোহারা’র গালে একটি নরম, মিষ্টি চুমু বসিয়ে দিলো। নোহারা এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেলো। ঝটপট দূরে সরানোর জন্য নিকের পেটে কনুই দিয়ে গুঁতা দিয়ে বললো,
"সবসময় এসব ভালো লাগে না।"

নিক তার বাঁধন আলগা করলো।
"তোমার মুড খারাপ মনে হচ্ছে। কি হয়েছে?"

নোহারা নিকের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
"একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরে বিয়ে করা জরুরি। জানো?"

নিক ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
"বিয়ে?"

"হু!"

"এখনকার দিনে এসব বিয়ে টিয়ে কে করে? আর বিয়ে করেও লাভ কী? সম্পর্ক তো তাও টিকে না।"

"বিয়ে হচ্ছে একটা পবিত্র বন্ধন, যেখানে বাধা পড়লে একে অপরের কথা চিন্তা করা জরুরি হয়ে পড়ে। এটা শুধু দুজন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা নয়, বরং দায়িত্ব, কর্তব্য পালন। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতি থাকা প্রয়োজন। সম্পর্ক টিকবে কি না, সেটা শুধুমাত্র ভালোবাসা দিয়ে নয়, পরস্পরের বিশ্বাস এবং সহ্যশক্তি দিয়ে গড়ে ওঠে।"

"আমাদের বিয়ে করার দরকার কী? আমরা তো এভাবেই ভালো আছি। তাছাড়া আমার মনে হয় না বিবাহিত জীবনে আমরা সুখী থাকবো।"

"এটা আমিও ভাবছি‌। আমার বান্ধবী অনন্যা যখন বললো ওর জামাইয়ের অনেকগুলো বউ। এটা জেনে ও খুব কষ্ট পাচ্ছিল। কিন্তু তখন আমি স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তখন আমি স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলাম কথাটা। কিন্তু এখন আমাদের সম্পর্ক বিবেচনা করলে দেখা যায় বিষয়টা খুবই কষ্টদায়ক। তাও তো অনন্যার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু আমাদের বিয়ে কখনো সম্ভব নয়। তুমি দিনের বেলা বের হতে পারো না। শুধু রাতের দিকে কেমন চোরের মত ঘুরে বেড়াও। একদিকে তো তুমি বিয়ে করবে না। অন্যদিকে আমি তোমাকে নিজের পরিবারের সামনে দাঁড় করাতে পারবো না।"

নিক নোহারার মুখ নিজের দিকে ঘোরালো। আরো কাছে টেনে নিয়ে শুধালো,
"কে বলেছিল আপনি পছন্দ করতে থাকবেন, আমি ভালোবাসতে থাকবো? নোহারা! তুমি নিজেই নিজের পথ বেছে নিয়েছ। বুঝলে? কেউ তোমাকে জোর করেনি আমিও করিনি। এখন যদি এসব বলতে আসো আমার কিন্তু মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে।"

নোহারা হেসে বললো,
"এর অর্থ আমার যদি কোনো দিন বিয়ে হয়ে যায় তুমি একটুও কষ্ট পাবে না ?"

নিক স্থির হয়ে গেল। নোহারা আবারো বললো,
"হ্যাঁ, খুশি তো হবেই। তুমি তো শুধু পছন্দ করতে। ভালো তো আমি বাসতাম তোমাকে।"

নিক নোহারার কোমর চেপে ধরল দুই হাত দিয়ে। মেয়েটার পা নিজের পায়ের মাঝে পেঁচিয়ে ধরে বললো,
"তোমার বিয়ে হলে তো।"

"তুমি কিছুই করতে পারবে না।"

নিক নোহারার মুখ চেপে ধরে বললো,
"কেনো লিটিল গার্ল? অবশ্যই করবো। সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে আসবো।"

"দিনের বেলা বিয়ে করবো।"

নিক নোহারার মুখ এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বললো,
"দিনের বেলায় ই যাবো।ভস্ম হলে হয়ে যাবো।"

"কিন্তু তাও আমায় বিয়ে করবে না?"

নিক নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। দুই দিকেই তার বিপদ। নোহারাকে বিয়ে করলে তার জীবনটা এখনকার দিনের মতো সাধারণ হবে না। সে প্রতিদিনের মতো স্বাধীন জীবন কাটাতে পারবে না। আবার বিয়ে না করলেও নোহারাকে অন্যের সাথে দেখতে পারবে না। নোহারা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। কঠোর গলায় বললো,
"আমি ভালোবাসতে থাকবে, তুমি না হয় শুধু পছন্দই করো।"
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp