আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস - পর্ব ০১ - আতিয়া আদিবা - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন আতিয়া আদিবা'র লেখা একটি ধারাবাহিক গল্প আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস'এর ১ম পর্ব
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস

অংক কষার ফাঁকে ইচ্ছা করে স্যারের পায়ের সাথে নিজের পা ঠুকে দিলো রায়া। কান্ড ঘটিয়ে নিজেই এমন ভাবে চমকে উঠলো যেনো মনের অজান্তেই এই ঠুকার বিষয়টি ঘটে গেছে। সে ব্যস্ত হয়ে বললো,

‘সর‍্যি স্যার। ভুলে লেগে গেছে।’

অভ্র জানে কাজটি রায়ার ইচ্ছাকৃতভাবে করা। ‘ভুলে লেগে গেছে’ কথাটি বাহানা ছাড়া কিছুই নয়। তবুও সে বললো,

‘সমস্যা নেই। অংকটা শেষ করে ফেলো।’

রায়া মুখ গোঁজ করে অংক কষতে লাগলো। সাব্জেক্টটি সে দুচোখে সহ্য করতে পারে না। অথচ এই সাব্জেক্টটাই গলার কাঁটার মতো তার জীবনে বিঁধে আছে। কোনোভাবেই নামছে না। রায়া এস এস সি পরীক্ষার্থী। গত দুই বছর ধরে সে টানা এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই পাশ করতে পারছে না। বারবার এই একটা সাবজেক্টেই ফেল করে, গণিতে। মেয়েটা অংকে ভীষণ কাঁচা। শহরের প্রভাবশালী ব্যক্তি নুরুল আলমের একমাত্র কন্যা রায়া। তাকে অংকে উতরিয়ে দেওয়ার জন্য কম চেষ্টা করা হয়নি। শহরের সবচেয়ে নাম করা অংক শিক্ষকদের তাকে পড়ানোর জন্য বাসায় নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই মেয়েটা পনেরো এর ওপর নম্বর পায় না। পশ্চিমের সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক আফজাল আলীকে শহরের সবাই অংকের বাঘ বলে ডাকে। তার তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ পাঁচ মাস পড়লো রায়া। আফজাল আলী প্রথম দিন পড়াতে এসেই রায়ার হাতে নতুন রুটিন ধরিয়ে দিলো। সেখানে লিখা 'দুপুরে খাওয়ার আগে এক ঘন্টা এবং খাওয়ার পর দুই ঘন্টা অংক করতে হবে। রাতে ঘুমানোর আগে দুপুরের অংকগুলো রিভিশন দিতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অংকের সূত্র গুলোয় চোখ বুলিয়ে নিতে হবে।' এত কিছু করেও বিশেষ কোনো লাভ হলো না। ফলাফল- যাহা লাউ তাহাই কদু টাইপ। টেস্টে রায়া নম্বর পেলো ‘পাঁচ’। আফজাল আলী তার পরের দিনই নুরুল আলমকে গম্ভীর মুখে চিঠি লিখতে বসে গেলেন। চিঠির সারমর্ম হলো, এই মেয়েকে সে কোনোভাবেই পড়াতে পারবে না। শহরে তার অন্যরকম নাম ডাক রয়েছে। তাকে সবাই আলাদা চোখে দেখে। তার কাছে পড়েও যদি রায়া অংকে ফেল করে তাহলে উনার সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকবে?

নুরুল আলম পড়ে গেলেন মহা বিপদে। টাকা পয়সা কিছু দিয়ে মেয়েকে টেস্ট পরীক্ষায় পাশ করানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু বোর্ড পরীক্ষায় তো এসব চলবে না! এবার ফেল করলে মেয়ের পড়াশোনাই না বন্ধ হয়ে যাবে। অবশেষে নুরুল আলমের দোকানের ম্যানেজার অভ্রের খোঁজ এনে দিলো। ছেলেটি তার পরিচিত। সম্পর্কে ভাইগ্না লাগে। মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ফিজিক্সে অনার্স করছে। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনিও করে। নুরুল আলম প্রথম দিনই অভ্রকে ভদ্র ভাষায় সাবধান করে দিয়েছেন।

“শোনো বাছাধন! শিক্ষক হলো পিতার সমতুল্য। আমার মেয়েকে নিজের মেয়ে বলে মনে করবে। তাকে যত্ন নিয়ে পড়াবে। একটু দেখো টেনেটুনে ম্যাট্রিকের গন্ডি পার করাতে পারো কিনা!”

অভ্র অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। হিসাব অনুযায়ী রায়ার এবার ইন্টার পরীক্ষা দেওয়ার কথা। যেহেতু পরপর দুবার ফেল করেছে তাই এখনো হাইস্কুলে আটকে আছে। তাই বলে তো আর এটা নয় যে মেয়ের বয়সও আটকে আছে! এই মেয়ে অভ্রের চেয়ে খুব বেশি হলে বছর তিনেক ছোট হবে। তাকে মেয়ের চোখে কিভাবে দেখবে? বোনের চোখে দেখার কথা বললেও কিছুটা যুক্তিসংঙ্গত মনে হতো বটে! তবুও নিজের সীমার মধ্যে থেকে রায়াকে পড়ানো শুরু করে অভ্র। কিন্তু রায়া সেই সীমা অতিক্রম করার প্রবল চেষ্টায় আছে। অভ্রকে সে শিক্ষকের চোখে দেখে না। তার কাছে অংক করতেও ভালো লাগে না। তবে গল্প করতে বেশ ভালো লাগে। ইচ্ছে করে পায়ে খোঁচা দিতেও ভালো লাগে। বিশেষ করে স্যারের পায়ে খোঁচা দেওয়ার পর তার মুখাবয়ব হয় একদম দেখার মতো! কেমন যেনো চুপসে যায়। কল্পনায় স্যারকে নিয়ে ভাবতেও তার ভালো লাগে। অবশ্য সেখানে মানুষটি তার অংক স্যার হয়ে আসে না। আসে প্রেমিক পুরুষ হয়ে। আষাঢ়ের প্রবল বৃষ্টিতে ফাঁকা রাস্তায় ভিজে ভিজে। হাতে থাকে একগুচ্ছ কদম। রায়া পাশের বন্ধ টং এর চালের নিচে দাঁড়িয়ে অভ্রের জন্য অপেক্ষা করে। ওকে কাকভেজা অবস্থায় দেখতে পেয়েই শাড়ির আচল দিয়ে চুলগুলো মুছে দেয়। এক পর্যায়ে অভ্র তার সাথে আরো ঘনিষ্ট হয়। রায়া খুব কাছ থেকে অভ্রের উত্তপ্ত নিশ্বাসের গন্ধ পায়। এর বেশি কিছু সে চিন্তা করতে পারে না। শরীর কেঁপে ওঠে। কল্পনার জগত থেকে বাস্তবতার জগতে ফিরে আসে। রায়া অংকের খাতা স্যারের দিকে এগিয়ে দিলো। খাতা দেখতে দেখতে অভ্রের কপালে ভাঁজ পড়লো। মুখ সুঁচালো করে বললো,

‘এতক্ষণ ধরে এটা কি করেছো তুমি?’

‘অংক করেছি।’

‘সেটা তো জানি। কিন্তু কি অংক করলে? সূত্র ভুল কেনো?’

রায়া মুখে তালা দিয়ে বসে রইলো। অভ্র রাগী গলায় বললো,

‘এ প্লাস বি হোল স্কয়ার এর সূত্র কি?’

রায়া এবারো কোনো উত্তর দিলো না। অভ্র ধমক দিয়ে উঠলো,

‘চুপ করে থাকবে না। উত্তর দাও।’

রায়া কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,

‘জানি না।’

অভ্র গলার স্বর যতটুকু সম্ভব কঠিন করে বললো, ‘গতকাল যখন অংক করাচ্ছিলাম মন কই ছিলো তোমার? কথা কি এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যকান দিয়ে বের করে দাও? পড়াশোনা করার ইচ্ছা না থাকলে সোজাসুজি বাবাকে গিয়ে বলো। তার টাকাগুলো জলে ফেলার কোনো মানে হয় না। আমি এভাবে তোমাকে পড়াতে পারবো না।’

রায়া এবার কেঁদে ফেললো। তার ঠোঁটদুটো তিরতির করে কাঁপছে। অভ্র একবার ভাবলো নরম গলায় দু একটা কথা বলবে কিনা! পরক্ষণেই নিজের মত পাল্টালো। থাক একটু কান্না করুক। বড়লোক বাপের মেয়েরা কাঁদলে সুন্দর লাগে। রায়া এমনিতেই সুন্দরী। কাঁদার জন্য তাকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। অভ্রের মতো খুবই সাধারণ ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কোনো ছেলে বড়লোক বাপের একমাত্র কণ্যাকে এভাবে কাঁদাচ্ছে এটা ভেবেই তার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। অভ্র একবার ভাবলো উঠে চলে যাবে। কিন্তু উঠে চলে গেলে রায়ার কান্না সে দেখতে পারবে না। এমন দৃশ্য যদি আর কখনো দেখার সৌভাগ্য না হয়? অভ্র রায়ার সামনে বসে রইলো। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার হেঁচকি উঠে গেছে। অভ্র শান্ত গলায় বললো,

‘গতকাল যে কয়টা সূত্র লিখে গিয়েছিলাম সেগুলো এখুনি খাতায় পাঁচবার করে লিখবে। আমার সামনে লিখবে।’

রায়া খাতায় সূত্রগুলো লিখা শুরু করলো। অভ্র দেখলো চোখের পানিতে খাতার উপরের অংশ ভিজতে শুরু করেছে। মেয়েটাকে একটু শান্তনা দিয়ে কান্না থামাতে বললেই সে হয়তো কান্না থামিয়ে ফেলবে। কিন্তু অভ্র সেটা চাইছে না। মেয়েটা কাঁদুক। কাঁদলে চোখ পরিষ্কার হয়।

পর্ব ০২ →

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন