আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস - পর্ব ০২ - আতিয়া আদিবা - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন আতিয়া আদিবা'র লেখা একটি ধারাবাহিক গল্প আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস'এর ২য় পর্ব
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস

রায়ার বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে কিছুদূর এগোতেই অভ্রের ফোন বেজে উঠলো। স্মার্টফোনের যুগে তার হাতে নকিয়া এগারোশো। এই ফোনটি সে ব্যবহার করছে ভার্সিটিতে ওঠার পর থেকে। বার কয়েকশো হাত ফসকে বাটন ফোনটি পরেও গিয়েছে। কিন্তু ফোনের গায়ে সূক্ষ্ম আঁচড় ছাড়া কিচ্ছু লাগে নি। অভ্র মনে করে, এই ফোনের প্রাণ কৈ মাছের প্রাণের মতো। আরো কয়েকশো বার হাত ফসকে পড়বে, কিন্তু মৃত্যুবরণ করবে না। ব্যাটারি ঢিলে হয়ে ফোন অফ হয়ে যাবে। কিন্তু ডান দিকের বাটন চাপলেই সেই চিরচেনা ‘টিং টিটি টিং’ শব্দে দুটো হাত হ্যান্ডশেক এর জন্য এগিয়ে আসবে। ফোন বেজেই চলেছে। অভ্র ফোন রিসিভ করলো। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অপর পাশ থেকে মেয়েটা ফুঁপিয়ে বলে উঠলো,

‘আমাকে ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছে।’

অভ্র শান্ত গলায় বললো,

‘সেতো দুই দিন পর পরই আসে। কাঁদার কি আছে?’

‘তারা আজই আমার বিয়ে পড়িয়ে ফেলতে চাইছে।’

‘মানে?’

‘এত কিছু খুলে বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই আমি অভ্র। প্লিজ তুমি কিছু একটা করো।’

‘আমি কি করবো?’

‘তুমি এখন কোথায় আছো?’

‘পোস্ট অফিসের সামনে।’

‘তুমি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। এক পাও নড়বে না। আমি এখুনি আসছি।’

লাইন কেটে গেলো। টুট টুট শব্দ হচ্ছে। অভ্র ফোন কানে ধরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। যে মেয়েটার সাথে তার মাত্র ফোনে কথা হলো তার নাম রুদালি। মেয়েটাও অভ্রের সাথে একই ভার্সিটিতে পড়ে। তবে এক ব্যাচ জুনিয়র। গত দুবছরে তাদের প্রেমের সম্পর্ক বেশ পোক্ত হয়ে গেছে। সবকিছু ভালোই চলছিলো। কিন্তু কয়েকমাস ধরে মেয়ের বাবা রহমান সাহেব রুদালির বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন। একেকদিন একেক ছেলের ছবি নিয়ে মেয়ের সামনে হাজির হন। মাসে অন্ততপক্ষে দুবার ছেলের বাড়ির লোকজন আসে রুদালিকে দেখতে। কিন্তু প্রতিবারই রুদালি বিয়ে ভেস্তে দিয়েছে। এই কাজটি সে করেছে খুবই ঠান্ডা মাথায়। একবার পাত্রের সাথে রুদালিকে আলাদাভাবে কথা বলতে পাঠানো হলো। একথায় সেকথায় রুদালি জিজ্ঞেস করলো,

‘আপনি সিগারেট খান?’

ছেলে উত্তর দিলো,

‘না। আমি কোনোপ্রকার নেশা করি না। যারা নেশা করে তাদেরও ঘৃণা করি।’

রুদালি তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বললো,

‘যারা সিগারেট খায় না তাদের আমার পুরুষ মানুষ বলেই মনে হয় না! তাছাড়া জামাই সিগারেট না খেলে আমি সিগারেট খাবো কার সাথে?’

‘বলেন কি? আপনি সিগারেট খান?’

‘জ্বি খাই তো! ফুড়ফুড় করে ধোঁয়া ছাড়ি। আপনি দেখবেন? দেখতে চাইলে দেখাবো। তবে একটা শর্ত আছে। একথা কিন্তু বাবাকে বলা যাবে না। আপনার আর আমার মধ্যে গোপন রাখতে হবে। ভেরি সিক্রেট।’

পাত্র পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে বললো,

‘না মানে কিভাবে দেখাবেন? আপনার কাছে এখনো সিগারেট আছে নাকি?’

রুদালি এদিক সেদিক তাকিয়ে পাত্রকে ইশারায় কাছে ডাকলো। নিচু গলায় বললো,

‘আছে। ব্যাগে। ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা আমার জন্য আলাদা ভাবে সিগারেট কিনে আনে। ক্যাম্পাসে তো খাওয়া যায় না। মেয়ে মানুষ বলে কথা। বাসায় লুকিয়ে খাই।’

পাত্র হতভম্ব হয়ে রুদালির দিকে তাকিয়ে রইলো। পরের দিন পাত্রপক্ষ রহমান সাহেবকে ফোন করে সোজাসুজি জানিয়ে দিলেন, এই বিয়েতে তারা আগ্রহী না।

আরেকবার পাত্রকে রুদালি ভয়ংকর একটি প্রশ্ন করে বসলো।

‘আপনি ব্লু ফিল্ম দেখেন?’

প্রশ্ন শুনে পাত্র বিষম খেলো। এ কেমন মেয়েরে বাবা? লাজ লজ্জা নেই নাকি? মেয়ে মানুষ কখনো এজাতীয় প্রশ্ন করে? বহু কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে সে বললো,

‘জ্বি না। এসব পচা জিনিস আমি দেখি না। চোখের জ্যোতি নষ্ট হয়।’

‘ইসসি রে! মিস করে ফেলেছেন। বিরাট মিস। জীবনের অর্ধেক স্বার্থকতা আপনার এ জায়গাতেই শেষ।’

পাত্র চোখ বড়বড় করে বললো,

‘আপনি দেখেছেন?’

‘স্কুলে থাকতেই দেখেছি। আমার এক বান্ধুবীর এন্ড্রোয়েড ছিলো। ওর বাবা অনেক বড়লোক তো! দেশের বাইরে থেকে এন্ড্রোয়েড আনিয়েছিলো। এখন তো আমার নিজেরই এন্ড্রোয়েড আছে। বান্ধুবীর প্রয়োজন পরে না।’

কনে দেখার বাকি সময়টুকু পাত্র মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিলো। পরেরদিন অজ্ঞাত কারনে পাত্রপক্ষ বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। রুদালি জানতো এভাবে সে বেশিদিন নিজের বিয়ে আটকিয়ে রাখতে পারবে না। তার বাবা হয়তো কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছেন। তাই পাত্রের সাথে এবার তাকে আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয় নি। সরাসরি বিয়ে পড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অভ্র এখনো পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনটা বাজে। কিছুক্ষণ আগেও রোদে সবকিছু ঝলসে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করেই আবহাওয়া বদলে গেছে। কোথা থেকে যেনো কালো মেঘগুলো এসে জড়ো হয়েছে অভ্রের মাথার ওপর। কিছু সময়ের ব্যবধানে নিশ্চিত বৃষ্টি নামবে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অভ্রের পা ব্যাথা করছে। রাস্তার এখানে সেখানে কিছুক্ষণ আগেও মানুষজনের জটলা ছিলো। বৃষ্টির আগমনী বার্তা পেয়ে তারা চলে গেছে। পুরো রাস্তা ফাঁকা। অভ্রর গান শুনতে ইচ্ছা করছে। দুঃখের বিষয় হলো তার ফোনে গান বাজানো যায় না। যদি বাজানো যেতো তাহলে সে কোন গানটা শুনতো? এমন পরিবেশে রবীন্দ্রসংগীতের চেয়ে সুমধুর গান আর কিই বা হতে পারে? অভ্র এই গানটা শুনতো_

“মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।
কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে,
আজ আমি যে বসে আছি তোমারি আশ্বাসে,
তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা।
দূরের পানে মেলে আঁখি কেবল আমি চেয়ে থাকি,
পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে।”

বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। অভ্র আগের অবস্থায় দাঁড়িয়েই বৃষ্টিতে ভিজছে। পীচ ঢালা রাস্তায় বৃষ্টিফোটার আঘাতে অন্যরকম টিপ টিপ শব্দ হচ্ছে। অভ্র মনযোগ দিয়ে সেই শব্দ শুনছে। ফাঁকা রাস্তার মাঝ দিয়ে ধেয়ে একটি রিক্সা আসছে। অভ্র মাথা উঁচু করে তাঁকালো। রিক্সা থেমেছে। ভাড়া মিটিয়ে রুদালি এদিকেই আসছে। অভ্র মুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে। রুদালির পরনে দামী কাতান শাড়ি। কপালে টিপ। চোখের কাজল বৃষ্টির পানিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটে রঙিন লিপস্টিক। রুদালি কাছে এসে অভ্রকে জড়িয়ে ধরলো। প্রচন্ড বাতাস। বৃষ্টির পানিও ঠান্ডা। দুজনই শীতে কাঁপছে। রুদালি কাঁপতে কাঁপতে বললো,

‘আমি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি।’

‘কি বলছো এসব?’

রুদালি অভ্রকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বললো,

‘আমি বাড়ি থাকলে আজকেই ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিবে। অন্য কোনো উপায় ছিলো না। তাই আমি তোমার কাছে চলে এসেছি।’

অভ্র রুদালির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘কাজটা তুমি ঠিক করো নি।’

রুদালি অবাক হয়ে বললো,

‘বিয়ে করে ফেললে ঠিক করতাম?’

অভ্র চুপ করে রইলো।

‘এরকম সংকটপূর্ণ অবস্থায় মুখে টেপ লাগিয়ে রাখবে না। কথা বলো।’

অভ্র দেখলো রুদালির কন্ঠ ভারী শোনালেও তার চোখে পানি। বৃষ্টির পানির মধ্যেও রুদালির চোখের পানি আলাদা করতে পারে সে।

‘রুদালি। আমি বেকার। হলে থাকি। টিউশনি করে যা পাই তাতে নিজেরই চলে না। তারপরেও কিছু টাকা গ্রামে পাঠাতে হয়। তোমাকে আমি কই নিয়ে রাখবো? কি খাওয়াবো?’

‘আমি আপাতত কোনো বান্ধবীর বাসায় গিয়ে উঠবো। তুমি তোমার কোনো বন্ধু বা বড়ভাইকে বলে সাবলেটের ব্যবস্থা করো। আমার কাছে কিছু টাকা আছে। তা দিয়ে মাস দুয়েক কাটিয়ে দেওয়া যাবে। আমিও টিউশন খুঁজবো। দেখবে দুজনের টাকায় আমাদের সংসার বেশ চলবে।’

অভ্র মাথা নাড়লো।

‘এভাবে হয় না। এভাবে একটা অনিশ্চিত জীবনের দিকে আমি তোমাকে ঠেলে দিতে পারি না।’

‘চাইলে সব হয়। কিন্তু তুমি হওয়াতে চাচ্ছো না।’

‘তুমি ফিরে যাও রুদালি।’

রুদালি গলার স্বর যতটুকু সম্ভব উঁচিয়ে বললো,

‘তুমি কি ভাবছো আমি মজা করছি? বাসায় ফিরে গেলে আজকেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে অভ্র!’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে অভ্র বললো,

‘হোক।’

রুদালি যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সে বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,

‘কি বলছো এসব?’

অভ্র লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বললো,

‘নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করছি। তোমাকে আমার কাছে রাখার মতো যোগ্যতা এখনো হয় নি রুদালি। এ অবস্থায় তোমাকে বিয়ে করে নিজের কাছে রাখা সম্ভব নয়।’

‘কিন্তু…’

‘বাস্তবতা কোনো ভালোবাসার উপন্যাস নয় রুদালি যে তোমার হাত ধরে আমি অনিশ্চিত পথের পথিক হবো। তুমি ফিরে যাও। বিয়ে করে ফেলো। সুখী হবে।’

‘এতদিনের সম্পর্ক, ভালোবাসার মুহুর্ত, প্রতিজ্ঞা সব কি মিথ্যে ছিলো অভ্র?’

‘না। সব সত্যি ছিলো। শুধু ভালোবাসার বয়সটাই ছিলো মিথ্যে।’

রুদালি শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করলো,

‘আমাকে তুমি আটকাবে না, তাই না?’

‘না।’

‘এই সম্পর্ক থেকে মুক্ত করে দিবে?’

‘দিয়েছি।’

বৃষ্টি এখনো থামে নি। রুদালি আর অভ্র দুজনেই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। রুদালি এগিয়ে এসে অভ্রের কপালে ছোট্ট করে চুমু এঁকে দিলো। গাল ধরে হাসলো। তারপর অভ্রকে ফেলে তার বিপরীতে কদম ফেলতে শুরু করলো। তার মন বলছে, অভ্র এখুনি তাকে ডাক দিবে। দৌড়ে এসে তাকে আটকাবে। জড়িয়ে ধরে বলবে,

‘আমাদের ভালোবাসাটা নাহয় কোনো উপন্যাসের কাহিনীই হোক। চলো দুজন অনিশ্চিত পথের পথিক হই।’

মানুষের মন যা বলে তা সবসময় হয় না। অভ্র রুদালিকে আটকায়নি। তাকে যেতে দিয়েছে নিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

← পর্ব ০১পর্ব ০৩ →

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন