আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
কাদামাখা রাস্তায় হাঁটতে কারো ভালো লাগে না। সেই ‘কারো’ দের মাঝে অভ্রও অন্যতম। তবুও সে হাঁটছে। ইচ্ছাক্রমে নয়। বাধ্য হয়ে। গ্রামের এই কাঁচা রাস্তায় ঠেলাগাড়ি চলে। আজকে কোনো ঠেলাগাড়ি চলতে দেখা যাচ্ছে না। আকাশ ফুঁড়ে যে বৃষ্টির ধারা অনন্তকাল ধরে পড়ছিলো, তা থেমেছে ঘন্টাখানিক হলো। তবে ভরসা করা যাচ্ছে না। মেঘেদের দল এখনো এদিক সেদিক ছুটতে ব্যস্ত। সুযোগ পেলেই তারা আবার নির্দিষ্ট কোনো এক জায়গায় জমতে শুরু করবে। ঘর্ষণের ফলে সৃষ্টি হবে আলোর ঝলকানি। গুরুম গুরুম শব্দ হবে। তারপর পুনরায় শুরু হবে ঝরঝরানি বৃষ্টি। অভ্রর সস্তা জিন্সের প্যান্ট কাদায় মাখামাখি। স্বাভাবিকভাবে হাঁটা মুশকিল। ভেজা নরম মাটিতে পা আটকে যাচ্ছে। অভ্রর কাছে এখনো পনেরো টাকা আছে। এই টাকায় ঠেলাগাড়ি দিয়ে হেঁসেখেলে বাড়ি পৌঁছানো যেতো। ঠেলাগাড়ির চালক তাকে নামিয়ে দিতো বাড়ির উঠানে। অভ্রর হাত শূন্য তা বুঝতে পেরে সেদিন মকবুল ভাই তার হাতে পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দিয়েছিলো। শহরে থাকলে এই টাকায় কয়দিনই বা পেট চলতো? টিউশানি তো নিজের থেকেই বাদ দেওয়া হলো। এই বিষয়ে অভ্রের কোনো আফসোস নেই তা বললে ভুল হবে। হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যতবারই টিউশানির কথা তার মাথায় এসেছে, আফসোস হয়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্তদের এত আত্মসম্মানবোধ থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাদের মানসিকতা থাকবে নিরপেক্ষ। যে গরু দুধ দেয়, সে গরু লাথিও দেয়। কাজেই, অপমানজনক কোনো কথা বললে অথবা কোনো কাজ করলেও তা গায়ে মাখা যাবে না। রায়া তাকে অপমান করেছে। জেনে হোক বা না জেনে হোক করেছে। তার কোনো দরকার ছিলো না অভ্রকে খাবার দিয়ে দেবীরূপে আবির্ভাব হওয়ার। একজন ছাত্রী সবসময় ছাত্রীর মতো থাকবে। তার দায়িত্ব স্যারের কাছ থেকে পড়া বুঝে নেওয়া। স্যারের ব্যক্তিগত সমস্যা উপলব্ধি করে তার সমাধান করা নয়।
সবকিছু মিলিয়েই অভ্র সিদ্ধান্ত নেয় কটা দিন গ্রামে থেকে আসবে।
গ্রামের বাড়ির মূল দরজাটি রূপালি রঙের টিনের। দেয়ালে ছোট্ট একটি লোহার আংটা লাগানো আছে। টিনের দরজায় চিকন শেকলের হুঁক। শেকলের হুঁকটা লোহার আংটায় বাজিয়ে রাখা হয়। এই নিয়মেই দরজা ভিড়িয়ে রাখে অভ্রর মা সালমা। অন্যেরা না পারলেও অভ্র ঠিক দরজার ফাঁক দিয়ে আঙ্গুল ঢুকিয়ে হুঁক আংটা থেকে খুলে ফেলতে পারে। আজকেও তাই করলো। উঠোনের ঠিক মাঝখানে আসতেই শোনা গেলো সেলাই মেশিনের শব্দ। সামনের ঘরের দরজা আংশিক খোলা। সম্ভবত এই ঘরে বসেই সালমা জামা সেলাই করছে। অভ্র একদম দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিলো। সালমা খুব যত্ন নিয়ে একটি কামিজ সেলাই করছিলেন। রাণী গোলাপি রঙের কামিজ। গ্রামের মানুষদের ক্যাটকেটে রঙ ভীষণ পচ্ছন্দ। এরা গাঢ় লাল, টিয়া, অথবা রাণী গোলাপি এজাতীয় মাত্রাতিরিক্ত উজ্জ্বল রঙের কাপড় পরে স্বস্তি পায়। অভ্রকে দেখে সালমা কিছুক্ষণ বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলেন। যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না অভ্র তার সামনে দাঁড়িয়ে, সে টুল ছেড়ে উঠে ছেলের দিকে এগিয়ে গেলো।
‘বাজান তুমি আইছো?’
একথা জিজ্ঞেস করেই সালমা কেঁদে ফেললেন। ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। অভ্র তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললো,
‘জ্বি আম্মা। আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালো। বাড়িতে আসতাছো জানাইলা না তো?’
‘ভাবলাম এবার না জানিয়ে আসি। কেনো আপনি খুশি হন নাই?’
‘অনেক খুশি হইছি। ছেলে আসলে মা খুশি হইবো না?’
‘আব্বা কই? দেখা করে আসি।’
‘ওষুধ খাইয়া ঘুম দিছে।’
‘ও। তাহলে ঘুম থেকে উঠুক। তারপর দেখা করবোনি।’
সালমা ব্যস্ত হয়ে বললেন,
‘এত রাস্তা পাড়ি দিয়া আইছো খিদা লাগছে না, বাজান?’
‘জ্বি আম্মা। তা তো লেগেছে।’
‘তুমি তাইলে কলপাড়ে যাও। হাত মুখ ধুইয়া নিজেরে পরিষ্কার করো। আমি রান্না চড়াইয়া দেই।’
‘ঠিক আছে আম্মা।’
অভ্র ব্যাগ চৌকির ওপরে রেখে কলপাড়ে গেলো। সালমা চোখে মুখে ব্যস্ততা নিয়ে রান্নাঘরে আসলো। ভাঙ্গা ডিপ ফ্রিজ খুললো। সাথে সাথে মুখে দমকা ঠান্ডা হাওয়া আছড়ে পড়লো। এই হাওয়ায় শূন্যতা মিশে আছে। কোনো মাছ অথবা মাংসের গন্ধ নেই। সালমার চোখ ভিজে উঠলো। আজ সকালেই একটা জামার অর্ডার পেয়েছে। ডেলিভারি দুই দিন পর। সেদিন হাতে কিছু টাকা আসবে। হিসেব করে সপ্তাহের বাজার করতে হবে। কিন্তু আজ ছেলেকে কি খাওয়াবে সে? এতদিন পর বাড়িতে এসেছে! আলু চটকে ভাত খেতে দিবে? তার না হয় খেয়ে অভ্যেস আছে। কিন্তু ছেলের সামনে কি শুধুমাত্র আলু চটকে দেওয়া যায়? সালমা কিছুক্ষণ ডিপ ফ্রিজের পাল্লা ধরে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। ভাবনার ছিপে ধরা দিলো পন্থা। সালমা মাথার ঘোমটা টেনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
অভ্র বাবার ঘরে উঁকি দিলো। তিনি এখনো ঘুমাচ্ছেন। হালকা নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘরময় আবছা অন্ধকার। সিলিং ফ্যানটা ঘট ঘট করে ঘুরছে। জানালার পর্দা মাঝে মাঝে ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। সেই ফাঁক দিয়ে সরু আলোর রেখা আসছে। বিছানার পাশে রাখা পুরোনো হুইল চেয়ারটার ওপর আলোর রেখা পড়লেও সেটি চকচক করছে না। কেমন মরীচা পড়ে গেছে। নতুন একটা কেনা দরকার। অভ্র খুব সাবধানে বাবার পায়ের কাছে গিয়ে বসলো। অভ্রর বাবা শামসুর হক। হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ছিলেন। গ্রামের সকলের কাছে ছিলেন সম্মানের পাত্র। শহরে পড়াশোনা করার ফলে তার ভাষা ছিলো পরিষ্কার। শুদ্ধ চলিত ভাষায় কথা বলতেন। ছেলেকেও তিনি একই শিক্ষা দিয়েছেন। তাই অভ্রর কথার মাঝেও আঞ্চলিকতা নেই। পয়সাকড়ি তেমন একটা না থাকলেও নিজেদের ক্ষুদ্র এই পরিবার নিয়ে সুখী ছিলেন শামসুর হক। হঠাৎ একদিন, সমস্ত সুখ মিলিয়ে যায় অমাবস্যার আঁধারে।
অভ্র সেবার এস এস সি পরীক্ষা দিবে। বিদ্যুৎ নেই। পড়ার টেবিলে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ছে। সালমা ছেলেকে গরম দুধ দিয়ে ফেরত আসেন মাঝখানের ঘরে। স্বামীর পাতে রাতের খাবার বেড়ে দেন। শীতলপাটির ওপর বসে শামসুর হক কবজি ডুবিয়ে খাচ্ছেন। সালমা তার পাশে বসে তালপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। হঠাৎ করে শামসুর হক খাওয়া বন্ধ করে বড় বড় চোখে সালমার দিকে তাকান। হারিকেনের টিমটিমে আলোয় সালমা দেখে তার স্বামীর চোখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। নিশ্বাস নিতে পারছে না, সোজা হয়ে বসেও থাকতে পারছে না। আস্তে আস্তে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। সালমা ভয়ার্ত গলায় বলতে থাকে,
‘ও অভ্রর বাপ! আপনার কি হইছে? এমন করতাছেন ক্যান? কি হইছে আপনার?’
শামসুর হক কোনো উত্তর দিতে পারেন না। চোখদুটো তার আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসে।
মেডিকেল রিপোর্টে ধরা পড়ে রোগী ব্রেণ স্ট্রোকে আক্রান্ত। মস্তিষ্কের কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। যার ফলে তার দুটো পা এখন অকেজো। তিনি প্যারালাইজড। হার্টেরও বেশ কিছু সমস্যা ধরা পড়ে। প্রথম কয়েকদিন গ্রামের সবাই হা হুতাশ করে। দুঃখপ্রকাশ করে। ওই পর্যন্তই। যার হারায় বোঝে সে। মাসখানিক পর স্ত্রীর কান্নাকাটিও থেমে যায়। কিন্তু শামসুর হক এখনো সুযোগ পেলে কাঁদেন। শুধু তার কান্নাগুলো গহীন অন্ধকার আর সিমেন্টের দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ। টপকিয়ে অন্য কারো শ্রবণগোচর হওয়ার জো নেই।
সালমা রান্নার কাজ শেষ করে ছেলের খোঁজ করতে থাকেন। অভ্র বাবার পায়ের কাছে মাথা রেখে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মায়ের নরম আঙ্গুলের স্পর্শে তার ঘুমের রেশ কেটে যায়। সালমা তাকে ইশারা করে। যার অর্থ ‘খেতে আয়’। অভ্র মায়ের পিছু পিছু মাঝের ঘরটায় ঢোকে। সেই আগের মতো শীতলপাটি বিছিয়ে রাখা। অভ্র পাটিতে গিয়ে বসে। সালমা ছেলের মাথা বরাবর ছোট্ট টেবিল ফ্যানটি চালু করে দেয়। একটি মেলামাইনের বাটিতে মুরগীর তরকারি। আরেকটিতে আলু দিয়ে রান্না করা ডিমের ঝোল। সালমা চুলা থেকে গরম ভাত থালায় করে এনে অভ্রর সামনে রাখেন। মুরগীর রান এবং থানের অংশটুকু ছেলের পাতে তুলে দেন। থালার এক কোণায় একটি ডিমও দেন। তারপর হাসিমুখে বলেন,
‘বাজান, তুমি খাও। আমি দেখি।’
অভ্র জিজ্ঞেস করে,
‘আম্মা আপনি খাবেন না?’
‘খাবো বাজান। আগে তুমি খাও। আমি দেখি। চক্ষু দুইটা জুড়াই।’
অভ্র মাথা নিচু করে খাওয়া শুরু করলো। কতদিন পর সে এভাবে পচ্ছন্দের তরকারি মাখিয়ে ভাত খাচ্ছে তা মনে পড়ছে না। টাকার স্বল্পতার জন্য শহরে মাছ, মাংস খাওয়া হয় না। ডাল আর সবজিই ঠিক আছে। দীর্ঘদিনের ব্যবধানে মায়ের হাতের রান্নার অসাধারণ স্বাদ জিভে লাগতেই অভ্রর চোখ জোড়া ভরে আসতে লাগলো। এদিকে ছেলের তৃপ্তি ভরে খাওয়া দেখে সালমার চোখেও পানি। ছেলে চোখের পানি আড়াল করতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে আর মা তাকিয়ে আছে শূণ্যে। অথচ আশ্চর্যকথা হলো, দুজনের অভ্যন্তরীণ অনুভূতি এক। অভিন্ন নয়!
গ্রামের রাতগুলো শহরের মতো নয়। অধিক সুনসান এবং নীরব। সন্ধ্যা নামার পর থেকেই নিস্তব্ধতার চাদর গায়ে জড়িয়ে ঘটে রাতের আগমন। অভ্র উঠোনে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার পাশে লাল চায়ের কাপ রাখা। অভ্রর মাথা এখন মেঘমুক্ত আকাশের মতোই চিন্তামুক্ত। কিছু সময়ের জন্য সে চিন্তাগুলোকে ছুটি দিয়েছে। এত চাপ সে নিতে পারছিলো না। ছুটি কাটিয়ে চিন্তারা পুনরায় ফিরে আসবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অভ্র তার এই নিঃসঙ্গ মুহূর্ত বেশ উপভোগ করছিলো। কিন্তু এর মাঝে ব্যাঘাত ঘটালো তার মোবাইল ফোন। রিং বাজছে। অভ্র ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অচেনা নাম্বার। সে কপালে ভাঁজ ফেলে ফোন রিসিভ করলো। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কে বলছেন?’
অপর পাশ থেকে একটি মিষ্টি কন্ঠস্বর শোনা গেলো,
‘আপনি কি অভ্র বলছিলেন?’
‘জ্বি বলছিলাম। আপনার পরিচয়?’
‘আমার পরিচয় দিলে আপনি আমাকে চিনবেন?’
‘নাম বলুন। শুনে দেখি।’
‘আমি তনিমা। চিনেছেন?’
‘না।’
‘জানতাম।’
‘জানতেনই যখন ফোন কেনো করেছেন?’
‘কেনো আবার! কথা বলতে।’
‘আমি অপরিচিত কারো সাথে কথা বলি না।’
‘কেনো বলেন না?’
‘ইচ্ছে করে না।’
‘কেনো করে না?’
অভ্র রাগী গলায় বললো,
‘আজব! প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। কে আপনি?’
‘তনিমা।’
‘একবার বললাম না? এই নামে আমি কাউকে চিনি না!’
‘কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি।’
‘শুনে খুশি হলাম। যেহেতু আমি চিনি না সেহেতু কথা বলার আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছি না।’
‘আমি চিনি তাই আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছি।’
‘কথা বলার জন্য দুপক্ষের চেনা জানা থাকা প্রয়োজন। আগ্রহ থাকা প্রয়োজন। এক পক্ষের চেনায় অথবা আগ্রহে কথা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না। কাজেই বিদায়।’
‘বিদায় মানে?’
‘বিদায় মানে, Bye. দয়া করে ফোন দিয়ে আর বিরক্ত করবেন না।’
অভ্র উত্তরের অপেক্ষা করলো না। ফোন কেটে দিলো। মেয়েটার ওপর তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। চিন্তাগুলো পুনরায় মাথায় ফিরতে শুরু করেছে। মনে হয় তাদের ছুটি কাটানো শেষ। এখন আর নিসংঙ্গতা উপভোগ করা যাবে না। অভ্র চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে কাপের ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিলো।
← পর্ব ১০ | পর্ব ১২ → |