আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
রায়া পড়ার টেবিলে মুখ গোঁজ করে বসে আছে। তার সামনে অংকের নতুন মাস্টার। উদাস মনে বসে বসে পান চিবোচ্ছেন। তার পান চিবানোর ধরনটা খুবই বিশ্রি। অনেকটা জাবর কাটার মতো। ঠোঁটের ওপর পুরু মোচ। কুচকুচে কালো। রায়া মোটামোটি নিশ্চিত স্যার মোচে কলফ লাগিয়েছেন। সবাই চুল দাঁড়িতে লাগায়। তিনি মোচে লাগিয়েছেন। স্যারের আরেকটা জিনিস রায়ার পচ্ছন্দ হচ্ছে না। কথা বলার সময় তার মুখ থেকে পানের পিচকি ছিটে আসছে। খাতার এজায়গায় ওজায়গায় ক্ষুদ্রাকার লাল রঙ ফুটে উঠছে। পান চিবানো শেষ করে বিমল বাবু রায়াকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘অংক করতে ভালো লাগে না?’
রায়া সহজ গলায় উত্তর দিলো,
‘না।’
বিমল বাবু বললেন,
‘লাগার কথাও না। অংক কি মাইয়া মানুষের পড়ার বিষয় নাকি? অংক হইলো বুদ্ধিমানদের পড়ার বিষয়। মাইয়াগো মাথায় তো গোবর চাষ হয়। বুদ্ধির কারবার নাই।’
রায়া শান্ত গলায় বললো,
‘স্যার, গোবরে সার আছে।’
বিমল বাবু ইতস্তত করে বললেন,
‘তা আছে। কিন্তু সেই গোবর দিয়া তো মস্তিষ্ক চাষ করা যাবো না তাই না? মস্তিষ্ক চাষ করা লাগে বুদ্ধি দিয়া।’
রায়া কোনো উত্তর দিলো না। খুব সাবধানে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পড়াতে আসার পর থেকে বিমল বাবু নানাভাবে মেয়েদের অপমান করে যাচ্ছেন। মেয়েদের বুদ্ধি নেই, উপস্থিত জ্ঞান নেই, পড়াশোনা করে বিশেষ কোনো লাভ নেই ইত্যাদি। অংক বই হাতে নিয়েই তার প্রথম কথা ছিলো,
‘মেয়ে মানুষের পড়াশোনা কইরা লাভ কি? দিনশেষে শশুড়বাড়ি গিয়া হেঁসেলই ঠেলা লাগে। জজ ব্যারিস্টার কয়জন হয়?’
রায়া চাইলে তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারতো। কিন্তু দেয়নি। কিছু কিছু মানুষের সাথে বাক্যালাপ মানে সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই না। বিমল স্যার সেই কিছু কিছু মানুষদের মধ্যে পড়েন।
পড়ানো শুরু করা হলো। ত্রিকোণমিতি। বিমল বাবু মুখস্ত বিদ্যা আওড়াচ্ছেন। রায়া বিরস মুখে ঘড়ির দিকে তাকালো।
স্যার চলে যাওয়ার পর প্রচন্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে রায়া দাদীর ঘরে প্রবেশ করলো। এঘরটা অন্যদিন খালি পড়ে থাকে। কারণ রায়ার দাদী বেশিরভাগ সময় কাটান তার ছোট ছেলের বাড়িতে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে। আজ সকালে তিনি বড় ছেলের বাড়িতে এসেছেন। অজানা কোনো এক কারণে রায়ার মা কে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তবে রায়ার প্রতি তার ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলো না। মেয়েটা যখন মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ে, রায়ার মা চিত্রা মারা যান। নাহ! মানুষটার কোনো শারীরিক অসুস্থ্যতা ছিলো না। হয়তো তার কাছে খুব বেশি সময়ও ছিলো না। সৃষ্টিকর্তা খুবই স্বল্প আয়ু দিয়ে তাকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। তাই, হঠাৎ একদিন চিত্রার হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যায়। রায়ার দাদী সেদিন কাঁদেননি। তবে কষ্ট খানিকটা পেয়েছেন তা বেশ বোঝা গেছে।
রমলা বিছানার এক কোণে বসে তসবি জপছিলো। এই ঘরটার মাঝে এক প্রকার শুভ্রতা বিরাজমান। দেয়ালের রঙ, জানালার পর্দা, বিছানার চাদর সবকিছু ধবধবে সাদা। আর সাদা মানেই একরাশ পবিত্রতা। রমলা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সাথে খুঁতখুঁতে স্বভাবের। চাইলেই তার আশেপাশে ঘেঁষা অসম্ভব। কেউ তার সাদা চাদরের বিছানায় বসতে গেলেই খেঁকিয়ে ওঠেন। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হলেও তিনি অবয়ব দেখেই মানুষ চিনে ফেলেন। অবশ্য, রায়ার বিষয়টা আলাদা। নাতনিকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে তিনি বললেন,
‘দিদিভাই নাকি? আসো ভেতরে আসো।’
রায়া ভেতরে প্রবেশ করলো।
‘কি হইছে দিদিভাই? চেহারা ময়লা কইরা রাখছো কেন?’
রায়া চোখ কপালে তুলে বললো,
‘চেহারা ময়লা করে করে রাখছি মানে?’
‘এই যে মুখ কালা বানাইয়া রাখছো। কিছু হইছে?’
রায়া বুঝলো, বিমল স্যারকে নিয়ে যে সে বিরক্ত সেই ছাপ তার চোখে মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মুখচিত্র দেখাচ্ছে বাংলার পাঁচের মতো। একেই দাদী -চেহারা ময়লা বলে সম্বোধন করছেন। রায়া শান্ত গলায় বললো,
‘কিছু হয় নাই। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে।’
রমলা তসবি জপতে জপতে বললেন,
‘চুলে একটু তেল দিয়া দিমু? তাইলে মাথাব্যথা কইমা যাবো।’
রায়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললো,
‘দাও। মাথায় তেল দিয়ে দাও।’
বিছানার পাশে বেশ বড়সড় একটি ট্রাঙ্ক। এই ট্রাঙ্কটির গায়েও সাদা রঙ লেপ্টে দেওয়া হয়েছে। তার ওপরে একটি তেলের বোতল। ছোট্ট একটি পিরিচ নেওয়া হলো। তারপর আয়োজন করে রমলা তার নাতনির চুলে তেল মালিশ করে দিতে লাগলেন। আরামে রায়ার চোখ বারবার বুজে আসছে। ঝাপসা দৃষ্টিতে ভেসে উঠলো পুরোনো কিছু স্মৃতি।
ছোটবেলায় রায়ার মা কম চেষ্টা করেছে মেয়ের মাথায় তেল লাগিয়ে দিতে? রায়া সারাবাড়ি জুড়ে সেকি ছোটাছুটি! কিছুতেই মাথায় তেল লাগাবে না। পরিশেষে তাকে ধরে বেঁধে বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হতো। আবছা আলো আবছা আঁধারের অংশটুকুতে বসতো তারা। চিত্রা উঁচু টুলে বসতেন আর রায়াকে বসিয়ে দিতেন ঝকঝকে ফ্লোরে। রায়ার মুখে ভর করতো এক ঝাঁক মলিনতা। চিত্রা মেয়ের কান্ড দেখে মুচকি মুচকি হাসতেন। চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলতেন,
‘গল্প শুনবি?’
একথা শোনার পর রায়ার গম্ভীর ভাব মুহূর্তের মধ্যেই উবে যেতো। অধিক আগ্রহ নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতো,
‘কিসের গল্প?’
মা উত্তর দিতেন,
‘সুয়োরানী আর দুয়োরাণীর গল্প।’
‘না। আমি রাজকুমারীর গল্প শুনবো।’
‘আচ্ছা। রাজকুমারীর গল্পই শোনাবো।’
রায়া শব্দ করে হেসে উঠতো। চিত্রা মেয়ের তেলযুক্ত মাথার একপাশে সযত্নে চুমু খেয়ে গল্প বলা শুরু করতেন,
‘একদেশে ছিলো এক রাজকুমারী। রাজকুমারীর নাম কি ছিলো জানিস?’
‘কি ছিলো?’
‘রায়ামণি।’
রায়া পুনরায় খিল খিল করে হেসে উঠতো।
‘কিন্তু রায়ামণির মনে অনেক কষ্ট ছিলো।’
‘কেনো কষ্ট ছিলো মা?’
‘কারণ মেয়েটা যখন খুব ছোট তখন তার মা মারা যান। বাবা তো রাজ্য সামলাতে ব্যস্ত। মেয়ের খেয়াল রাখবে কে? তখন রায়ামণির বাবা মেয়ের জন্য নতুন একটা মা নিয়ে আসলো।’
‘তারপর?’
‘রায়ামণি তাতেও খুশি হলো না। সবসময় একা একা থাকতো। কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলতো না। এভাবেই একাকিত্বের মাঝে রাজকুমারী রায়া ধীরে ধীরে বড় হয়ে গেলো। তারপর হঠাৎ একদিন কি হলো জানিস?’
‘কি হলো?’
‘রাজকুমারী কাউকে কিছু না বলে গহীন জঙ্গলে চলে গেলো। চারিদিকে এত গাছপালা। স্থানে স্থানে অন্ধকার! কোথা থেকে আচমকা একটা বাঘ রাজকুমারীকে আক্রমন করে বসলো!’
গল্পের এপর্যায়ে রায়ার চোখদুটো বড়বড় হয়ে যেতো। সে ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করতো,
‘তারপর? রাজকুমারীকে বাঘ খেয়ে ফেলে?’
‘না। সেসময় শিকারে বের হয়েছিলো অন্য দেশের এক রাজকুমার। সে শিকারের সন্ধান করতে করতে রায়ামণিদের দেশে চলে আসে আর জঙ্গলের বাঘের হাত থেকে তাকে বাঁচায়।’
‘এরপর কি হয় মা?’
তেলের বাটি সরিয়ে রেখে রায়ার চুলে বিনুনি গেঁথে দিতে দিতে চিত্রা বলে,
‘রাজকুমারী রাজকুমারের সাথে দেশ ছেড়ে চলে যায়।’
‘বাবাকে না জানিয়ে?’
‘হুঁ।’
‘রাজকুমারের নাম কি ছিলো?’
‘রাজকুমারের নাম ছিলো মেঘ।’
রায়া অনুনয়ের স্বরে বলতো,
‘আমারো একটা মেঘ লাগবে, মা। এনে দিবে?’
চিত্রা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বলতো,
‘সব এনে দিবো।’
আনন্দে রায়া মাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো।
রমলার ডাকে কল্পনার জগৎ থেকে রায়া বাস্তবে ফিরে আসে।
‘দিদিভাই।’
‘বলো।’
‘বিনুনি গাঁইথা দেই?’
‘দাও।’
রমলা বিনুনি গাঁথতে লাগলো। রায়ার বোধগম্য হলো পুরোনো স্মৃতিপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। আচ্ছা, মা কি তাহলে বুঝতে পেরেছিলো, সে খুব ক্ষুদ্র সময়ের জন্য এই পৃথিবীতে এসেছে? গল্পের সেই রায়ামণির মায়ের মতো সেও কেনো চলে গেলো দূরে? বহুদূরে! ধরা ছোঁয়ার বাইরের ওই আকাশের শূন্যে?
দাদীর ঘর থেকে বের হয়ে রায়া রান্নাঘরে গেলো। মাথার যন্ত্রণা এখনো পুরোপুরি সারেনি। একটু চা খেয়ে দেখা যেতে পারে। রায়া দুকাপ চায়ের সমপরিমাণ পানি নিয়ে চুলায় কেটলি বসালো। রঙ চা বানাবে। সুন্দর করে আদা ছেঁচে কেটলিতে ছেড়ে দিলো। পানি ফুটছে। কিছুক্ষণ বাদে কেটলিতে চা পাতা ছেড়ে দিলো। মিনিট এক জাল করে কেটলি নামিয়ে ফেললো। দুকাপ চা নিয়ে সে নিচতলায় গেলো। বাবার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে আসা যাক। কিন্তু রায়ার ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে গেলো। স্বভাবমতো নুরুল আলম তার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। রায়া বিরক্তের পাত্র হতে চায়নি। সে দরজার সামনে থেকেই তিন তলায় ফিরে এলো। তার ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালা খুলে দিতেই ঠান্ডা বাতাস দেয়ালের প্রতিটি কোণায় যেনো আছড়ে পড়লো। পাঠ্যবইয়ের নিচ থেকে ডায়রিটা বের করলো রায়া। বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে সে ডায়রির পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলো। কলমের কালিতে অর্ধেক ডায়রি পূর্ণ। সব লিখা তার মা চিত্রাকে উদ্দেশ্য করে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সে আজ আবার লিখতে বসলো।
চা টা কেমন হয়েছে বল তো মা? মজা হয়েছে না? বাবার জন্য করেছিলাম। কিন্তু তার চেখে দেখার সময় হলো কই? আজও বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তুমিই আমার চা বৈঠকের সংঙ্গী হও?
জানো মা? আমার মাঝে মাঝে ভীষণ একা লাগে। তুমি তো কবেই আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে। বাবাও সবসময় ব্যস্ত থাকে। ম্যাট্রিকে পাশ করতে পারি না বলে আমার এখন কোনো বন্ধুও নেই। বড্ড একা লাগে মা। তোমার কথা খুব মনে পড়ে! কতদিন তোমার মুখে রাজকুমারীর গল্প শুনি না। জানো মা? তোমার ওই গল্পের রায়ামণির মতো আমার জীবনেও একজন মেঘ এসেছে। অবশ্য তার নাম মেঘ নয়। অভ্র। কিন্তু মজার বিষয় দেখো! অভ্র কিন্তু মেঘেরই প্রতিশব্দ। তবে আমার মেঘটা কিন্তু গল্পের মেঘের মতো নয়। অনেক আলাদা। খাটাশ প্রকৃতির। আমার অনুভূতিগুলোর দামই দিলো না। নিষ্ঠুরভাবে ফেলে চলে গেলো। সামনে যে আমার পরীক্ষা সে চিন্তেটাও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সে শুধু খাটাশ না। দায়িত্বজ্ঞানহীনও বটে! আচ্ছা তোমায় একটা প্রশ্ন করি। সবার মা আছে। আমার মা কেনো নেই? আমায় ফেলে হারিয়ে যাওয়ার এত তাড়া কেনো ছিলো তোমার? আজ তুমি বেঁচে থাকলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো?
এটুকু লিখে রায়ার হাত থমকে গেলো। ডায়রির ওপর টপটপ করে চোখের পানি পড়ছে। আর লিখা যাবে না। সবসময়ই ডায়রির লিখা অপূর্ণ থেকে যায়। ভেজা ডায়রির পাতায় কি কলম ছোঁয়ানো যায়! ছিঁড়ে যাবে না?
← পর্ব ১১ | পর্ব ১৩ → |