আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস - পর্ব ১৩ - আতিয়া আদিবা - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন আতিয়া আদিবা'র লেখা একটি ধারাবাহিক গল্প আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস'এর ১৩তম পর্ব
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস

জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো অর্ণব। আবছা অন্ধকারে আচ্ছন্ন রুম হঠাৎ করেই দ্বিগুণ আলোকিত হয়ে গেলো। ঝলমলে সকাল। রোদের তীব্রতা রুদালির চোখজোড়া স্পর্শ করতেই ঘুমের মাঝে সে কপালে আংশিক ভাঁজ ফেললো। অর্ণব তাড়াহুড়ো করে রুদালির মাথার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রুদালির কপালের ভাঁজ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। অর্ণব সামান্য হাসলো। মেয়েটার সামনে থেকে সরে গেলেই কপালের ভাঁজ আবার স্পষ্ট হয়ে উঠবে। অর্ণব রুদালির দিকে তাকিয়েই পা টিপে টিপে পেছোতে লাগলো। জানালার পর্দাটা অল্প একটু টেনে দিলো। রুদালির মুখ এবার রোদের স্পর্শের বাইরে। অর্ণব নিচে তাকিয়ে দেখলো সুইমিং পুলের পাশে বসে এক দম্পতী কাপে করে চা অথবা কফি কিছু একটা খাচ্ছে। অর্ণবেরও কফি খেতে ইচ্ছে করছে। সে ঠিক করলো হোটেল বয়কে ফোন দিয়ে এক কাপ চা আর এক মগ কফি দিয়ে যেতে বলবে। ওরা এখন আছে হোটেল কক্স টুডে তে। গতকাল রাতে সীতাকুন্ড থেকে কক্সবাজার এসেছে। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরে হোটেল বয় ফোন রিসিভ করলো,

‘গুড মর্নিং স্যার। আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?’

‘আমি কি এক কাপ চা এবং এক মগ কফি পেতে পারি?’

‘অবশ্যই স্যার। রুম নাম্বার?’

অর্ণব রুম নাম্বার বলে হোটেল বয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দিলো। ক্ষণিককাল বাদে কলিং বেল বাজলো। শব্দ এতোটাই প্রকট ছিলো যে রুদালির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সে ধীরে ধীরে কাঁথা সরিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসলো।অর্ণব এদিকটায় নেই। সম্ভবত কে এসেছে দেখতে গিয়েছে। রুদালির প্রচন্ড মাথাব্যথা করছে। এক কাপ চা খেতে পারলে বেশ হতো। মনে মনে কথাটি ভাবা শেষ না হতেই অর্ণব ট্রে হাতে রুমে ঢুকলো।

‘ঘুম ভাঙ্গলো তোমার? ভালোই হয়েছে। এই দেখো এসে গেছে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা! যদিও দুধ চিনি মিশিয়ে নিতে হবে।’

রুদালি বললো,

‘আপনিই মিশিয়ে দিন।’

অর্ণব উৎসাহিত কন্ঠে বললো,

‘ঠিক আছে দিচ্ছি। ছোট খাটো একটা রান্নার শো করে ফেলি কি বলো?’

‘করুন।’

‘ওকে। ওয়ান, টু, থ্রি একশন। প্রথমে কাপে দুচামচ গুড়া দুধ মেশাতে হবে। তারপর দিয়ে দিচ্ছি পরিমাণ মতো চিনি। এবার চামচ দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে নিন। ব্যাস! তৈরি হয়ে গেলো মজাদার এক কাপ দুধ চা। নিন ম্যাডাম। টেস্ট করে দেখুন।’

রুদালি হেসে চায়ের কাপ হাতে নিলো। আলগোছে কাপে চুমুক দিয়ে বললো,

‘চা ভালো হয়েছে।’

অর্ণব কফির অন্যান্য মিশ্রণ গুলো মগে চামচ দিয়ে মেশাতে মেশাতে বললো,

‘ধন্যবাদ। আচ্ছা, বিচে কখন যাবে? এখন নাকি বিকালে?’

‘এখনি যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পা ব্যাথার সাথে সাথে নতুন করে মাথা ব্যাথার উপসর্গ দেখা দিয়েছে।’

‘তাহলে এবেলা থাক। তবে তোমার এই পা ব্যাথা কমতে দেরী আছে। পাহাড় বেয়ে উঠা নামা করেছো। পায়ে অত্যাধিক চাপ পরেছে। সেরে উঠতে সময় লাগবে।’

‘তাই মনে হচ্ছে।’

‘কোনো সমস্যা নেই। সমুদ্র দেখলে অর্ধেক পা ব্যাথা এমনেই ভালো হয়ে যাবে।’

‘কেনো? সমুদ্র বুঝি এসব ব্যাথার থেরাপি?’

রুদালির প্রশ্ন শুনে অর্ণব হেসে ফেললো। বললো,

‘তা জানি না। তবে যখন সমুদ্রের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে তখন দেখবে তার বিশালতার কাছে নিজের সমস্ত দুঃখ, বেদনা, ব্যাথা সব বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে অনেক হালকা বলে মনে হচ্ছে।’

রুদালি নিচু স্বরে বললো,

‘আপনি অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেন।’

অর্ণব আবারো হেসে বললো,

‘ধন্যবাদ।

আচ্ছা এক কাজ করো। তুমি চা খাও আমি বরং নিচে যাই। খাবারের ব্যবস্থা করে আসি। কেমন?’

রুদালি মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,

‘ঠিক আছে।’

অর্ণব রুম থেকে বের হয়ে গেলো। রুদালি লক্ষ্য করলো অর্ণবের মগে এক ফোঁটা কফিও নেই! এত দ্রুত একটা মানুষ গরম কফি কিভাবে শেষ করে ফেললো। নাহ! এই ছেলেটা সত্যিই বড় অদ্ভুত প্রকৃতির!
বর্ষার উত্তাল সমুদ্র। দক্ষিণের বাতাসের দুয়ার যেনো কেউ খুলে দিয়েছে। বাতাসের তোড়ে সৈকতে শুরু হয়েছে বালুঝড়। হন্যে হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে সুনীলের এপাড়ে। খানিকটা মরুভূমির আমেজ। রুদালি আর অর্ণব পাশাপাশি হাঁটছে সাগরপাড়ে। চতুর্দিকে পর্যটকদের আনাগোনা। এদের মাঝে বৈদেশিক নাগরিকও আছে। বেশিরভাগ মানুষই ছবি তোলায় ব্যস্ত। অনেকে আবার সমুদ্রের নীল জলরাশিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে। কেউ কেউ আবার সৈকতে পেতে রাখা রঙিন চেয়ার গুলোতে অর্ধশোয়া অবস্থায় আছে। অপেক্ষা, কখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়বে। কখন দেখা যাবে নীল আর রক্তিম আকাশের মিলনপর্ব। উপভোগ করা যাবে সাগর তীরে সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য! অর্ণব রুদালিকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

‘পা ব্যাথা কমেছে?’

রুদালি উত্তর দিলো,

‘না।’

‘সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে দেখবে?’

‘তাতে কি লাভ হবে?’

‘কে জানে? পা ব্যাথা সেরেও যেতে পারে!’

রুদালি হেসে জবাব দিলো,

‘না।’

‘নামতে যখন চাইছো না, তখন জোর করবো না। কিন্তু এই সমুদ্র বিমুখীতার কারণ জানতে পারি?’

‘সমুদ্র বিমুখীতা নয়। আসলে আমি পানির সংস্পর্শে আসতে ভয় পাই।’

অর্ণব অবাক হয়ে বললো,

‘ভয় পাও? তাহলে তো জোর করে নামাতেই হয়! চলো যাই।’

একথা বলে অর্ণব রুদালির হাত ধরলো। রুদালি একটু জোর গলায় বললো ‘না’। শুধুমাত্র না বলেই ক্ষান্ত হলো না। অর্ণবের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ঝামটা মারলো। অর্ণবও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সে খানিকটা ইতস্তত করে বললো,

‘সর‍্যি। আসলে…’

কথা শেষ না করে অর্ণব এদিক সেদিক তাকিতুকি করতে লাগলো। বললো,

‘এই তুমি ঝালমুড়ি খাবে?’

রুদালি কোনো উত্তর দিলো না। অর্ণব অবশ্য রুদালির উত্তরের অপেক্ষায় নেই।

‘ওদিকটায় ঝালমুড়ি বিক্রি করছে দেখা যায়। তুমি একটু দাঁড়াও। আমি ঝালমুড়ি কিনে আনি।’

একথা বলেই অর্ণব ঝালমুড়ি কিনতে চলে গেলো। এভাবে মেয়েটার হাত ধরা মোটেও উচিত হয়নি। তাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন। রুদালি সৈকতে একা দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনেই বেশ কয়েকটি বাচ্চা ইচ্ছেমতো নোনা পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। শেষ বিকালের আলোয় উর্মিমালা গুলো চিকচিক করছে। দূর সমুদ্র থেকে উঁচু হয়ে এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। বাচ্চাগুলো ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। লাইফ গার্ডরাও তাদের কিছু বলছে না। মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি উড়তে উড়তে পাহাড়ের দিকটায় চলে গেলো। রুদালি মনোযোগ দিয়ে সেই পাখিদের ডাক শুনছে। এমন সময় তার পাশে বয়স্ক একজন মহিলা এসে দাঁড়ালো। উনার স্বামীও আছেন সাথে। কিন্তু তিনি বসে আছেন হুইল চেয়ারে। রুদালি শুনলো মহিলাটি তার স্বামীকে বলছেন,

‘দেখছো কত সুন্দর? একটু পরেই সূর্য ডুইবা যাবে।’

কিন্তু তার স্বামী প্রত্যুত্তরে কিছুই বললেন না। মহিলাটি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। সমুদ্রের এদিক ওদিক আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন। কিন্তু তার স্বামী একটি কথার উত্তরও দিচ্ছেন না। তার দৃষ্টি স্থির। রুদালি বেশ অবাক হয়। সে কৌতূহলী চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। রুদালির এই কৌতূহল বৃদ্ধার দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি নিজের থেকেই রুদালির সাথে কথা বললেন,

‘আমার মিস্টার। স্ট্রোক করার পর থেকে কথা বলতে পারে না। হাঁটতেও পারে না।’

রুদালির কাছে এবার পুরো বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেলো। সে হাসার চেষ্টা করে বললো,

‘ও।’

বৃদ্ধাও হাসিমুখে বললেন,

‘সম্প্রতি ক্যান্সার ধরা পড়েছে। লাস্ট স্টেজ। চিকিৎসা করাইয়াও লাভ নাই।’

রুদালি বিস্মিত চোখে বৃদ্ধাকে দেখছে। কত স্বাভাবিক ভাবেই না তিনি কথাগুলো বলছেন! কোনো রকম জড়তা ছাড়া। রুদালি জিজ্ঞেস করলো,

‘এই অবস্থায় উনাকে নিয়ে কক্সবাজার আসলেন, ডাক্তার কিছু বলে নি?’

বৃদ্ধা বিস্মিত কন্ঠে উত্তর দিলো,

‘না। ডাক্তার কি বলবে? এমনিতেও দয়াল তারে যেকোনো সময় ডাক দিবে। বিয়ার রাতে উনি আমার হাত ধরে বলছিলেন। মৃত্যুর আগে আমার সাথে একবার সমুদ্র দেখার খুব ইচ্ছা তার। সেই ইচ্ছাই পূরণ করতে কক্সবাজার নিয়া আসলাম।’

‘আপনার ছেলে মেয়ে কেউ নেই?’

‘আছে।’

‘তারা কোথায়?’

‘ঢাকায়।’

‘এই বয়সে আপনাদের দুজনকে একা এতদূর আসতে দিলো?!’

বৃদ্ধা বললেন,

‘আসতে দিতে চায় নাই। জোর কইরাই আসছি। বিয়ার রাতে হাত ধইরা তাকে কথা দিছি না? সেই কথা কি অমান্য করা যায়?’

উত্তর শুনে রুদালি চুপ করে রইলো। বৃদ্ধা হাসিমুখে বললেন,

‘আপনি কার সাথে আসছেন?’

‘হাজবেন্ডের সাথে।’

‘ভালো। বেশ ভালো। আমি যাই। তারে আরেকটু ঘুরাইয়া আনি।’

রুদালি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। বৃদ্ধা তার স্বামীর হুইল চেয়ারে ধাক্কা দিয়ে ধীর গতিতে সমুদ্রতীরে হাঁটতে লাগলো। এরকম সুন্দর একটি দৃশ্য দেখে রুদালির চোখ কেনো জানি ঝাপসা হয়ে এলো। আঁচল দিয়ে চোখের কোণা মুছে সে বৃদ্ধা এবং তার স্বামীর চলে যাওয়া দেখতে লাগলো। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে অর্ণবের আগমন। ঝালমুড়ির একটি ঠোঙ্গা রুদালির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘আর বলো না। এত ভীড়! বিচের অর্ধেক মানুষ মনে হয় ঝালমুড়ি কিনতেই এসেছে।’

অর্ণবের কথায় রুদালি মুচকি হাসলো।

‘বেশি দেরী করে ফেললাম কি?’

‘না। ঠিক আছে।’

অর্ণব চুপ করে ঝালমুড়ি খেতে লাগলো। মুখ দিয়ে ‘উমমম’ জাতীয় শব্দ করে বললো,

‘অনেক মজা। খেয়ে দেখো।’

রুদালি ঝালমুড়ি খেলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,

‘আমি সমুদ্রে নামতে চাই।’

অর্ণব খাওয়া বাদ দিয়ে ভ্রুঁ কুচকে বললো,

‘তোমার না ফোবিয়া আছে? পানিতে ভয় পাও?’

‘ভয় পেলে আমাকে শান্ত করার জন্য আপনি আছেন তো।’

অর্ণব নিচে বালুর দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর স্নিগ্ধ চোখজোড়া তুলে রুদালির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ঠিক আছে। চলো।’

রুদালি নিচু স্বরে বললো,

‘আরেকটা কথা।’

‘কি?’

‘আমার হাত ধরতে হবে কিন্তু!’

‘হাত ধরবো?’

‘হুঁ। একা সমুদ্রে নামার সাহস আমার নেই। তাছাড়া বন্ধুর হাত ধরা যেতে পারে। এটা অন্যায় নয়।’

অর্ণবের ঠোঁটের কোণে হাসি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রুদালির গালেও কিছুটা লজ্জমিশ্রিত হাসির রেখা।
দুজন মানুষের ছায়া সৈকতের বালুতে লম্বালম্বি ভাবে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ছায়া দুটো হাত ধরাধরি করে সুনীল জলরাশিতে পা ভেজাতে এগিয়ে যাচ্ছে। সূর্য অর্ধেক হারিয়ে গেছে সমুদ্রের মাঝে। রুদালির পায়ে শীতল পানি এসে স্পর্শ করলো। সে খানিকটা কেঁপে উঠলো। মনের অজান্তেই অর্ণবের হাত বেশ শক্ত করে ধরলো। তার নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে অস্ফুটবাক্যে অর্ণবও বলে উঠলো,

‘মৃত্যুর আগেও যেনো একবার তোমার হাত ধরে ঠিক এভাবেই সমুদ্র দেখতে পারি।’

অর্ণবের কথায় রুদালি খানিকটা চমকে উঠলো। অজানা এক অনুভূতি গ্রাস করে ফেললো তাকে। এই অনুভূতি তার কাছে একদম নতুন।

← পর্ব ১২পর্ব ১৪ →

১টি মন্তব্য

  1. Unknown
    Unknown
    গল্পটা পড়তে ভীষণ ভালো লাগছে ,,, তার অন্যতম এক কারণ এখানে টাঙ্গাইল নামক স্থান টা জুড়ে আছে । আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা সেখানে । সেখানে এখন থাকিনা তবে গল্পের মাধ্যমে জায়গা টাকে ভীষণ মনে পড়ছে।


    কাকতালীয় ভাবে আমরা যখন কক্স বাজার ঘুরতে গেছিলাম , তখন হোটেল কক্স টু ডে তেই ছিলাম 😅