আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস - পর্ব ০৪ - আতিয়া আদিবা - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন আতিয়া আদিবা'র লেখা একটি ধারাবাহিক গল্প আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস'এর ৪র্থ পর্ব
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস

নুরুল আলম তার শাড়ির দোকানে বসে আছেন। এই শহরে তার তিনটে শাড়ির দোকান আছে। প্রতিটি দোকানের নামকরণ করা হয়েছে তার মেয়ের নামে। রায়া ফ্যাশন-১, রায়া ফ্যাশন-২, রায়া ফ্যাশন-৩। আবার কালি বাড়ি রোডের পাশে সেদিন নতুন একটি মার্কেট উদ্ভোধন করা হয়েছে। মালিক নুরুল আলম। এই মার্কেটের নামও রায়া মার্কেট। অজ্ঞাত কারণে তিনি কাজের ক্ষেত্রে মেয়ের নাম ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সচরাচর তার দোকানে বসা হয় না। প্রতিদিন দুইবার করে এসে ঘুরে যান। বেচাকেনার খবরাখবর নেন। প্রয়োজনে কর্মচারীদের ওপর চেঁচামেচি করেন। বাকিসময় বাসাতেই থাকেন। দোতলার অফিস রুমে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেন। ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেন। মাঝে মাঝে গভীর রাত পর্যন্ত তাশ খেলা চলে। পাশাপাশি মদ্যপানও চলে। আজ দোকানের একজন কর্মচারী আসে নি।আরেকজনকে পাথরাইল পাঠানো হয়েছে। নতুন শাড়ি কিনে আনতে। পাথরাইল থেকে কম দামে শাড়ি কিনে শহরে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা যায়। এতে লাভ হয় বেশি। তাই নুরুল আলম আজ দোকান খুলেছেন। রাজকীয় ভঙ্গিতে ডিভানের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছেন। এমন সময় পাশের দোকানের শফিউল আসলো।

‘বেচা কেনা কেমন চলে আলম ভাই?’

‘দোকান খুললামই একটু আগে। এখনো কোনো কাস্টমার আসে নাই। বাইরে দাঁড়িয়ে আছো ক্যান? ভেতোরে আসো।’

শফিউল ভেতোরে ঢুকলো। ছোট গদিযুক্ত চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,

‘দোকান ফাঁকা কেনো? বাকি লোকজন কই?’

‘সালাম রে পাথরাইল পাঠাইছি। কালাম আজকে আসে নাই। মা অসুস্থ্য, বাড়িতে গেছে।’

‘পাথরাইল পাঠাইছেন? শাড়ির অর্ডার আছে নাকি?’

‘হ। ওই যে মুন্সি ভাই আছে না? উনার মেয়ের বিয়া। হলুদের জন্য একরকম পঁচিশটা শাড়ি অর্ডার দিছে। পাথরাইল থেকে করাইয়া আনতাছি।’

‘আকুর টাকুর পাড়ার মুন্সি ভাই?’

‘হ।’

‘ভালো করেই চিনছি তারে। এই বিয়ার পেছনের ঘটনা কি জানেন?’

নুরুল আলম দাঁত খোঁচানো বাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কিসের ঘটনা?’

শফিউল বললো,

‘মেয়েরে তো সে এখনি বিয়ে দিতো না। বাধ্য হয়ে দিতেছে। বাসা থেকে এক ছেলের সাথে বের হয়ে যেতে নিছিলো। ধরা খাওয়ার পর এই বিয়ের আয়োজন।’

‘হায় হায়! বলো কি? কোন ছেলের সাথে?’

‘হোম টিউটরের সাথে। অল্প বয়সী ছেলে ঠিক করছিলো মেয়েরে পড়ানোর জন্য। একদম জায়গা মতো হাত দিছে।’

‘সর্বনাশ! ছেলে কি পড়তেছে?’

‘সাদাত কলেজ থেকে অনার্স পাশ করছে। এখন মনে হয় চাকরি খুঁজতেছে।’

‘এত বড় ঘরের মেয়েকে এই ছেলের সাথে বিয়ে দিতাছে? তাও এত ধুমধাম কইরা?’

‘কি আর করার আছে বলেন ভাই? আমরা বাপরা তো নিজেগো মেয়েদের কাছে অসহায়! পালায়ে গেলে সম্মান নিয়া টানাটানি। বোঝেন নাই?’

নুরুল আলম ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,

‘তা ঠিক।’

‘রায়া মামণি কেমন আছে?’

‘ভালো আছে।’

‘পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন? এবার পাশ না করলে কিন্তু কোনো গতি নাই!’

নুরুল আলম অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

‘ভালো একজন শিক্ষক রেখে দিছি। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’

‘ভালো করছেন। তা শিক্ষক কি জোয়ান নাকি বয়স্ক? বয়স্ক হইলে সমস্যা নাই। জোয়ান হইলে সমস্যা। বিরাট সমস্যা!’

নুরুল আলম ইতস্তত ভাবে বললেন,

‘বয়স তো অল্পই। ভাসানীতে পড়ে। থার্ড ইয়ারে।’

শফিউল কপাল ভাঁজ করে বললো,

‘তাহলে তো চিন্তার বিষয়। চোখ কান খোলা রাইখেন।’

নুরুল আলম কোনো উত্তর দিলেন না। শফিউল হাই তুলে বললো,

‘আমি যাই আলম ভাই। দোকানে কিছুক্ষণ সময় দিয়া বাসায় যাবো গা।’

‘আরেকটু বসো। চা খেয়ে যাও।’

‘না, ভাই। এখন আর চা খাবো না। অন্যদিন খাবো নি। আপনারে তো দোকানে পাওয়াই যায় না। মাঝে মাঝে এমনেই আইসা বসে থাইকেন।’

‘আচ্ছা।’

শফিউল চলে গেলো। নুরুল আলম চিন্তিত মুখে আবার দাঁত খোঁচানো শুরু করলেন। মেয়ের হোম টিউটরকে নিয়ে তার চিন্তা হচ্ছে। এত অল্প বয়স্ক ছেলে ঠিক করা মনে হয় উচিত হয়নি।

রায়া তিন তলার বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র আসার সময় হয়ে গেছে। এই ছেলেটা প্রতিদিন কাঁটায় কাঁটায় দেড়টার সময় রায়াদের বাসায় আসে। এক মিনিট এদিক সেদিক হয় না। একটা মানুষ কিভাবে একদম ঠিক সময়মতো কারো বাসায় পৌঁছাতে পারে রায়া ভেবে পায় না। সে অনেকদিন খেয়াল করেছে, দেড়টা বাজার দুই মিনিট আগে তাদের বাড়ির সামনে রিক্সা এসে থামে। অভ্র কখনোই নিচে থাকা অবস্থায় উপরে তাকায় না। ভাড়া মিটিয়ে মাথা নিচু করে শান্ত ভঙ্গিতে সরাসরি গেট দিয়ে ঢোকে। কিন্তু আজকে দেড়টা বাজার দুই মিনিট আগে কোনো রিক্সা রায়াদের বাসার গেটের সামনে থামলো না। এমনকি ঘড়ির কাটা দেড়টা পেরিয়ে গেলো, কিন্তু অভ্র নিখোঁজ। রায়া কপালে ভাঁজ ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। হাজারটা প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে কি আজকে স্যার আসবেন না? যদি নাই বা আসেন তার কারণ কি? স্যার তো খুবই স্ট্রিক্ট একজন মানুষ। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলেন। কোনো কারণ ছাড়া পড়ানো বাদ দিবেন না। গতকাল যে বললেন, তিনি আর পড়াবেন না – কথাটি কি সত্যিই বলেছিলেন? রায়া এক প্রকার ভয় পেতে শুরু করলো। যদি প্রকৃতপক্ষেই আর পড়াতে না আসেন? রায়ার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর। ঘড়ির কাটা আরো পনেরো দাগ এগিয়ে গেছে। রায়ার চোখ ছলছল করছে। সে আশা ছেড়ে দিলো। বারান্দা থেকে ঘরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু যেতে পারলো না। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় সেই চিরচেনা সস্তা পারফিউমের গন্ধ তার নাকে আছড়ে পড়লো। সে থমকে দাঁড়ালো। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পুনরায় গ্রিলের কাছে গিয়ে দেখলো অভ্র আসছে। তবে রিক্সায় করে নয়। পায়ে হেঁটে।

অভ্র শুকনো মুখে বসে আছে। রায়া খসখস করে বিরামহীন অংক কষে যাচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে অভ্রর দিকে তাকাচ্ছে। স্যারের সাথে খেজুরে আলাপ করতে ইচ্ছা করছে তার। যদি বকা দেয়? দেখে তো মনে হচ্ছে স্যারের মন আজ ভালো নেই। কিছুক্ষণ উশখুশ করে সে বললো,

‘স্যার আপনি আজকে পায়ে হেঁটে কেনো এসেছেন?’

‘হাঁটলে শরীর ভালো থাকে। কাজেই আমি মাঝে মধ্যে পায়ে হেঁটে আসার চেষ্টা করি।’

রায়া জানে স্যার মিথ্যা কথা বলছে। তার ইচ্ছে করছে স্যারকে থামিয়ে দিয়ে বলতে, আপনি মিথ্যা বলছেন। আমি প্রতিদিন এই ভর দুপুরে আপনার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। আপনি রিক্সায় করে আসেন। পায়ে হেঁটে আসেন না। এর সাক্ষীও আছে। কে জানেন? ওই কারেন্টর তারের ওপর বসে থাকা কাকটা। কাকটাও প্রতিদিন একই সময় আমার মতো কারো জন্য প্রতীক্ষায় ব্যস্ত থাকে। কিন্তু রায়া এসব তার স্যারকে বলবে না। সে ক্ষণিককাল চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করলো,

‘স্যার?’

‘বলো।’

‘আপনার কি মন খারাপ?’

‘না।’

‘আপনাকে চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আপনার মন খারাপ।’

অভ্র জবাব দিলো না। মুখ বন্ধ করে রইলো। রায়া উত্তরের জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। কিন্তু লাভ হলো না। সে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

‘স্যার?’

‘বলো।’

‘আপনি কি সকাল থেকে না খেয়ে আছেন?’

‘না।’

‘আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আপনি সকাল থেকে না খাওয়া।’

অভ্র কঠিন গলায় বললো,

‘আমার চেহারা নিয়ে গবেষণা না করে যদি তুমি অংকগুলো ঠিকভাবে করো অনেক বেশি খুশি হবো।’

রায়া নিচু গলায় বললো,

‘সর‍্যি স্যার।’

অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। সত্যিই সে সকাল থেকে না খেয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই দুশ টাকা গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে। হাতে এখন মাত্র পঞ্চাশ টাকা আছে। টানা দেড় ঘন্টা হেঁটে রায়াকে পড়াতে এসেছে।সন্ধ্যায় হলে ফিরে হালকা কিছু খেয়ে নিবে। একবেলা খেয়েও দশদিন কাটবে কিনা এই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। রায়া অংক শেষ করে অভ্রকে খাতা দেখালো। অভ্র গম্ভীর মুখে বললো,

‘আজ তো দেখি সবগুলো অংক হয়েছে! ভেরি গুড। কিছু হোমওয়ার্ক লিখে দিচ্ছি। এগুলো করে ফেলবে।’

রায়া হেঁসে বললো,

‘আচ্ছা।’

অভ্র হোমওয়ার্ক লিখে দিয়ে বললো,

‘আমি তাহলে উঠি আজকে।’

‘একটু বসেন স্যার। দরকার আছে।’

‘কি দরকার?’

‘একটু অপেক্ষা করুন। বলছি।’

রায়া অভ্রকে বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে গেলো। একটি স্টিলের বাটিতে একজনের সমপরিমাণ ভাত এবং তরকারি বাড়লো। তারপর কাপড়ের ছোট্ট ব্যাগে ভরে রুমে ফিরে এলো। অভ্রর দিকে ব্যাগটি এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘বাবা, আপনাকে এটা দিতে বলেছে।’

অভ্র অবাক হয়ে বললো,

‘এটা কি?’

‘জানি না। আমাকে বলে নি। শুধু বলেছে আপনাকে দিতে।’

‘ঠিক আছে। আমি আসছি।’

অভ্র চলে গেলো। রায়া দরজা লাগিয়ে দিতেই তার গাল গড়িয়ে কয়েক ফোটা পানি পড়লো।

অভ্র পার্কের কোণায় বড় গাছটার নিচে বসে আছে। রায়ার দিয়ে দেওয়া ব্যাগটি সে এখনো খুলে দেখে নি। এখন দেখতে ইচ্ছে করছে। সে ব্যাগ খুলে একটি স্টিলের বাটি আবিষ্কার করলো। খুলে দেখলো বাটিতে ভাত আর আলু দিয়ে রান্না করা মাছের ঝোল। অভ্র হতভম্ব হয়ে বসে আছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তার। আচমকা দিব্যদৃষ্টিতে সে যেনো দেখতে পেলো, রায়া চোখে জল নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কি মায়াবী লাগছে তাকে দেখতে!

← পর্ব ০৩পর্ব ০৫ →

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন