আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
রমজান খানের বাড়িতে গত এক সপ্তাহ ধরে আত্মীয়দের সমাগম ছিলো। থাকবে নাই বা কেনো? বিয়ে বাড়ি কখনো জনমানবশূন্য হয় না। আজ অবশ্য পুরো বাড়ি খালি। এর পেছনেও কারণ আছে। বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি জনমানবপূর্ণ থাকে না। নতুন বউকে অপরিচিত মানুষগুলোর সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। নয়া পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয়। তার বড় ছেলের বউ রুদালিকে এখন সেই সময় দেওয়া হচ্ছে। রমজান সাহেব বারান্দায় বসে পেপার পড়ছেন। চশমা ছাড়া পেপার পড়তে তার সমস্যা হয়। এখনো হচ্ছে। অক্ষরগুলো স্পষ্ট নয়। আংশিক ঝাপসা। চোখে প্রেসার পড়ছে। ভুলবশত চশমা সাথে করে নিয়ে বারান্দায় আসা হয়নি। সম্ভবত বিছানার ওপর ফেলে এসেছেন। এখন চেয়ার ছেড়ে উঠে চশমা নিয়ে আসতে ইচ্ছা করছে না, আবার এ অবস্থায় পেপার পড়েও শান্তি পাচ্ছেন না। রমজান সাহেবের এই টানাপোড়নের সময় হাতে চায়ের কাপ নিয়ে প্রবেশ করলো রুদালি।
‘বাবা, আপনার চা।’
রমজান সাহেব হাসিমুখে পেপার ভাঁজ করতে করতে বললেন,
‘এই দেখো! মা তুমি কষ্ট করে আবার চা আনতে গেলে কেনো? কমলাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই হতো।’
রুদালি ইজি চেয়ারের পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলে চা রাখলো। মাথার ঘোমটা ঠিক করে বললো,
‘কমলাই নিয়ে আসছিলো। ভাবলাম আমি দিয়ে যাই।’
‘বেশ করেছো। এসো আমার পাশে এসে বসো। ওই যে ওদিকে ছোট্ট টুল আছে। ওটা নিয়ে এসে বসো।’
রুদালি রমজান সাহেবের পাশে গিয়ে বসলো। পরম মমতায় তার মাথায় হাত রাখলেন রমজান। নরম গলায় বললেন,
‘মা, তোমার এ বাড়িতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’
‘না বাবা।’
‘বাড়ির জন্য বেশি মন খারাপ লাগছে?’
রুদালি চুপ করে রইলো। রমজান সাহেব বললেন,
‘এটাই প্রকৃতির নিয়ম বুঝলে মা? মেয়েদের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিবর্তন হলো বিয়ে। এসময় নিজ পরিবারকে ফেলে নতুন পরিবারের অংশ হতে হয়। সংসারের দায়িত্ব তাদের নিজ কাঁধে তুলে নিতে হয়। সযত্নে নতুন পরিবারের মানুষগুলোর খেয়াল রাখতে হয়। এতদিন তুমি শুধুমাত্র কারো মেয়ে ছিলে। এখন তুমি একই সাথে কারো বউ আবার এই সংসারের কর্তীও বটে। অনেক দায়িত্ব তোমার। পুরুষ মানুষ হলো সংসারের পণ্যাগার। তোমার প্রয়োজনের যোগান দিবে। কিন্তু সেই পণ্যগুলো দিয়ে কারূকর্ম করবে তোমরা মেয়েরা।’
রুদালি নিচু স্বরে বললো,
‘আমার জন্য দোয়া করবেন বাবা। আমি যেনো সব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারি।’
‘অবশ্যই পারবে। তোমার ওপর আমার আস্থা আছে। অর্ণব কি এখনো ঘুমাচ্ছে?’
রুদালি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
‘ও ঘুম থেকে উঠলে আমার সাথে একটু দেখা করতে বলবে। কেমন?’
‘জ্বি বাবা। আমি বলবো।’
‘ঠিক আছে মা। তুমি তাহলে যাও।’
রুদালি উঠে চলে যেতে নিলো। এমন সময় রমজান সাহেব তাকে পুনরায় ডাক দিলেন। বিচলিত কন্ঠে বললেন,
‘বিছানার ওপর চমশাটা মনে হয় ফেলে এসেছি। বয়স হয়ে গেছে তো চশমা ছাড়া পেপার পড়তে সমস্যা হয়! তুমি কি একটু কষ্ট করে চশমাটা দিয়ে যাবে মা?’
‘এখুনি দিয়ে যাচ্ছি।’
রুদালি রমজান সাহেবকে চশমা দিয়ে শোবার ঘরে চলে এলো। অর্ণব এখনো ঘুমাচ্ছে। রুদালির তাকে ডাকতে ইচ্ছে করছে না। অর্ণবের সাথে সে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। চায়ের কাপটা বিছানার পাশে রেখে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো রুদালি। ফিনকি দিয়ে ঝলমলে রৌদ্র ছড়িয়ে পড়লো ঘরের প্রতিটি কোণায়। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দক্ষিণের আকাশ দেখতে লাগলো সে। বেখেয়ালি মনে কত ভিত্তিহীন প্রশ্নেরা ভীড় জমায়! ঠিক যেমন এখন তার মনে জমাচ্ছে।
অভ্র কেমন আছে? কি করছে? রুদালির কথা ওর মনে পড়ছে কিনা? – এজাতীয় প্রশ্নগুলো এখন ভিত্তিহীন। রুদালির জীবনে এখন অভ্র নামটি জুড়ে থাকা উচিত নয়। সে এখন তার জীবনে মৃত ফুলের মতো। শত পানির ছিটে দিয়েও আগের মতো সতেজ করা যাবে না। ধীরে ধীরে পচে যাবে। একসময় দুর্গন্ধ বেরুবে। বাস্তবতা মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় ডুবে থাকতে হবে রুদালিকে। এই প্রচেষ্টার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দুরূহ। তবুও প্রচেষ্টায় ত্রুটি রাখা যাবে না। রুদালির অন্যমনস্ক ভাব কেটে গেলো কারো ভরাট কন্ঠ শুনে।
‘গুড মর্নিং, রুদালি।’
রুদালি পেছন ফিরে তাকালো। অর্ণব জাগনা পেয়ে গেছে। মাথার চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। চেহারায় প্রফুল্ল ভাব।
‘সেইম টু ইউ।’
‘তোমার নাম নিয়ে চমৎকার দুই লাইন কবিতা মাথায় এসেছে। শুনবে?’
রুদালির কবিতা শোনার প্রতি এক ফোঁটা আগ্রহও নেই। তার পরেও শোনাতে যখন চাচ্ছে ভদ্রতাসূচক শোনা যেতে পারে। সে বললো,
‘শুনবো।’
‘মেয়েটির নাম রুদালি,
ডিম খায় হালি হালি।
কবিতাটা মজার না? হা হা হা।’
রুদালি মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো। রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। এরকমও কবিতা হয়? অর্ণব এখনো হেঁসেই চলেছে। রুদালি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘বাবা আপনাকে তার সাথে দেখা করতে বলেছে।’
‘কোন বাবা?’
‘কোন বাবা মানে? আপনার বাবা!’
অর্ণব অসহায় কন্ঠে বললো,
‘না মানে এতদিন বাবা ছিলো একটা। এখন বাবা হলো দুইটা। তাই কনফিউজড হয়ে গেছিলাম। শশুড়দের বাবা কেনো বলা হয় কোনো আইডিয়া আছে তোমার?’
‘না।’
‘আমারো নেই। তবে শশুরদের বাবা বলা উচিত নয়। বলতো কেনো?’
‘আমি জানি না। আপনি বলুন।’
‘শশুরকে বাবা বললে তার মেয়ে সম্পর্কে আমার বোন হয়ে যাবে না? হা হা হা।’
রুদালি নিজের রাগ দমিয়ে রেখে ঠান্ডা গলায় বললো,
‘আপনার চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
‘সমস্যা নেই। চায়ের মজা দুই ধরনের টেম্পারেচারে পাওয়া যায়। জানো কি কি?’
‘না।’
‘একটা হলো গরমে। ধোঁয়া ওঠা গরমে। আরেকটা হলো ঠান্ডায়। বরফ জমা ঠান্ডায়। মাঝামাঝি অবস্থায় থাকলেই সমস্যা। মাঝামাঝি অবস্থা কোনটা বুঝেছো তো? নাতিশীতোষ্ণ যেটাকে বলা হয়।’
‘আপনার চা এখন নাতিশীতোষ্ণ অবস্থায় আছে।’
অর্ণব চিন্তিত মুখে বললো,
‘তাহলে কি করা যায়?’
‘ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে আসবো?’
‘নিয়ে আসো। সকাল সকাল ঠান্ডা চা খাই। আরাম লাগবে।’
রুদালি দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হলো। এই ছেলে কি পাগল? কি সব আজগুবি কথা বলছে তখন থেকে? শেষ মেষ কিনা বাবা তাকে এরকম একজন পাগলের হাতে তুলে দিয়েছে! রুদালির কান্না পাচ্ছে। নিজেকে কোনোভাবে সামলিয়ে সে বরফ আনতে গেলো।
রমজান সাহেব এখনো বারান্দায় বসে আছেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তার বেশিরভাগ সময় কাটে বারান্দার ইজি চেয়ারটায় শুয়ে অথবা বসে। সকালের শুরুটা হয় পেপার পড়ে। পেপার পড়ার পর এক ঘন্টা বিরতি। এই সময়টা তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। গুন গুন করে গানের সুর তুলেন অথবা কাজী নজরুল ইসলামের কোনো কবিতা আবৃত্তি করার চেষ্টা করেন। আজকে তিনি কোনো গানও গাইছেন না, কবিতাও অবৃত্তি করছেন না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। অর্ণবের ডাকে তিনি চোখ মেলে তাকালেন,
‘বাবা আমাকে ডেকেছো?’
‘হুঁ। দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? পাশে এসে বোস।’
অর্ণব বাবার পায়ের কাছে মেঝেতে বসতে বসতে বললো,
‘কি হয়েছে? হঠাৎ এত জরুরী তলব?’
‘বলছিলাম যে তোর নতুন বিয়ে হলো, বউ কে নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসলে ভালো হতো না?’
অর্ণব নিচু স্বরে বললো,
‘বাবা, ও নতুন আমাদের বাসায় এসেছে। আমার সাথেও খুব অল্প সময়ের পরিচয়। এর মধ্যে দূরে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়াটা কি উচিত হবে।’
‘আরে বেটা, সেজন্যই তো বলছি দুজনে আলাদা কিছু সময় কাটিয়ে আয়। মেয়েটাকে দেখে আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে খুব কষ্টে আছে! স্বামী স্ত্রী একে অপরের আয়নার মতো। এই সম্পর্কের মাঝে কোনো গোপনীয়তা থাকবে না। তোর উচিত মেয়েটার সাথে একটু ফ্রি হওয়া। তার জন্য একান্ত সময় প্রয়োজন। বৌমাকে নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আয়।’
‘ঠিক আছে। আমি রুদালিকে বলে দেখছি।’
‘কোথায় যাবি আমাকে জানাস।’
অর্ণব হাসি চাপিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
‘কেনো? তুমিও মাকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমা পালন করতে যাবে নাকি?’
রমজান খান খপ করে ছেলের কান ধরে ফেললেন।
‘কি বললি? দিন দিন বেশি পাকনা হয়ে যাচ্ছিস। তাই না?’
‘উফ। বাবা! সর্যি সর্যি। খুব লাগছে! কানটা ছাড়ো। আর বলবো না। ভুল হয়ে গেছে।’
রমজান সাহেব ছেলের কান ছেড়ে দিলেন। অর্ণব কান ডলতে ডলতে বললো,
‘আর একটু জোরে ধরলে নির্ঘাত কান ছিঁড়ে যেতো।’
রমজান সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন।
রুদালি বিছানায় অর্ধেক গা এলিয়ে দিয়ে একদৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলো। অর্ণব ঘরে ঢোকায় সোজা হয়ে বসলো। অর্ণব একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো,
‘বাবা বলছিলো দূরে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসতে। তোমার কি পছন্দের কোনো জায়গা আছে?’
রুদালি কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
‘দূরে কোথায় যাবো?’
‘শহরের বাইরে। এই ধরো চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার যেখানে তোমার ইচ্ছা।’
‘কেনো?’
‘কেনো আবার! বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী কেনো ঘুরতে যায় জানো না? মধুচন্দ্রিমা পালন করতে।’
রুদালি একথা শুনে কিছুটা হাত পা গুটিয়ে বসলো। অর্ণব বিষয়টা বুঝতে পেরে বললো,
‘রুদালি। তুমি যেমনটা ভাবছো আসলে তেমনটা না। আমার যদি ওসবের প্রতি আগ্রহ থাকতো তাহলে আমি এই দুইদিনে অন্তত তোমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করতাম।’
রুদালির চোখ এবার ভিজে উঠলো।
‘দেখো আমি বুঝি। সবকিছুতেই একটু সময় দিতে হয়। তাছাড়া আমরা দুজন দুজনকে এখনো ভালোমতো চিনি না। যেহেতু সারাজীবন একসাথে থাকায় আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সেহেতু দুজনকে চেনাটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তুমি আমাকে বন্ধু হিসেবে দেখতে পারো। আর একজন বন্ধুর সাথে দূরে ঘুরতে যাওয়া অন্যায় নয়।’
রুদালি এবারো কিছু বললো না। মানুষটা আসলেই তাকে এই দুইদিন স্পর্শ করে নি। শুরু থেকেই সে তার সাথে খোলামেলা ভাবে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু এভাবে কয়দিন? একদিন না একদিন তো স্বামীর অধিকার ঠিক চেয়ে বসবে। সেদিন কি রুদালি পারবে তাকে আটকাতে? একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করতে? অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
‘আমি তোমাকে জোর করছি না। তোমার সিদ্ধান্তকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি। তুমি যা বলবে তাই হবে। তুমি সময় নিয়ে ভাবো কেমন? আমি আসছি।’
অর্ণব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রুদালি পুনরায় খাটে হেলান দিয়ে জানালার বাইরে তাকালো। তার সমুদ্র পচ্ছন্দ। অভ্রর সাথে কত প্ল্যান করেছে! বিয়ের পর সমুদ্রের পাড়ে বসে তারা মেতে উঠবে জ্যোস্নাবিলাসে। চাঁদের আলোয় সমুদ্রের কালো জল চিকচিক করবে। একটু পর পর ঢেউ এসে ছুঁয়ে যাবে তাদের পা। সেই ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে কেঁপে উঠবে দুটো শরীর। অভ্র আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে রুদালিকে।উষ্ণতায় বন্ধ হয়ে আসবে তার চোখ। তারা হারিয়ে যাবে অন্য এক জগৎে।
← পর্ব ০৪ | পর্ব ০৬ → |