আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস - পর্ব ১০ - আতিয়া আদিবা - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন আতিয়া আদিবা'র লেখা একটি ধারাবাহিক গল্প আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস'এর ১০ম পর্ব
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস

স্টেশন থেকে কিছুদূর পায়ে হেঁটে সামনে এগিয়ে রিক্সা নিলো দুজন। প্রথমেই খোঁজ করতে লাগলো হোটেলের। রাতটুকু তো কোনোভাবে পার করতে হবে। কিছুদূর যাওয়ার পর মোটামোটি ধরনের একটি হোটেল পেয়েও গেলো। মাঝারি আকারের একটি রুম সাথে ছোট্ট একটি বাথরুম। দুজন শোয়া যাবে এমন একটি খাট। এসি আছে। ছোট্ট একটি ড্রেসিং টেবিলও আছে। জানালায় সস্তা প্রিন্টের পর্দা ঝুলছে। যথেষ্ট না হলেও রাতটুকু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে কাটানো যাবে। হোটেলে ব্যাগপত্র রেখেই অর্ণব এবং রুদালি বের হয়ে পড়লো তাদের প্রথম এডভেঞ্চারের স্বাদ গ্রহণ করতে। যদিও অর্ণবের বন্ধুদের সাথে এডভেঞ্চারের স্মৃতি অগুণিত। তবে রুদালির সাথে আজকেই প্রথম এবং তাদের গন্তব্যস্থান চন্দ্রনাথ পাহাড়।
হোটেলের নিচ থেকে সিএনজি ভাড়া করা হলো। একজন প্রতি পনেরো টাকা নিয়ে সিএনজি চালক তাদের নামিয়ে দিলো চন্দ্রনাথ পাহাড়ের নিম্নস্থলে। রুদালির গায়ে হালকা আকাশি রঙের কামিজ। সে প্রথমে শাড়ি পরেই তৈরি হয়েছিলো। রুদালিকে দেখে অর্ণব চোখদুটো কপালে তুলে বললো,

‘তুমি কি শাড়ি পরে হাইকিং এ যাবে নাকি?’

রুদালি সহজ কন্ঠে উত্তর দেয়,

‘হ্যাঁ। কেনো?’

‘পাগল নাকি? শাড়ি পায়ে বাজিয়ে চলতি পথে ধুপাস করে পড়ে যাবে তো! একদম কেলেঙ্কারি বেজে যাবে। ক্যাজুয়াল পোশাক নেই? ক্যাজুয়াল কিছু একটা পরে ফেলো।’

রুদালি চোখ মুখ শক্ত করে বললো,

‘আমি শাড়ি ছাড়া অন্য কোনো পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না।’

‘স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করলেও কিছু করার নেই শাড়ি বদলে ফেলো। অন্য পোশাক গায়ে দাও।’

বিরস মুখে রুদালি শাড়ি পাল্টাতে যায়। তার গায়ে শোভা পায় হালকা আকাশি রঙের সালোয়ার কামিজ।

সিএনজিতে বসে অর্ণব এবং রুদালির মাঝে টুকটাক কথা হতে থাকে। অর্ণব রুদালিকে জিজ্ঞেস করে,

‘তুমি আগে কখনো পাহাড় দেখেছো?’

রুদালি হাসিমুখে জবাব দেয়,

‘সামনা সামনি কখনো দেখিনি। তবে ছোটবেলায় টিভিতে দেখেছি। সেসময় বিটিভিতে বাংলাদেশের সকল দর্শনীয় স্থানগুলো দেখানো হতো। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের জীবন যাপনের চিত্র কি সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতো! মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।’

প্রত্যুত্তরে অর্ণবও হাসে। বলে,

‘আজ সামনা সামনি দেখে নিও।’

পাহাড়ের নিচে দুইজন মধ্যবয়স্ক লোক লম্বা লম্বা বাঁশের তৈরি চিকন লাঠি বিক্রি করছে। অর্ণব রুদালিকে দাঁড় করিয়ে রেখে দুটো লাঠি কিনতে গেলো। রুদালি অবাক হয়ে দেখলো স্টেশনের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের দলও এখানে উপস্থিত। তারাও বাঁশের চিকন লম্বা লাঠিগুলো কিনছে। হাইকিং এ এসেছে। তাদের প্রত্যেকের চেহারায় উত্তেজনা স্পষ্ট। চোখজুড়ে রয়েছে পাহাড়ের ওই মেঘাচ্ছন্ন চূড়া স্পর্শ করার অদম্য ইচ্ছা। অর্ণব লাঠি কিনে রুদালির কাছে ফিরে আসলো। মেয়েটাকে আজ দেখতে কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগছে! শাড়ি পরলে মেয়েদের এমনিতেই বয়সের তুলনায় বড় দেখায়। অর্ণব শান্ত গলায় বললো,

‘চলো তাহলে? যাত্রা শুরু করা যাক?’

রুদালি বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘ঠিক আছে।’

অর্ণব আঙুল দিয়ে দূরে পাহাড়ের চূড়াকে ইঙ্গিত করে বললো,

‘ওই যে আমাদের মূল গন্তব্যস্থান। ওই পর্যন্ত যেতে পারবে?’

রুদালি নিচু স্বরে বললো,

‘চেষ্টা করে দেখি।’

অর্ণব উচ্চস্বরে হেসে ফেললো। তারপর দুজন পা মিলিয়ে মূল ফটকের দিকে এগোতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর পাহাড়ের উঁচুতে ওঠার দুটো রাস্তা পাওয়া গেলো। একটি সিঁড়ি পথ। অপরটি ঢালু পথ। অর্ণব এবং রুদালি ঢালু পথের পথিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
দুইপাশে সবুজ গাছপালা। হালকা বাতাসে পাতাগুলো নড়ছে। ঝিরিঝিরি শব্দ হচ্ছে। দূর থেকে নাম না জানা পাখির কুজন শোনা যাচ্ছে। এরই মাঝে বাঁশের ওপর ভর দিয়ে হেঁটে চলছে রুদালি আর অর্ণব। ইতিমধ্যে রুদালি ঘেমে গেছে। নাকের ওপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম কেমন চিকচিক করছে। প্রায় আধাঘণ্টা হাঁটার পর ক্ষীণ কলকল শব্দ শোনা গেলো। কদম ফেলার সাথে সাথে সেই কলকল শব্দও বাড়তে লাগলো। রুদালি মুখ সুঁচালো করে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব হেসে বললো,

‘ঝর্ণার শব্দ।’

ডানদিকে চোখ পড়তেই রুদালি দেখলো পাহাড় ফুঁড়ে বেরুচ্ছে ঝর্ণার পানি। ঝর্ণার সৌন্দর্যে রুদালি বিমোহিত হয়ে পড়লো। সে অস্ফুটভাবে বলে উঠলো,

‘কি সুন্দর!’

রুদালি কিছুক্ষণ ঝর্ণার দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর পুনরায় তাদের যাত্রা শুরু হলো। আরো কিছুদূর যাওয়ার পর একটু খালি জায়গা পাওয়া গেলো। মাটির উঁচু ঢিবীর মতো। অর্ণবের প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে। এদিকে রুদালিও বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে। তারা দুজনই সিদ্ধান্ত নিলো এ জায়গাটায় কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেবে। পাহাড়ের এই স্থান থেকে যতদূর চোখ যায় শুধু উঁচু নিচু উপগিরি। বিস্তীর্ণ সবুজের রূপে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। অর্ণব ট্রাভেল ব্যাগ থেকে পানি বের করে নিজের গলা খানিকটা ভিজিয়ে নিলো। তারপর বোতলটি রুদালির দিকে এগিয়ে দিলো। রুদালিও প্রাণভরে তেষ্টা মেটালো। অর্ণব জিজ্ঞেস করলো,

‘এডভেঞ্চার কেমন লাগছে?’

রুদালি হেসে বললো,

‘ভালো।’

‘শুধু ভালো?’

‘উহুঁ। অনেক ভালো।’

‘পাহাড়ের সৌন্দর্যই আলাদা। তাই না?’

‘হুঁ। এর সৌন্দর্য ক্যামেরায় বন্দি করে লাভ নেই। টিভিতে দেখে যতটুকু সুন্দর মনে করতাম তার চেয়েও ঢের গুণ বেশি সুন্দর এই পাহাড়ি পরিবেশ।’

‘ঠিক বলেছো। আমি বন্ধুদের সাথে একবার বান্দরবন গিয়েছিলাম। চিম্বুক পাহাড়ের নাম শুনেছো?’

‘শুনেছি।’

‘চিম্বুক পাহাড় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের দৃশ্য যে কতটা মনোহর! প্রকাশ করা দুরূহ।’

রুদালি আগ্রহ নিয়ে বললো,

‘সেই পাহাড়েও বুঝি এভাবে উঠতে হয়?’

অর্ণব হেসে বললো,

‘না। পাহাড়ে ওঠার জন্য চাঁন্দের গাড়ি আছে। দুঘন্টা ভরে চরকির মতো ঘুরতে ঘুরতে তোমাকে নিয়ে যাবে একদম পাহাড়ের শীর্ষে। তবে দীর্ঘসময় ধরে চরকির মতো ঘোরার ফলে ব্রেনে তালগোল পাকিয়ে যায়। আমার এক বন্ধু তো যাত্রাকালেই অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। বমি টমি করে বিচ্ছিরি অবস্থা।’

রুদালি ছোট্ট করে উত্তর দেয়,

‘ও।’

অর্ণব আশে পাশে তাকিয়ে বলে,

‘মনে হয় আমরা চন্দ্রনাথের প্রথম মন্দিরের খুব কাছে চলে এসেছি।’

রুদালি উত্তেজিত হয়ে বললো,

‘তাহলে আমরা বসে আছি কেনো? চলুন পাহাড়ে উঠি।’

অর্ণব বিস্মিত কন্ঠে বললো,

‘তোমার ক্লান্ত লাগছে না?’

‘না।’

‘আমি আরো ভাবলাম তুমি হাঁপিয়ে উঠেছো। দেখতেও ক্লান্ত লাগছে। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে নেই। তারপর আবার হাইকিং শুরু করা যাবে।’

রুদালি তড়িঘড়ি করে উত্তর দিলো,

‘আমি কি বলেছি আমি ক্লান্ত? তাছাড়া এত কাছাকাছি এসে রেস্ট নিতে হবে কেনো?’

‘বেশ! চলো আবার শুরু করি, এই পাহাড়ি পথের যাত্রা।’

রুদালি হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো।
আরো পনেরো মিনিটের মতো হাঁটার পর দেখা মিললো চন্দ্রনাথের প্রথম মন্দিরের। একপাশের মন্দিরে ছোট্ট একটি গম্বুজ রয়েছে। এই মন্দিরের সিঁড়ির প্রায় কাছ ঘেঁষে বেড়ে ওঠেছে একটি ঝাঁকড়া গাছ। পুরো স্থানটিকে যেনো ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছে। অপর পাশের মন্দিরটি ঠিক এক কোণায় একলা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণব বললো,

‘তোমার হাতে সময় আছে দশ মিনিট।’

রুদালি কপাল কুঁচকে বললো,

‘কেনো?’

‘কারন এখানে আমাদের দশ মিনিটের বেশি থাকতে দিবে না। কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা আছে। আর এই দশ মিনিটের মাঝে তোমার আরেকটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

‘সিদ্ধান্ত! কিসের সিদ্ধান্ত?’

অর্ণব রুদালির থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে ধীর পায়ে রুদালির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। চারিদিকে এখন বাঁধভাঙ্গা বাতাস। রুদালির জর্জেটের নীলাভ ওড়না এলোমেলো ভাবে উড়ছে। তার ওড়নার রঙের সাথে আকাশের স্নিগ্ধতার কোথায় যেনো মিল আছে! দৃষ্টির সংস্পর্শে যতটুকু দৃশ্যমান সেখানে শুধু সবুজ তৃণাবৃত। আষাঢ়ের আকাশে দুই দলের মেঘ বিচরণ করছে। একদল মেঘ ধবধবে সাদা। এদের গতি মন্থর। এদের প্রস্থান দীর্ঘকালব্যাপী। আরেকদল মেঘ কালচে বর্ণের। এদের গতি সাদা মেঘগুলোর দ্বিগুণ। এরা প্রস্থানে খুব বেশি সময় নিচ্ছে না। অর্ণব একদম রুদালির কাছে এসে দাঁড়ালো। রুদালি অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ণব চোখ নামিয়ে নিলো। হাসার চেষ্টা করে বললো,

‘তুমি কি আরোও উপরে যেতে চাও নাকি এখানেই সমাপ্তি টানতে চাও।’

রুদালি বেশ অন্যমনস্ক হয়ে আছে। সে মুখ ফসকে বলে ফেললো,

‘সবকিছুর ইতি টেনে দেওয়াটা কি এতই সহজ?’

অর্ণব নিচু স্বরে বললো,

‘আমি কিন্তু হাইকিং এর কথা বলছি।’

রুদালি তার চেতনা ফিরে পেলো। সে অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

‘দুঃখিত।’

‘এখন বলো, আরো ওপরে যাবে নাকি এখানেই এডভেঞ্চার শেষ হবে?’

রুদালি অনুনয়ের স্বরে বললো,

‘আরেকটু ওপরে যাই?’

অর্ণব হেসে বললো,

‘ঠিক আছে। চলো যাই।’

পুনরায় পাহাড় বেয়ে উঠতে উঠতে অর্ণব জিজ্ঞেস করলো,

‘রুদালি, তুমি হেমন্ত মুখার্জীর ওই গানটা শুনেছো?’

‘কোন গান?’

‘এই পথ যদি না শেষ হয়_’

‘শুনেছি।’

‘তাহলে আমাকে শোনাও।’

‘আমি গান গাইতে পারি না।’

‘আমি কিন্তু গাইতে পারি। শুনতে চাও?’

‘হুঁ। চাই।’

অর্ণব খালি গলায় গান ধরলো,

‘এই পথ যদি না শেষ হয়,
তবে কেমন হতো তুমি বলো তো।
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়,
তবে কেমন হতো তুমি বলো তো।।’

রুদালি অস্ফুটভাবে বললো,

‘তুমিই বলো।’

অর্ণব কপালে ভাঁজ ফেলে রুদালির দিকে তাকালো। রুদালি জিভে কামড় দিয়ে হেসে ফেললো। রুদালির কান্ড দেখে অর্ণবও হাসছে।

← পর্ব ০৯পর্ব ১১ →

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন