আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
আকাশ এখন পরিষ্কার। বৃষ্টি থেমেছে তাও ঘন্টাখানিক হলো। অভ্র ভেজা কাপড় গায়ে দিয়েই এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে সে জেলা রোডে গেলো। বড় বড় হেলিপ্যাড গুলোর পাশে নানারকম স্ট্রিটফুডের আস্তানা। অভ্র এক প্লেট চটপটি অর্ডার করলো। বিকালে এই দিকটায় কপোত কপোতীদের মেলা বসে। হাতের মুঠোয় হাত পুরে তারা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। অভ্র আর রুদালির অনেক স্মৃতি মিশে আছে এই জায়গায়। ক্যাম্পাসে তারা খুব একটা দেখা করতো না। প্রয়োজনে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে কথা বলতো। কিন্তু এই দূরত্ব রুদালির পচ্ছন্দ হতো না। সুযোগ পেলেই তারা জেলা রোডে চলে আসতো। হেলিপ্যাডের এর কোণায় দূর্বাঘাসের ওপর হাত ধরে বসে থাকতো। রুদালি তার মাথা এলিয়ে দিতো অভ্রের কাঁধে। সেখানে বসে তারা আংশিক সূর্যাস্ত উপভোগ করতো। জব্বার মামা তার ছোট নাতনিকে দিয়ে এক প্লেট চটপটি আর এক প্লেট ফুচকা পাঠিয়ে দিতো। বেশিরভাগ সময়ই অভ্র ভুল করে মরিচে কামড় দিয়ে ফেলতো। ছেলের কান লাল হয়ে যেতো। নাক টানতে শুরু করতো। রুদালি পরম যত্নে তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে রুমাল বের করে অভ্রর দিকে এগিয়ে দিতো। পলিথিনে মোড়ানো ছোট্ট ঠান্ডা পানির বোতল পাশে রেখে দিতো। মাঝে মধ্যে তার প্লেটের এক দুইটি ফুচকাও অভ্রকে খাইয়ে দিতো। অবশ্য এর পরিবর্তে তাকেও এক দুই চামচ চটপটি খাইয়ে দিতে হতো! এই ছোট ছোট বিষয়গুলোর মধ্যে তারা অফুরন্ত ভালোবাসা খুঁজে পেতো। নিজেদেরকে পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষ বলে মনে করতো। মধ্যবিত্তদের প্রেমগুলো হয় পবিত্র, স্বার্থহীন। এদের প্রেমের শুরুটা কোনো দামী চাইনিজ রেস্টুরেন্টে হয় না। শুরুটা হয় কোনো পার্কের কোণায় বসে পাঁচ টাকার বাদাম ছিলিয়ে খেতে খেতে। বিল দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেমিকদের পিছে ফেলে প্রেমিকারাই বেশি এগিয়ে থাকে। দুজনের মাঝে বোঝাপড়া থাকে। দুজনের প্রতি সম্মান এবং শ্রদ্ধা থাকে। সত্যিকারের ভালোবাসার উদাহরণ হিসেবে এদের ভালোবাসাই হয় শ্রেষ্ঠ। এদের ভালোবাসাময় জীবনে অনেক ঝড় আসে। অনেকে সেই ঝড়গুলো উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়, অনেকে শক্ত স্তম্ভের অভাবে উপড়ে পড়ে।
অভ্র চেয়ারে বসে আছে। জব্বার মামা নিজেই চটপটির প্লেট নিয়ে আসলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি ব্যাপার মামা? একা আইছেন দেখি! মামি কনে?’
‘আজকে আসেনি, মামা।’
‘বাড়িতে সমস্যা?’
অভ্র হেঁসে জবাব দিলো,
‘হ্যাঁ।’
‘ওঁ। বুঝবার পারছি। আইচ্ছা খান আপনে।’
জব্বার চলে গেলো। অভ্রর একবার বলতে ইচ্ছা করছিলো রুদালি আর আসবে না। আজ থেকে সে একাই চটপটি খেতে আসবে। একটু বাদেই আবার ভাবলো, থাক! কি দরকার আছে? সে অন্যমনস্ক হয়ে চটপটি খাচ্ছে। হঠাৎ মরিচে কামড় দিয়ে ফেললো। মুখ ফসকে বলে উঠলো,
‘রুদালি! পানি বের করো পানি। মরিচে কামড় দিয়ে ফেলেছি। ওরে বাপরে! কি সাংঘাতিক ঝাল! কি হলো তাড়াতাড়ি বের করো। ঝালে মরে গেলাম তো!’
কোনো উত্তর এলো না। পরক্ষণেই অভ্রর মনে হলো রুদালি তো তার পাশে নেই। সে হয়তো কনে সাজায় ব্যস্ত। অভ্র জানে মেয়েটা অনেক কাঁদছে। কিন্তু তার কেনো কান্না পাচ্ছে না? তার চোখে কেনো পানি নেই? কোথায় যেনো একবার পড়েছিলো, ‘অধিক শোকে পাথর’। তার অবস্থা মনে হয় এখন তাই। অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে। তাই কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। একটা বাচ্চা ছেলে বেশ দূরে বসে আছে। কিন্তু সে তাকিয়ে আছে অভ্রর হাতের দিকে। বিষয়টা অভ্রর দৃষ্টিগোচর হলে বাচ্চাটিকে সে ডাক দেয়। ছেলেটি ভয়ার্ত চোখে এগিয়ে আসে। অভ্র জিজ্ঞেস করে,
‘নাম কি তোর?’
‘মফিজ।’
‘থাকিস কই?’
ছেলেটা হাত দিয়ে ফুটপাতের দিকে ইশারা করে বলল,
‘ওইহানে থাকি।’
‘চটপটি খাবি?’
ছেলেটা চুপ করে রইলো। অভ্র ছেলেটার হাতে চটপটির প্লেট দিয়ে বললো,
‘নে খা। সাবধানে খাস। মরিচগুলো অনেক ঝাল।’
অভ্র একথা বলে উঠে দাঁড়ালো। জব্বার মামাকে বিল পরিশোধ করে হাঁটতে লাগলো। পেছন থেকে মফিজ নামক ছেলেটি বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে অভ্রর চলে যাওয়া দেখছে। মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে ভালো লাগে। অভ্র আজকে গন্তব্যস্থান ঠিক না করেই হাঁটছে। অবশ্য তার মনে একটি জায়গায় যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে কাজ করছে। কিন্তু সেখানে যাওয়াটা যুক্তিহীন। রুদালিদের বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝে কোনো যুক্তি নেই। আবার তার যে এখন রুদালিকে কনের সাজে দেখতে ইচ্ছে করছে, এটাও যুক্তিসঙ্গত নয়। তবুও অভ্র কি রুদালিদের বাসার সামনে যাবে একবার?
চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। রুদালিদের বাসায় পায়ে হেঁটে যেতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবে। এমন সময় অভ্রর গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন এলো। বৃষ্টির কারণে মোবাইল ছোট্ট প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে রেখেছিলো। আয়োজন করে ফোন বের করে রিসিভ করলো সে।
‘আসসালামু আলাইকুম, আম্মা।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। ক্যামন আছো বাজান?’
‘আলাহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনারা কেমন আছেন?’
‘আমি ভালো আছি। কিন্তু তোমার বাপজানের বুকের ব্যাথা বাড়ছে।’
‘বাবাকে শহরে এনে ডাক্তার দেখাবো নাকি ভাবছি।’
‘দেখাবার পারলে অনেক ভালো হইতো। ইয়ে মানে বাজান? একটা কথা ছিলো।’
‘জ্বি আম্মা বলেন।’
‘কইতেছিলাম যে কয়েকদিন ধইরা তো অর্ডার পাই না। জামা সেলাই করতে পারতেছি না। টাকা যা ছিলো তা দিয়া বাজার সদাই কিনা আনছি।’
‘হুঁ।’
‘তোমার বাপের ওষুধ কিনবার পারি নাই। টাকায় হয় নাই।’
‘কত টাকা লাগবে?’
‘দুইশ।’
‘আমি আগামীকাল সকালেই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘মাস শেষ হইতে তো এহনো দশ দিন বাকি। তুমি চলবার পারবা তো?’
‘হ্যাঁ মা, পারবো। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।’
‘রাতে খাইছো?’
‘না আম্মা। হলে গিয়ে খাবো।’
‘আইচ্ছা বাজান। ভালো থাইকো। দোয়া রইলো।’
‘জ্বি আম্মা।’
অভ্র ফোন রেখে দিলো। কথা বলতে বলতে সে রুদালিদের দুতলা বাসার সামনে এসে পরেছে। প্রতিটি ঘরের লাইট জ্বলছে। অভ্র কিছুক্ষণ বাসার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর পুনরায় হাঁটতে লাগলো। এখন সে হাঁটতে হাঁটতে বেবিস্ট্যান্ড যাবে। রিক্সায় যেতে পারলে ভালো হতো। একটানা হাঁটার ফলে প্রচন্ড পা ব্যাথা করছে। কিন্তু পকেটে মাত্র পনেরো টাকা আছে। অটো ভাড়াতেই দশ টাকা চলে যাবে। বাকি পাঁচ টাকা দিয়ে রাতে কিছু একটা খেয়ে নিতে হবে। সারাদিন পেটে সেভাবে কিছু পড়েনি। অভ্র ক্যাম্পাসের সামনের দোকান থেকে এক কাপ চা আর এক পিস রুটি খেয়ে নিলো। তার খিদে কমেনি বরং পেটে অল্প কিছু পড়ায় আরো বেড়ে গেছে। হলের খাবার খেলে অভ্রর পেটে অসুবিধা হয়। একটা সিগারেট টানতে পারলে মনে হয় ক্ষুধার জ্বালা কিছুটা কমতো। কিন্তু টাকা পয়সার যে টানাটানি, এ অবস্থায় সিগারেট কেনাটাও বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। অভ্র ঘরে ঢুকলো। তার রুমমেট ঘরে নেই। হয়তো অন্য কারো রুমে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। অভ্র দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা প্যান্টে হাত ঢুকিয়ে দেখলো মোটে দুইশো পঞ্চাশ টাকা আছে। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। দুইশো টাকা আগামীকাল বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। বাবার হার্টের সমস্যা আছে। ওষুধ কোনোভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না। আর বাকি পঞ্চাশ টাকা দিয়ে মাসের বাকি দিনগুলো যেভাবেই হোক কাটাতে হবে।
← পর্ব ০২ | পর্ব ০৪ → |